চিত্রলেখার সংসার - পর্ব ০৬ - ইসরাত তন্বী - ধারাবাহিক গল্প


"কোকিলা, এই কোকিলা কী হইলো তোর? কথা ক মোর লগে। মোর সোনাডা চোখ খুইলা দ্যাখ। মুই সব ঠিক কইরা দিমু। তুই খালি চোখদুটো খুইলা তাকা।"

চিত্রলেখার মাথাটা কোলের উপর নিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল কাব্যতা। কাঁদতে কাঁদতেই উপস্থিত থাকা বাকিদের উদ্দেশ্যে চিল্লাল, "কেউ পানি আইনা দাও মোরে। মোর কোকিলা চোখ খুইলা দ্যাখে লাই। ও কষ্ট পাইতাছে।"

জাবেদা বেগমের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এসেছে। ওনার টাকার উৎস তবে কি শেষ পথে? উনি আর দাঁড়ালেন না। ছুটলেন ঘরের দিকে। কাব্যতার কান্নার উচ্চ আওয়াজে বাড়ির আশেপাশের সকলে উপস্থিত হয়েছে ততক্ষণে। তারা কেবল নীরব দর্শক। মায়ের পিছু পিছু তারাও ছুটে গেল। হঠাৎ করেই আত্মহংকারী তারার মাঝে ঈষৎ পরিবর্তন লক্ষ্যনীয়। মেয়েটা চিত্রলেখার প্রতি বেশ টান দেখাচ্ছে ইদানিং। এখন এর পিছনে উদ্দেশ্য সৎ নাকি অসৎ সেটা অজানা।

ঘরে বেশি পানি নেই। কপাল চাপড়ালেন জাবেদা বেগম। শনি সবদিক থেকে লেগেই আছে। শেষ হওয়ার নাম গন্ধ নেই। খোকা কয়টা দিন পরে আসলে কী হতো? সবটা ঠিকঠাকভাবেই সামলিয়ে নিতেন উনি। এই মুহূর্তে সময় অপচয় করা বোকামো। জাবেদা বেগম আর ভাবলেন না। কলসি হাতে পুকুর পাড়ে ছুটলেন। ওনার পিছনে তারাকেও একটা কলসি হাতে দৌড়ে যেতে দেখা গেল। এইসবে ভীষণ রকমের বিরক্ত চিত্রলেখার শহুরে বাবু। চোখমুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি নিবিষ্ট কাব্যতার ক্রন্দনরত মুখমণ্ডলে। কী যেন ভেবে চলেছে নির্নিমেষ। অপরদিকে রুহানি নির্লিপ্ত এইসবে। বুকের উপর হাত ভাঁজ করে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। যেন নাটকের আসন্ন পর্ব দেখতে ও খুব এক্সাইটেড। 

কিছু সময়ের ব্যবধানে জাবেদা বেগম এবং তারা ফিরে এলেন দুই কলসি পানি নিয়ে। চিত্রলেখাকে বুকের মাঝেই আঁকড়ে রেখেছে কাব্যতা। পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে থেকে কয়েক জন এগিয়ে এলো। তবে ওকে সরাতে পারল না কেউ। অগত্যা ওভাবেই চিত্রলেখার মাথায় পানি দিতে শুরু করলেন। এক কলসি শেষ হতেই তারা আবার ছুটল পুকুরঘাটে। এভাবে প্রায় দশ কলসি পানি ঢালা হলো চিত্রলেখার মাথায়। অবশেষে পাক্কা আধা ঘন্টা সময়ের ব্যবধানে চিত্রলেখার আঁখি জোড়া খানিকটা নড়ল। কয়েক মিনিট পেরোতেই আস্তে ধীরে লোচন দ্বয় মেলে তাকাল। মুখটা বেজায় ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। ওকে তাকাতে দেখেই কাব্যতা কাঁদতে কাঁদতেই ক্ষীণ হাসল। চিত্রলেখার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো, 

"আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। কোকিলা তুই ভয় পাইয়া দিয়াছিলিস মোরে। এখন মুই শান্তিডা পাইলাম।"

