“কিরে তুই বাসায় যাবি না? এখনও ল্যাপটপে মুখ গুঁজে আছিস যে?”
কিনজা ল্যাপটপের দিকে চোখ রেখেই বলল,
“তোরা যা, আমি একটু পর বের হচ্ছি।”
“একসাথেই যাই?”
“না তার দরকার নেই। তুই চলে যা।”
“আচ্ছা, সাবধানে বাসায় ফিরিস। গিয়ে আমাকে কল দিস।”
“ঠিক আছে।”
সবার সাথে রূপন্তিও চলে যায়। মিনিট দশেক পর কিনজা উঠে দাঁড়াল। নিজের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অফিস থেকে। কিন্তু এ কি! বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে প্রচুর। বৃষ্টির কারণে এদিকটায় কোনো গাড়ির দেখাও পাওয়া যাচ্ছে না। কিনজা হতাশ মনে রাস্তার এক ধারে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ পর সেদিক দিয়ে রাইয়ান গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় কিনজাকে ঝড়বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে গাড়ি থামিয়ে জানালার কাঁচ নামিয়ে কিনজাকে জিজ্ঞেস করল,
“বাসায় যাওয়ার জন্য গাড়ি পাচ্ছেন না?”
“না স্যার। কিন্তু পেয়ে যাব সমস্যা নেই।”
“আপনি চাইলে আমি আপনাকে বাসায় পৌঁছে দিতে পারি।”
কিনজা তৎক্ষনাৎ সেই প্রস্তাব নাকচ করে বলল,
“তার প্রয়োজন নেই স্যার। আমি আমার মতো করে চলে যেতে পারব।”
“এখন কিন্তু কোনো গাড়ি পাবেন না। কাল রিপোর্ট সাবমিট করতে হবে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অহেতুক সময় নষ্ট করার কী দরকার?”
কিনজা এবার ভাবল,
“সত্যিই তো অনেক কাজ বাকি। হাতে বেশি সময়ও নেই।”
এসব ভাবতে ভাবতে সে নিজের মত পরিবর্তন করে বলল,
“আমি যাব।”
রাইয়ান গাড়ির দরজা খুলে দিলে কিনজা গাড়িতে উঠে বসল। তারপর রাইয়ান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল,
“আপনার বাসা কোথায়?”
“খিলগাঁও, তালতলার ওদিকে।”
“ফ্যামিলির সাথে থাকেন না কি একাই?”
ফ্যামিলির কথা শুনে কিনজা মন খারাপ করে বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে বলল,
“একাই থাকি।”
এরপর আর বিশেষ কথা হলো না তাদের মাঝে। কিনজা বাসার রাস্তা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য শুধু টুকটাক কথা বলল। এর বেশি কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বের হলো না। গাড়ি বাসার সামনে এসে থামলে কিনজা গাড়ি থেকে নেমে রাইয়ানকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ স্যার।”
রাইয়ান সৌজন্যমূলক একটা হাসি দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। কিনজা বাসায় ঢুকে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিল আগে। বৃষ্টিতে বেশ অনেকটাই ভিজে গিয়েছিল সে। ফ্রেশ হয়ে এসে এক মগ কফি বানিয়ে সে বসে পড়ল জানালার ধারে। বেশ জোরেসোরেই বৃষ্টি হচ্ছে। কিনজার হঠাৎ মনে পড়ল রূপন্তির কথা। সাথে সাথে সে রূপন্তিকে টেক্সট করে জানিয়ে দিল সে বাসায় পৌঁছেছে। অতঃপর সে ল্যাপটপ নিয়ে কাজে লেগে পড়ল।
কাজ করতে করতে রাতের খাবার খাওয়ার সময় হয়ে যায়। কিনজা ল্যাপটপ রেখে রান্নাঘরে চলে যায় খাবার বানানোর জন্য। বৃষ্টির দিন ওয়েদার ডিমান্ড বলে একটা কথা আছে। সুতরাং আজ খিচুড়ি বানাতে হবে। এমনিতেও খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা কিনজার অনেক পছন্দের খাবার। যেই ভাবা সেই কাজ। কিনজা নিজের মতো করে সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে রান্না করতে শুরু করে।
এক কামরার একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট। ঘরের সাথে লাগোয়া ওয়াশরুম আর একটা ছোট্ট রান্নাঘর। সাথে একটা বেলকনিও আছে অবশ্য। কিনজা যেহেতু একা থাকে তাই তার জন্য এটুকু জায়গায় যথেষ্ট। দ্বিতীয় তলায় তার ঘরটা। পাশে আরো দু'টো মেয়ে থাকে। তারাও একাই থাকে। তবে তাদের সাথে কিনজার খুব একটা কথা হয়নি।
রান্নাবান্না শেষে খাওয়াদাওয়া করে কিনজা আবার কাজে লেগে পড়ে। কিন্তু সারাক্ষণ তো কাজের মাঝে ডুবে থাকলে চলবে না। ঘুমাতেও হবে। তাই মোটামুটি সব কাজ গুছিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকাল সকাল কিনজার ঘুম ভাঙে রূপন্তির কল পেয়ে।
“ঘুম থেকে উঠেছিস?”