চিত্রলেখা কিছুক্ষণ কাব্যতার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। কাব্যতার করা পাগলামীর সাক্ষী হিসেবে ওই ভেজা, লাল, ফুলো নেত্র দুটোই যথেষ্ট। অধর প্রসারিত হলো চিত্রলেখার। এই বিষাদের মাঝেও হাসল ক্ষীণ। যাক কেউ তো আছে ওর জন্য। ঝিমধরা মাথা নিয়ে উঠে বসল চিত্রলেখা। কাব্যতা সাহায্য করল। চিত্রলেখার সম্পূর্ণ শরীর সিক্ত। কাপড় পরিবর্তন করা অত্যাবশ্যক। মাত্রই জ্বর থেকে উঠেছে। কপালের কাটা অংশের র ক্ত ধুয়ে মুছে নিঃশেষ হয়েছে। তবে যন্ত্রনায় টনটন করছে কপালের একাংশ। এক পলক তাকাল শহুরে বাবুর দিকে। পরপরই নজর ফিরিয়ে নিলো। একা একাই ওই নিষ্পেষিত দুর্বল শীর্ণ দেহখানা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। কাব্যতা সাহায্য করতে চাইলে আঙ্গুলের ইশারায় না করে দিলো। মুখ দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করল না। শ্লথ গতিতে হেটে নিজের ঘরে চলে গেল। কাব্যতা ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। বুকব্যথা ক্রমশ বাড়ল। ওর কোকিলার ভাগ্যটা এমন কেন হলো? একটু ভালো কি হতে পারত না? মেয়েটা তো খুব বেশি কিছু চায়নি। সেটাও কেন জুটল না ওর কপালে? সব খুইয়ে এখন কী নিয়ে বাঁচবে? মানুষ নাকি অতি কষ্টে পাথর হয়ে যায়। চিত্রলেখার দশা টাও ঠিক তেমনই। 

আজ জাবেদা বেগমের মনের কোথাও একটু মায়া অনুভব হলো ওই সর্বহারা মেয়েটার জন্য। উনি এতক্ষণে রেগে মুখ খুললেন, "আমারে না কইয়া তুই এইডা ক্যামনে করলি বাপজান? মাইয়াডার কপাল পুড়াইলি যে।"

প্রত্যুত্তর ভেসে এলো রুহানির দিক থেকে, "আম্মা আপনি আমার সাথে একটু ঘরে চলুন। আপনার সাথে কিছু কথা আছে আমার। না, করবেন না দয়া করে।"

জাবেদা বেগম চুপ করে রইলেন। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন যাওয়া ঠিক হবে কিনা। কিয়ৎসময় জল্পনা কল্পনা করে কোনো কথা ছাড়াই ঘরের দিকে হাঁটা ধরলেন। রুহানির অধরপল্লবে বাঁকা হাসির রেশ ছড়াল। পাশে দাঁড়ানো শহুরে বাবুর দিকে তাকাল। দুজন দুর্বোধ্য চোখের ভাষায় নিজেদের মধ্যে কথা আদান-প্রদান করে নিলো। অতঃপর রুহানি একটা ব্যাগ হাতে জাবেদা বেগমের পিছনে হাঁটা ধরল।

জাবেদা বেগম সরে যেতেই একজন প্রতিবেশী চাচী ম্লান সুরে আওড়ালেন, "মাইয়াডা এই বাড়িত আইসা একদন্ড শান্তির মুখ দেখলো নারে। হারাডা দিন রাইত ভুতের ব্যাগার খাটে। অসুস্তাটাডাও মাইনতে পারে লাই। এত্ত কইরাও কারুর মন পাইল না। বহুত ভালা মাইয়া আছিল বউডা। কেবল গায়ের রঙডাই একডু কালা ওই যা।"

কাব্যতা এই পর্যায়ে চিত্রলেখার ঘর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শহুরে বাবুর দিকে তাকাল। পায়ে পায়ে হেঁটে যেয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল। ওকে এতোটা নিকটে দেখতেই শহুরে বাবুর চোখদুটো ছোট ছোট হয়ে এলো। কপালে ভাঁজ বাড়ল। খানিকটা পিছিয়ে গেল। কাব্যতার ওষ্ঠপুটে দেখা মিলল তাচ্ছিল্যের হাসি। মুখটা কিঞ্চিত এগিয়ে চোখে চোখ রেখে হিসহিসিয়ে বলল,

"মিস্টার সানওয়াদ সাহিল আবারও একটা নিষ্পাপ মাইয়ারে ঠকাইয়া নিজের পাপ বাড়াইলেন। আপনের পাপের ঘড়া এইবার পূর্ণ হইলো। মোর লগে করা অন্যায়ের ক্ষমা হইলেও মোর কোকিলার লগে করা অন্যায়ের কোনো ক্ষমা লাই।" থামল কাব্যতা। আঁখি যুগল মাত্রাতিরিক্ত রাগে ইতোমধ্যে লাল হয়ে উঠেছে। শরীর মৃদু কাঁপছে। রাগ সামলাতে অপারগ মেয়েটা। হস্তজোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে বিশ্রী এক গালি ছুঁড়ল সাহিলের উদ্দেশ্যে, "খান*র পোলা তোর মরণ মোর হাতেই রইয়াছে দেইখ্যা লস। যেই জবান দিয়া মোর কোকিলারে কষ্ট দিয়াছিস ওইডা মুই কাইটা লামু। তোর জিভ কাইট্টা মুই পায়ের চটি বানামু।"

মুখের কথা শেষ করে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না কাব্যতা। অপরপক্ষকে কোনো টু শব্দ করার সুযোগ না দিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। প্রস্থানের আগে অবশ্য এক ঝলক চিত্রলেখার আধভাঙা নিস্তব্ধ ঘরটার দিকে তাকিয়েছিল। সাহিলের ভেতরে কেমন এক তিক্ততা ছড়াল। রক্তচক্ষু দিয়ে কাব্যতার প্রস্থানের দিকে চেয়ে রইল। পরক্ষণেই চলে গেল নিজের জন্য নির্ধারিত ঘরের দিকে। যেটার চাবি একমাত্র ওর নিজের কাছেই থাকে। তারা নিজেও ভাইজানকে অনুসরণ করল। ঘরদোর পরিষ্কার করে গুছিয়ে দিতে হবে তো। আস্তে আস্তে জায়গাটাও ফাঁকা হয়ে এলো। সবাই নিজ নিজ কাজে ছুটল। সকলে এতক্ষণ নীরব দর্শক থাকলেও পরবর্তীতে হয়ে যাবে বড়ো মাপের সমালোচক। কমবেশি মশলা মিশিয়ে মজা নিবে সবাই। এটা তো আমাদের মনুষ্য ধর্ম। অন্যের কষ্টে আমরা হাসতে, মজা নিয়ে বড্ড সাচ্ছন্দ্য বোধ করি কি-না!

••••••••••

বদ্ধ ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে জাবেদা বেগম এবং রুহানি। ঘরে এসে পর্যন্ত দুজনেই চুপচাপ। রুহানি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শুকনো ঢোক গিলে হাতে থাকা ব্যাগটা জাবেদা বেগমের দিকে এগিয়ে দিলো, "আম্মা এটা আপনার জন্য।"

জাবেদা বেগম জানালার বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ওর দিকে তাকালেন। ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞাসা করলেন, "কী আছে এইডাতে?"

এমন প্রশ্নে মুচকি হাসল রুহানি। ব্যাগের চেইনটা খুলে দিলো, "নিজেই দেখে নিন আম্মা।"

ব্যাগের দিকে তাকাতেই নয়ন জোড়া বড়ো বড়ো হয়ে গেল জাবেদা বেগমের। তা কপালে উঠে গেছে ইতোমধ্যে। ফ্যালফ্যাল করে ব্যাগের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ব্যাগ ভর্তি টাকা আর টাকা। নিজেকে সামলিয়ে হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে জানতে চাইলেন, "এইডা মোর?"

"জি, আম্মা সবটা আপনার।"

রুহানির মুখ নিঃসৃত কথাটা কর্ণগোচর হতেই জাবেদা বেগমের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। ব্যাগটা একপ্রকার কেড়ে নিজের হাতে নিয়ে নিলেন। ওটা নাসারন্ধ্রের নিকট এগিয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিলেন। টাকার মিষ্টি সুবাসে বুকটা জুড়িয়ে গেল ওনার। প্রাণোচ্ছল হেসে রুহানির উদ্দেশ্যে বললেন, "মোর সোনা বউমা। যাও, তুমার ঘরে যাও। মুই তুমাগের খাওনের ব্যবস্থা করি। চিন্তা করিও না। মুই আছি তো। তুমি মন দিয়া সংসারডা করো।"

"আচ্ছা আম্মা।" রুহানি হেসে জবাব দিলো। জাবেদা বেগমের মুখের হাসিও প্রসারিত হলো। হায়রে টাকা! টাকার কাছে মানুষের বিবেক, সততা সবটা তুচ্ছ। দিব্যি টাকা দিয়ে সবটা কিনে নেওয়া যায়। আমরা মানুষেরা সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও যেন পশুর থেকে নিম্ন স্তরে নেমে এসেছি। নিজেদের মর্যাদা ধরে রাখতে অপারগ আমরা‌।