কিনজা হাই তুলতে তুলতে জবাব দিল,
“এই মাত্র উঠলাম।”
“কাজ কদ্দূর এগোলো?”
“মোটামুটি কাজ শেষ। রিপোর্ট তৈরি করে ফেলেছি। তোর কী অবস্থা?”
“কিছু ক্লু পেয়েছি।”
“আচ্ছা অফিসে আয়। তারপর কথা হবে।”
“ওকে রাখছি তাহলে।”
কথা বলা শেষে কিনজা ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা বানিয়ে নেয়। ব্রেড টোস্ট, একটা ডিম পোচ আর এক মগ ব্ল্যাক কফি। এই হলো তার সকালের নাস্তা। নাস্তা খেয়ে তৈরি হয়ে সে বেরিয়ে পড়ে অফিসের উদ্দেশ্যে।
অফিসে ঢুকে কিনজা তার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। অবশেষে আজ সে তিন মিনিট আগে পৌঁছাতে পেরেছে। এটা ভেবেই তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তাকে সময়ের আগে পৌঁছাতে দেখে বাকি সবাই অবাক হয়ে বলে,
“আজ তাড়াতাড়ি এলে কীভাবে?”
কিনজা খুশিমনে জবাব দেয়,
“স্যারের বকা খাওয়া থেকে আল্লাহ বাঁচিয়ে নিল আমায়।”
রূপন্তি কিনজার কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলে,
“রাইয়ান স্যার এখনো আসেনি। এসে তোকে দেখে অবাক হয়ে যাবে দেখিস।”
তখনই অফিসে রাইয়ান প্রবেশ করে। সবাই তাকে গুড মর্নিং বললে সে পাল্টা গুড মর্নিং বলে একবার কিনজার দিকে তাকিয়ে চলে যায়। তার চোখেমুখে অবাক হওয়ার কোনো ছাপ নেই। তা দেখে মহুয়া বলে ওঠে,
“স্যারের ব্যাপারটা আমি বুঝি না। তার মধ্যে এক্সপ্রেশনের ঘাটতি আছে ভাই।”
কিনজা সেই কথায় পাত্তা না দিয়ে বলে,
“একটু পর রিপোর্টিং টাইম। সবাই সবার কাজগুলো দেখে নাও।”
মিনিট দশেক পর রাইয়ান সবাইকে তার রুমে ডেকে নেয়। তারপর বলে,
“আপনাদের সবার রিপোর্ট তৈরি করা ডান?”
“জি স্যার।”
“এক এক করে সবার রিপোর্ট সাবমিট করুন তাহলে।”
সবাই রিপোর্ট সাবমিট করার সময় নিজেদের মতো করে সবকিছু বর্ণনা করে। কে কী ক্লু পেয়েছে সবকিছু বলে। সর্বশেষ কিনজা তার রিপোর্ট সাবমিট করে। এবং বলে,
“আমি পুরো কেসটা স্টাডি করার সময় বেশকিছু বিষয় খেয়াল করেছি। যে মেয়েরা মিসিং হয়েছে তাদের মাঝে শুধু বয়সের মিল নেই। বরং তাদের পড়াশোনা এবং আচরণেও মিল আছে। যেমন সবাই ইন্টার পড়ুয়া কিংবা অ্যাডমিশন ক্যান্ডিডেট। এবং এরা সবাই গ্রাম থেকে শহরে পড়তে আসা মেয়ে। এটুকু তো বাকিরাও বলেছে। তবে এখানে উল্লেখযোগ্য আরো একটি বিষয় হলো এরা সবাই একই কোচিংয়ের আলাদা আলাদা ব্রাঞ্চ এর স্টুডেন্ট।”
রাইয়ান গ্লোব ঘোরাতে ঘোরাতে জিজ্ঞেস করে,
“কোন কোচিং?”