••••••••••

দিনের আলো নিভেছে। আকাশে পূর্ণিমার গোল চাঁদ মৃদু আলো ছড়াচ্ছে ধরিত্রীর বুকে। সুমিষ্ট আলোয় সজ্জিত প্রকৃতি। ঝলমল করছে চারপাশের সবকিছু। ওরা যেন উৎসবের আমেজে মজেছে। চিত্রলেখার শরীর বিষিয়ে তোলা যাতনা ওদের ছুঁতে পারেনি। চিত্রলেখারা তবে কি এতোটাই তুচ্ছ? উঁহু, মোটেও না। 

ঘরের এককোণে মাদুরের উপরে একভাবে পড়ে আছে চিত্রলেখা। সেই যে বিকালে এসে শুয়েছে আর ওঠেনি। দুচোখ মেলে দেখেনি পৃথিবীর আলো। পরিবর্তন করেনি পরিধেয় কাপড়।হারিকেন অবধি জ্বালানো হয়নি। ঘরটা অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে আছে। যদিও জানালার ফাঁক গলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে চন্দ্রের ভুবন ভোলানো মিষ্টি আলো। আশ্চর্যজনকভাবে মেয়েটা এখনো একটুও কাঁদেনি। এতো কঠিন মনের কবে হলো চিত্রলেখা? একদিনের কয়েকটা ঘন্টা এতো বড়ো করে দিলো মেয়েটাকে? কী আশ্চর্য!

অকস্মাৎ ঘরের দরজায় টোকা পড়ার শব্দে চিত্রলেখা ঈষৎ নড়েচড়ে উঠল। ওপাশ থেকে ভাসমান হলো কাব্যতার নরম গলা, "কোকিলা ও কোকিলা? দরজাডা একটু খোল দেখি। দ্যাখ তোর কাব্য আপা আইয়াছে।"

চিত্রলেখার ওঠার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা না থাকলেও উঠল। কারণ একটাই ওর কাব্য আপা। অন্য কেউ হলে কখনোই উঠত না। শরীর খানা ব্যথায় জর্জরিত। আবার বোধহয় জ্বরে পড়বে। আর চোখ ঝাপসা করা মাথা যন্ত্রণা তো আছেই। তখন সেই আঘাতপ্রাপ্ত স্থানটা সেভাবেই আছে। আর হাত পড়েনি সেখানে। এই কয়েক ঘন্টাতে যন্ত্রণা যেন কয়েকগুণ বেড়েছে‌। চিত্রলেখা কোনোরকমে উঠে যেয়ে দরজা খুলে দিলো। কোনো কথা না বলেই ফিরে এসে আগের জায়গায় বসল। কাব্যতা দরজা ভেতর থেকে লাগিয়ে দিয়ে এসে ওর ডান পাশটাই গা ঘেঁষে বসে পড়ল। নিজের হাতের হারিকেনটা সামনে রাখল। অমনি হারিকেনের মৃদু নিয়ন আলোয় বন্ধ ঘরের চারপাশ আলোকিত হয়ে গেল।কাব্যতা দৃষ্টিপাত করল চিত্রলেখার আননে। বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল ওর। ওই নিষ্পাপ পান্ডুর বর্ণের মুখের দিকে তাকানো দায়। কপালের একপাশ ফুলে বালিশ হয়ে আছে। কাটা স্থানটা চিরে হা হয়ে গেছে। কাব্যতা ওড়নার একাংশ হাতে উঠিয়ে গিঁট খুলে একটা মলম বের করল। আস্তে করে ডাকল,

"কোকিলা, শরীরডা খুব খারাপ লাগছেনি?"

চিত্রলেখা আপার করা প্রশ্ন শুনল। মাথা নেড়ে না বোঝাল কিন্তু মাটির দিকে নিবিষ্ট দৃষ্টি তুলে তাকাল না। কাব্যতার কেমন দম বন্ধ লাগছে। ওর কোকিলার এই অবস্থা ও একদমই সহ্য করতে পারছে না। মলমের ছিপি টা খুলে হাতে একটু লাগিয়ে নিলো। সেটা কপালে ছোঁয়াতেই আঁতকে উঠল কাব্যতা, "কোকিলা! তোর গা ডা যে জ্বরে পুইড়া যাইতাছে। নিজেরে এতো অবহেলা কির লাইগা করতাছছ? তুই কি এতডাই ফেলনা?"