“ব্রাইট স্টার একাডেমিক এবং অ্যাডমিশন কেয়ার।”
“এটা তো অনেক স্বনামধন্য একটা কোচিং সেন্টার। ঢাকার বেশ কিছু জায়গায় এই কোচিংয়ের ব্রাঞ্চ আছে।”
রাকিনের কথার প্রত্যুত্তোরে কিনজা বলে,
“হ্যা যে যে এলাকায় এই কোচিংয়ের ব্রাঞ্চ আছে সেখান থেকেই মেয়েরা মিসিং। এবং প্রত্যেকেই শহরে একা থাকত। অর্থাৎ হোস্টেলে থাকা মেয়েরাই এদের টার্গেট।”
সবার কথা শুনে রাইয়ান বলে ওঠে,
“আমি অফিসে আসার আগে মিস্টার সজীব ভূঁইয়ার সাথে দেখা করেছি। তার ভাষ্যমতে মিসিং হওয়া মেয়েদের পরিবার থেকে শুরু করে কলেজ, কোচিং কোথাও কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি। কেউ জানে না তারা কীভাবে গায়েব হয়েছে। তবে এদের মধ্যে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো মিসিং হওয়ার দিন সবাই বেশ সেজেগুজে কারোর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে বের হয়েছিল। কিন্তু কার সাথে দেখা করার জন্য বের হয়েছিল সেই খোঁজ পাওয়া যায়নি।”
“স্যার আমরা ওই মেয়েদের কল রেকর্ড চেইক করে কোনো ক্লু পেতে পারি।”
রূপন্তির কথা শুনে রাইয়ান বলে,
“আমি অলরেডি তাদের কল রেকর্ডের লিস্ট চেয়ে পাঠিয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেসব চলে আসবে।”
“এরপর আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে?”
কিনজার প্রশ্নের উত্তরে রাইয়ান বলে ওঠে,
“আমরা প্রথমে মিসিং হওয়া মেয়েদের হোস্টেলে যাব। সেখানকার বাকি মেয়েদের সাথে কথা বলব। এরপর কোচিংয়ের বিষয়টা দেখতে হবে।”
“ওকে স্যার।”
একটু পর কল রেকর্ডের ডিটেইলস চলে আসে। সবাই ভালো করে সবকিছু চেইক করে দেখে প্রত্যেকেই মিসং হওয়ার আগে একটা নাম্বারে নিয়মিত কথা বলেছে। তবে সবার লিস্টে পাওয়া নাম্বারগুলো এক নয়। নাম্বার আলাদা আলাদা তবে ঘটনা এক৷ বিষয়টা সন্দেহজনক।
রাইয়ান সবগুলো নাম্বার নোট করে বলে,
“এই নাম্বারগুলো কার কার নামে রেজিস্ট্রার করা সেটা আমাদের জানতে হবে।”
“স্যার হতেও তো পারে নাম্বারগুলো ভুয়া ডিটেইলস দিয়ে নেওয়া। কারণ অপরাধীরা নিজেদের এনআইডি দিয়ে নাম্বার কেনার মতো বোকামি করবে বলে মনে হয় না।”
“মিস কিনজা হতে পারে আপনার ধারণা ঠিক। কিন্তু সবকিছু যাচাই না করে আমরা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারব না।”
“ইয়েস স্যার।”
“এখন আমাদের কাজ হলো মেয়েগুলোর হোস্টেলে গিয়ে খোঁজ নেওয়া। আমরা একসাথে যাব না। আলাদা আলাদা করে খোঁজ নিতে হবে। যেহেতু অনেকগুলো জায়গায় আমাদের যেতে হবে। দু'জন দু'জন করে বেরিয়ে পড়ুন আপনারা। আর মিস কিনজা আপনি আমার সাথে চলুন।”
“ওকে স্যার।”
গাড়িতে ওঠার সময় কিনজা সামনের সিটে বসতে ইতঃস্তত বোধ করলে রাইয়ান বলে ওঠে,
“গতকাল তো সামনে বসেছিলেন। আজ কী সমস্যা?”
“কাল তো রাস্তায় খুব বেশি মানুষ ছিল না। কিন্তু আজ…”
“রাস্তার মানুষজন নিশ্চয়ই নিজেদের কাজ ছেড়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে না। আর তাছাড়া আমি আপনার ড্রাইভার নই যে আপনি পেছনে বসবেন। আর আমি সামনে বসে গাড়ি ড্রাইভ করব।”
কিনজা আর কী বলবে ভেবে না পেয়ে অবশেষে সামনের সিটেই বসে পড়ে।
·
·
·
চলবে……………………………………………………