এতক্ষণে চোখ তুলে কাব্যতার দিকে তাকাল চিত্রলেখা। চাহনি মৃত। নেই কোনো প্রাণ, নেই কোনো অর্থ। আছে কেবল এক বুক নিঃশব্দের হাহাকার। মুচকি একটা হাসি দিলো চিত্রলেখা, 

"কালা মাইয়ারা ফেলনাই আপা। যখন যে চায় ব্যবহার করবার পারে। আবার মন চাইলে ছুইড়া ফেইলা দিবার ও পারে। আপা আজ যদি মোর গায়ের রঙ ফর্সা হয়তো শহুরে বাবু মোরে ছাইড়া যাইতো না তাই না? কিন্তু বিশ্বাস করো এতে তো মোর হাত লাই। মোর আল্লাহ বানাইছে মোরে। আমি কী করবার পারি? মোর ক্ষমতা থাকলি মুই নিজেরে পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দরী বানাইয়া লইতাম। ও আপা তখন কি শহুরে বাবু মোরে ভালাবাসত? কালা মাইয়াদের কপাল সবসময় কালাই কেন হয় আপা?"

একদমে কথাগুলো বলে থামল চিত্রলেখা। কণ্ঠস্বর সিক্ত, ম্রিয়মাণ শোনাল। হাঁপাচ্ছে মেয়েটা। জ্বরের প্রকোপ যে অত্যধিক বেশি সেটা এখন অনুভব করা যাচ্ছে। কাব্যতার হাত থেমে গেছে অনেক আগেই। চোখের কার্নিশ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। শক্ত মনের কাব্যতা আজ কথায় কথায় কাঁদছে অথচ নরম মনের চিত্রলেখার চোখে পানির অস্তিত্ব নেই। অন্তরের মতো নয়ন দুটোই যেন খরায় ফেটে চৌচির। সেখানে পানির স্বল্পতা বিদ্যমান। কাব্যতা বিষন্ন কণ্ঠে বলল,

"আল্লাহর সৃষ্টি কখনু খারাপ হয়বার পারে লাই কোকিলা। ওগোর মন কালা। তুই কালা না। তুই মোর স্নিগ্ধ পরী। যার রুপে নেই কোনো রঙ। আছে শুধু একবুক মুগ্ধতা। মুই তোরে কথা দিচ্ছি কোকিলা ওগোর কালা মনডা আমি ধলা কইরা ছাড়ুম।"

"আপা, ও আপা মোর বুকডা জ্বইলা যাইতাছে। মুই ভুল মানুষরে লইয়া ভুল স্বপ্ন দেখবার আছিলাম। একডা সুন্দর জীবন পার করবার চাইয়াছিলাম। মুই এইসব দেখবার পারতাছি না আপা। এর আগে মোর মরণ ক্যান হইলো না? মার মতো পুড়া ভাইগ্য মোর ক্যান হইলো? তবে কি মোর ভবিতব্য ওইডাই আপা?"

কাব্যতা আর কিছু বলতে পারল না। ফুঁপিয়ে উঠল। বুকের মাঝে জড়িয়ে নিলো সর্বহারা অভাগীকে। চুলের ভাঁজে অধর ছুঁয়ে আশ্বস্ত করল, "সব ঠিক হইয়া যাইবো গা। মুই সবসময় তোর পাশে আছি কোকিলা। এর শেষ মুই দেইখ্যা ছাড়মু।"

চিত্রলেখার ঝাঁপসা আঁখি যুগল বুজে এসেছে ততক্ষণে। আপার বুকের সাথে আরেকটু মিশে গেল মেয়েটা। অস্ফুট স্বরে আওড়াল,

"কিচ্ছু ঠিক হইবার না আপা। চিত্রলেখারা জন্ম দুঃখিনী হয়। ওগোর জন্মই হয় এ পৃথিবীতে সকলের লাথি উস্টা খাওয়ার লাইগা। ওরা চাইলেও একডা সুন্দর জীবন কাটাইতে পারে লাই। চিত্রলেখাদের মরণ ব্যতীত ওগোর সমস্যার সমাধান হয় লাই আপা। মুই মুক্তি চাই আপা। ভালোবাসার মানুষরে মুই অন্য মাইয়ার লগে দেখবার পারুম না। তুমি মোরে মুক্তি দাও। মানুষ ষাট সত্তর বছর ক্যামনে বাঁচে আপা? মুই তো আঠারোতেই হাঁপিয়ে গেলাম।"

শেষের দিকে কণ্ঠস্বরটা নিস্তেজ হয়ে এলো। ব্যস তারপর সব চুপ। আগের মতোই নিস্তব্ধতায় মুড়িয়ে রইল ঘরখানা। কাব্যতা ওকে বুকে জড়িয়ে চিৎকার দিয়ে তারাকে ডাকল। পরপরই শোনা গেল ঘরের বাইরে মানুষের পায়ের ধুপধাপ শব্দ।
·
·
·
চলবে………………………………………

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp