চিত্রলেখার সংসার - পর্ব ০৭ - ইসরাত তন্বী - ধারাবাহিক গল্প


          দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। চারপাশ মুখরিত করে ভেসে আসছে পাখিদের সুমিষ্ট গুঞ্জন। দিনের সূচনার আভাস দিয়ে চলেছে মানুষের নিকট। রাতভোর দুচোখের পাতা মিলিত হয়নি চিত্রলেখার। মাত্রাতিরিক্ত জ্বরের দরুন গত রাতে মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে বসেছিল। যখন চোখ খুলেছিল তখন চোখের সামনে কাব্যতা ছাড়াও জাবেদা বেগম এবং তারার উপস্থিতি ছিল। চিত্রলেখাকে আশ্চর্য করে দিয়ে তারা নিজ হাতে খাবার এনে খাইয়ে দিয়েছিল। যদিও এক আধবারের বেশি মুখে নেয় নি মেয়েটা। কাব্য আপার ধমক খেয়ে অতটুকুই মুখে তুলেছিল। অতঃপর তারা ঔষধ খাইয়ে দিয়েছিল। এত কিছুতেও নির্লিপ্ত ছিলেন জাবেদা বেগম। সবটা চিত্রলেখা লক্ষ্য করতেই অধরে উঁকি দিয়েছিল কেবল তাচ্ছিল্যতার হাসি। হায়রে নিমকহারাম মানুষ!

মাথা যন্ত্রণাটা খানিকটা কমেছে চিত্রলেখার। রাতে কাব্যতা মলম লাগিয়ে দিয়ে তারপর গেছিল। চিত্রলেখা এইসব নিয়ে আর ভাবল না। এখন ওকে শক্ত থাকতে হবে। চিত্রলেখা এখন মাঝনদীতে। সাতার জানে না বিধায় আত্মরক্ষার যুদ্ধটা বেশ কঠিন ওর জন্য। তবে ও এত সহজে হার মানবে না। ও দেখতে চায় জীবন ঠিক কতটা খেলতে পারে ওকে নিয়ে। ধৈর্য ওর বেশি নাকি জীবনের। চিত্রলেখা নিজের জন্য লড়বে। কেবল নিজের জন্য। ওর ইহজগতে আল্লাহ ব্যতীত কেউ নেই। আর যার আল্লাহ আছে তার কাউকে প্রয়োজন পড়ে না। মেয়ে হয়ে জন্মেছে যখন তখন বাস্তবতার জাঁতাকলে পিষ্ট তো হতে হবেই। 

চিত্রলেখার চোখ মুখ ফুলে টসটসে হয়ে আছে। লোচন দ্বয় একটু বেশিই রক্তাভ দেখাচ্ছে। এখন গায়ে খুব বেশি জ্বর না থাকলেও একদম সেরেও যায়নি। ফজরের নামাজের পর আর মাদুরে শরীর এলিয়ে দেয়নি মেয়েটা। জানালার ধারে বসে এতক্ষণ সময় কাটিয়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলগোছে উঠে দাঁড়াল। হাতের কাজ সব পড়ে আছে। ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোল। কলসি থেকে একটা বাটিতে পানি ঢালল। মুখমণ্ডলে পানির ঝাপটা দিলো। নিজেকে সতেজ করার সামান্য প্রয়াস মাত্র। বাটিটা যথাস্থানে রেখে শাড়ির আঁচল উঠিয়ে সন্তর্পণে মুখটা মুছে নিলো। অতঃপর ঝাড়ু হাতে বাড়ির আঙ্গিনা পরিষ্কার করতে উদ্যত হলো। 

সাহিলের ঘরের নিকট যেতেই ভেতর থেকে হাসির মৃদু আওয়াজ ভেসে এলো। দুইজন সম্ভবত কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে আর হাসছে। চিত্রলেখার বুকের মধ্যিখানে চিনচিন করে উঠল। ঝাড়ুটা একহাতে ধরে অপরহাতের সাহায্যে বুকের একপাশে চেপে ধরল। না এই ব্যথা কমার নয়। ক্রমশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। চিত্রলেখা ওখান থেকে সরে যেতে নিবে তক্ষুনি শব্দ তুলে ঘরের দরজাটা খুলে খেল। চিত্রলেখা ওদিকে তাকাতেই সাহিলের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা চোখের পর্দায় ভাসল। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল মেয়েটা। ওর চেনা পরিচিত শহুরে বাবুকে কোত্থাও খুঁজে পেল না। খুঁজে পেল কেবল এক নির্লজ্জ বিশ্বাসঘাতককে। যে বেইমানি করেও দিব্যি হেসে খেলে বেড়াতে জানে। নেত্র ভর্তি জল নিয়েই মুচকি হাসল চিত্রলেখা। উল্টো ঘুরে ওখান থেকে সরে যেতে চাইল। 

"চৈত্র?"

সেই পুরোনো চিরচেনা সম্বোধনে পদ যুগল আপনা আপনিই থেমে গেল চিত্রলেখার। এই নামে আর যে কেউ ওকে ডাকে না। বড্ড আদুরে এই সম্বোধন। পিছু ফিরল চিত্রলেখা। কিন্তু মুখে কিছুই বলল না। সাহিল ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওর মুখোমুখি দাঁড়াল। হাসল মিষ্টি করে, "কেমন আছ?"

ভীষণ হাসি পেল চিত্রলেখার। মানুষটা এত্ত বাজেভাবে ওকে ঠকিয়ে আবার জানতে চাইছে কেমন আছে? চৈত্র তুমি জীবন্ত লাশ‌ হয়ে গেছ নাকি সেটা হওয়ার পথে। প্রশ্নটা এমন হলে বোধহয় মানানসই হতো‌। চিত্রলেখার বোকা শহুরে বাবু। উঁহু, উনি মোটেও বোকা নয়। বোকা ফুল তো চিত্রলেখা নিজেই। সবসময়ের মতো নরম কন্ঠেই জবাব দিলো চিত্রলেখা, "আলহামদুলিল্লাহ, মোর আল্লাহ মোরে ভালা রাইখাছে।"

উত্তরটা বোধহয় সাহিলের ঠিক হজম হলো না। সেটা চিত্রলেখা নিজেও বুঝল। সাহিল ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল, "সত্যিই ভালো আছ?"

"ক্যান আপনে চান না মুই ভালা থাকি?"

এই পর্যায়ে সাহিল একটু অবাক হলো বৈকি। কালকে রাত অবধি যেই মেয়ে শোকে পাগল প্রায় সেই মেয়ে এখন স্বাভাবিক ভাবেই বলছে ভালো আছে। যদিও ফ্যাকাসে আনন অন্য কথা বলছে। সেটা সাক্ষী দিচ্ছে অন্যকিছুর। 

"আমি সবসময় চাই তুমি ভালো থাকো চৈত্র।"

"আপনে মোর ভালা চান অথচ মোরে চান না। এত ভালা যে মোর ভাগ্যে সইবে লাই।"

সাহিল এবার অবাকের শীর্ষে।‌ কী অদ্ভুত কথাবার্তা বলছে মেয়েটা। পাগল টাগল হলো‌ নাকি? অবশ্য এটা হলেই ষোলো কলা পূর্ণ হবে। আরও একটা বিষয় প্রথম থেকেই খেয়াল করছে ছেলেটা। আজ কথার মাঝে একটাবারও শহুরে বাবু শব্দটা উচ্চারণ করেনি চিত্রলেখা। অথচ বিয়ের পরে এই বলে ডেকে ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলত। যদিও সময়টা খুবই কম ছিল। কয়েকদিন মাত্র। কিছু সময় পেরোতেই চিত্রলেখার উদ্দেশ্যে ভরাট গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এলো,

"তোমাকে আমি ছেড়ে দেইনি চৈত্র। এখনো আমার বাড়িতেই আছ তুমি। এটা ভুলে যেও না।"

"আপনের মনডার কোথাও রইয়াছি কি?"

প্রশ্নটা ছুঁড়তেই সাহিলকে একটু ভাবুক দেখাল। হয়তো কিঞ্চিত দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। তবে প্রাপ্ত উত্তরটা চিত্রলেখাকে আরও একবার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো। এটা অপ্রত্যাশিত ছিল ওর জন্য। তবে আজকাল সবকিছু একটু বেশিই চমক দিচ্ছে ওকে। কেবল ওর বদহজম না হলেই হলো। 

"মনে থাকার খুব কি প্রয়োজন চৈত্র? বিয়ে করে বউয়ের মর্যাদাও তো দিয়েছি। তোমার শরীরের প্রতিটা লোমকূপে আমার স্পর্শ আছে। ভালোবাসার সাক্ষী হিসেবে না থাকলেও আমাদের মিলেমিশে একাকার হওয়ার সাক্ষী ওগুলো। এই যে এখনো আমার বাড়িতে থাকতে পারছ এইবা কম কিসে?"

চিত্রলেখার শরীরের প্রতিটা শিরা উপশিরা শিরশির করে উঠল। মানসপটে ভাসল একটা গভীর রজনী। কিছু সুন্দর সুখকর মুহূর্ত। পরক্ষণেই বর্তমান স্মরণ হলো। তিক্ততায় ছেয়ে গেল চারপাশ। ‌মন মস্তিষ্ক শূন্য অনুভূত হলো মেয়েটার। কণ্ঠনালী শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। বড্ড পানির পিপাসা পেলো। খুব কষ্টে উচ্চারণ করল একটা বাক্য, "কিন্তু কাজডা তো কাপুরুষের মতো কইরাছেন।"

এই পর্যায়ে পুরুষালী মুখটা থমথমে হয়ে উঠল। কথাটা আত্মসম্মানে তীব্র আঘাত হানল। চিত্রলেখার স্পর্ধা দেখে আজ কেবল অবাকই হচ্ছে সাহিল। যেই মেয়ে কখনো চোখে চোখ রাখার সাহস পায়নি আর আজ সে ওকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছে। রক্তচক্ষু দিয়ে তাকিয়ে রইল চিত্রলেখার দিকে। পর মুহূর্তেই ওষ্ঠপুটে দৃশ্যমান হলো কপট হাসি,

"আমার বোবা পাখির মুখে কথা ফুটেছে দেখছি।"

এই 'আমার' সম্বোধন শক্ত খোলসে মোড়ানো চিত্রলেখাকে ক্ষণিকের মধ্যেই ভেতর থেকে ভেঙে চুরমার করে দিলো। তবুও নিজেকে সামলিয়ে নিলো মেয়েটা। সাহিল এখনো কোন অধিকারে চিত্রলেখাকে নিজের বলে দাবি করছে সেটার উত্তর ওর অজানা। মায়ের বলা একটা কথা মনে পড়ল চিত্রলেখার। "মাইয়ারা দুক্কু প্রকাশ করিলে উপহাসের পাত্রি হয় চিত্রলেখা। এই জগৎ কয় মাইয়াগো কুনু দুক্কু থাকিতে পারে লাই। থাকিলেও তা মনের এক কুনায় নীরবে রয়। ওগুলা প্রকাশ করবার অধিকার মাইয়াগোর লাই।" 

মায়ের বলা কথাটা চিত্রলেখার মস্তিষ্কে জেঁকে বসল। ওর মাঝে বেশ পরিবর্তন ঘটাল। ও হেসে বলল, "মোর হাতে মেলা কাজ কাম রইয়াছে। মুই যাইগা।"

"দাঁড়াও চৈত্র তোমার সাথে আমার কথা আছে।"

আবার কী বলবে মানুষটা? চিত্রলেখাকে নিঃশেষ করার জন্য আরও কিছু বাকি রয়ে গেছে কি?ওর কপালে কিঞ্চিত ভাঁজের সৃষ্টি হলো, "আইচ্ছা কন।"

"তিন দিন সময় আছে তোমার হাতে। কারণ আমি তিন দিন গ্রামে থাকব। ভেবে দেখবে আমার সাথে সম্পর্কের বন্ধনে থাকবে নাকি মুক্তি নিবে। সিদ্ধান্ত তোমার হাতে। দীর্ঘ একটা সময় নষ্ট করে আমি তালাক নামা তৈরি করে এনেছি। টাকা, সময় দুটোই নষ্ট হয়েছে আমার।"

এমন কথায় চকিতে মাটি থেকে দৃষ্টি তুলে সামনে তাকাল চিত্রলেখা। অবিশ্বাস্য চাহনি নিবিষ্ট রইল সম্মুখে দাঁড়ানো সুদর্শন মানুষটার দিকে। এতো বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিতে বুক কাঁপল না ওনার? পর মুহূর্তেই ভাবল। আশ্চর্য! ওনার বুক কেন কাঁপবে? যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে এটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। মানসিকভাবে চিত্রলেখাকে পুরোপুরি মৃ ত ঘোষণা করার জন্য এই হাতিয়ার টাই যথেষ্ট ছিল। শরীর থরথর করে কাঁপছে মেয়েটার। মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারল না। 

এতক্ষণে ঘর থেকে বেরোল রুহানি। ওদের কথার মাঝেই ওখানে উপস্থিত হলো। শরীরে জড়ানো পোশাকটা এলোমেলো। এমনকি পরিহিত টিশার্ট টা অবধি উলটো পড়া। হাতে ওর আর সাহিলের শুকনো কাপড়। এসে সাহিলের পাশে দাঁড়াল। চিত্রলেখাকে যেন দেখেও দেখল না। ভাবটা এমন যে ও আর সাহিল ব্যতীত আর কেউ নেই ওখানে। রুহানি লজ্জায় রাঙা মুখ নিয়ে আস্তে করে বলল, "গোসল দিবে না তুমি? এভাবে আর কতক্ষন থাকবে?"

চিত্রলেখা তখনো প্রাণহীন দৃষ্টিতে সাহিলের দিকে তাকিয়ে আছে। সাহিল ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল। আবার নজর ঘুরিয়ে নিলো। ঘাড় চুলকিয়ে আমতা আমতা করল, "হ্যাঁ, চলো।"

রুহানি চারপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজল, "তোমাদের ওয়াশ রুম নেই সাহিল?"

রুহানির করা প্রশ্নে সাহিল মৃদু আওয়াজে হেসে ফেলল, "এটা গ্রাম ম্যাডাম। আপনার শহর না। এখানে আপনাকে পুকুরপাড়ে গোসল করতে হবে।"

"কীহ!" একপ্রকার আঁতকে উঠল রুহানি।

"জি, ম্যাডাম। চলুন আমার সাথে।" রুহানি যাবে না। এইসব পুকুরের পানি দেখলেই ওর ভয় লাগে। সাহিল ওর হাত ধরে জোরপূর্বক টেনে নিয়ে গেল। এক পর্যায়ে দুজনেই সমস্বরে হেসে উঠল। উঠানে অসাড় হয়ে আসা শরীর টেনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা চিত্রলেখা সবটাই দেখল। পৃথিবীর সবকিছু কেমন বিষাক্ত অনুভূত হলো। নিজের প্রতি অনিহা জন্মাল। বেনামি হাওয়ায় যেন অক্সিজেনের বদলে ভেসে আসছে বিষাক্ত বিষের ঘ্রাণ। সেই বিষ ওর ভেতরের সবটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। বুকটা ভীষণ জ্বলছে। চিত্রলেখা ওখানে আর দাঁড়াতে পারল না। ভারী পা দুটো টেনে শ্লথ গতিতে ঘরে চলে গেল। 

••••••••••

তপ্ত দুপুর। চিত্রলেখা রান্না করছে। সূর্যের তাপের প্রখরতায় ঘেমে নেয়ে একাকার মেয়েটা। শাড়িটা ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে। মাঝেমধ্যে অবশ্য লুকিয়ে চুরিয়ে তারা এসে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করে যাচ্ছে। হঠাৎ মেয়েটার এই দরদ চিত্রলেখার হজম হচ্ছে না। রক্ত খারাপ এদের। আবার নিজের কোন স্বার্থের জন্য এমনটা করছে কে জানে? সকাল থেকে সাহিলের মুখনিঃসৃত তিক্ত কথাগুলো মস্তিষ্ক খুবলে খুবলে খাচ্ছে। মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরনে দাপিয়ে চলেছে। একদন্ড শান্তি পাচ্ছে না চিত্রলেখা। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে বড্ড দোটানায় পড়েছে। এর সমাধান কাব্য আপা ব্যতীত কেউ দিতে পারবে না। চিত্রলেখা ভেবেছে বিকাল নাগাদ আপার সাথে দেখা করে আসবে‌। বাবার পরিবারটা একটু সচ্ছল হলে বোধহয় এই দোটানা টা আর থাকত না। এই সংসার ভেঙে গেলে চিত্রলেখাকে কতটা উপহাস, কটু কথার সাক্ষী হতে হবে সেটা ওর নিজের অজানা নয়। তবে এইসবে মেয়েটা অভ্যস্ত। সবচেয়ে বড়ো কথা ওই বাড়িতে মা ওকে একটা সেকেন্ড ও শান্তিতে শ্বাস নিতে দিবে না। আবার কাব্য আপার বলা সেদিনের কথাটা খুব ভাবাচ্ছে ওকে। "মাইয়াগো আত্মসম্মানের উপরে কিচ্ছু লাই।" এখন কী করবে ও? কিছুই বুঝতে পারছে না। চারপাশ হাতড়েও উত্তর মিলছেনা। হাহ্ জীবন! একবারে মেরেও দিবে না আবার বাঁচার শক্তিটুকুও ক্রমশ শুষে নিবে। অভাগীদের বোধহয় এভাবেই আজীবন পুড়তে হয়। কিন্তু আফসোস দিনশেষে সবাই পোড়া কয়লাটাই দেখে। কতটা জলন্ত আগুনে নিজেকে পুড়িয়ে এমন কয়লা হয়েছে সেই গল্প শুনতে, জানতে সবাই উদাসীন। থাকে না জানার কোনো আগ্রহ। উপহাস যে মানুষের রক্তে মিশে আছে।

"চিত্রা মা?"

চিত্রলেখা যখন নিজের জীবনের ভাবনার অথৈ সায়রে বুঁদ হয়ে আছে তখন শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করে অতিব পরিচিত একটা বয়স্ক কণ্ঠস্বর। ও ভাবনা চ্যুত হলো‌। নজর তুলে সামনে তাকাল। দেখল শ্বশুর নামক মানুষটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো শহরের কাজ শেষ তাই ফিরে এসেছে। চিত্রলেখা মাথায় তোলা ঘোমটা টা দ্রুত আরও সুন্দর ভাবে ঠিকঠাক করে নিলো। মলিন মুখেই হাসল, "আব্বা ভালা আছেন? এবার জলদি ফিইরা আইলেন যে? কাজ কাম সব শেষ হইছে নি?"

"হইছে মা। তুমারে এমন দেখায় কির লাইগা? অসুস্থ নি?"

"জি, আব্বা একডু জ্বর আইছে ওই যা। এহন সুস্থ মুই‌।"

"তা তো দেখবার পারতাছি।" মানুষটাকে কেমন অসহায় দেখাল। মায়াভরা চোখে চিত্রলেখার দিকে তাকিয়ে রইল। বড্ড বুকব্যথা হয় মেয়েটার জন্য। তবে উনি সৃষ্টিকর্তার উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখেন। সৃষ্টিকর্তা মেয়েটাকে ঠিক একজীবনের সবটুকু সুখ দিবেন। একটা পবিত্র আত্মার হ ত্যা এভাবে কখনোই হতে পারে না। চিত্রলেখা বোধহয় শ্বশুরের বলা কথাটা শুনল। তবে কোনো প্রত্যুত্তর করল না। উল্টো বলল,"আব্বা ঘরে যাইয়া জিরিয়ে নিন। মুই খাবার পানি আনতাছি।"

"আগে গোসল দিমু মা। মুই পুকুরঘাটে যাইতাছি। তুমার আম্মা কই?"

"ঘরে রইয়াছে আব্বা।"

"আইচ্ছা।" তৎক্ষণাৎ ছেলের কণ্ঠ কর্ণগোচর হতেই আবাস উদ্দিন পিছু ফিরে তাকালেন। ছেলের সাথে শহুরে একজন মেয়েকে দেখতেই ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। ওনাকে দেখতেই সাহিল এগিয়ে এলো, "ভালো আছেন আব্বা?"

"আছি ভালা। মাইয়াডা কেডায় বাপজান?"

এমন প্রশ্নে সাহিলের মুখটা মিইয়ে গেল। চিত্রলেখার দিকে তাকাল। মেয়েটা ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলে গেল। রুহানি পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে মাথাটা নুইয়ে জিজ্ঞাসা করল,

"কেমন আছেন আব্বা?"

আব্বা সম্বোধনে থমকে গেলেন আব্বাস উদ্দিন। ছেলের দিকে রাগান্বিত চাহনি নিক্ষেপ করলেন, "এই মাইয়া মোরে আব্বা ডাকে ক্যান সাহিল?"

উনি একমাত্র রেগে গেলেই কলিজার টুকরো ছেলেকে নাম ধরে সম্বোধন করেন। আব্বার রাগের পারদ অনুভব করতেই সাহিল শুকনো ঢোক গিলল। আস্তে করে বলল, "আপনার বউমা।"

সাহিল মুখের কথাতে ইতি টানতেই থাপ্পড়ের বিকট শব্দে চমকে উঠল উপস্থিত সকলে। অকস্মাৎ এমনটা সবার কল্পনাতীত ছিল। চিৎকার করে উঠল রুহানি। কড়াইয়ে চলমান খুন্তিটা থেমেছে। চিত্রলেখা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। রুহানির চিৎকারের শব্দ শুনতেই ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন জাবেদা বেগম এবং তারা। দুজনের মুখাবয়ব জুড়ে ঘুমের রেশ বিদ্যমান। ঘুমিয়েছিল হয়তো। জাবেদা বেগম স্বামীকে দেখতেই হতভম্ব হয়ে গেলেন। দৃষ্টি ভাসমান হলো সকলের দিকে। ছেলেকে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ঘটনা যা বোঝার বুঝে গেলেন। আব্বাস উদ্দিন আবারও মারতে উদ্যত হতেই উনি থামিয়ে দিলেন, "থাইমা যান খুকার আব্বা।"

পরপরই ছুটে এসে ওনাকে শান্ত করার প্রয়াস চালালেন, "মাথাডা ঠান্ডা করুন। কেবল আইছেন। একটু জিরিয়ে লন। তারপর এই নিয়া মোরা কথা কমু।"

"কিসের কথা কমু মুই? এত বড়ো একডা কাম কইরাছে তুমার পোলা আর তুমি এহনো চুপ কইরা রইয়াছ। আসলে তুমার মতোই হইয়াছে তুমার পোলা। সতীন খুব পছন্দের তুমার তাই না? আইচ্ছা মুই তুমার সতীন আনবার ব্যবস্থা করতাছি। তারপর সবডা দেখমু।"

চিত্রলেখা এইসবে উদাসীন। প্রথমে একটু চমকালেও এখন নিজের কাজে ব্যস্ত। আব্বাস উদ্দিন ওর উদ্দেশ্য নরম সিক্ত কণ্ঠে বললেন, "মোরে ক্ষমা কইরা দিও চিত্রা মা। সেদিন যদি মুই টেকার লোভ কইরা তুমারে এই বাড়িত লইয়া না আনতাম তুমি বহু ভালা থাকতা। আমার করা ভুলের কুনো ক্ষমা লাই।"

আর কাউকে কোনো প্রকার টু শব্দের সুযোগ না দিয়েই উনি হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। জাবেদা বেগম চিল্লালেন, "আপনে কেবলডা আইলেন। কিচ্ছু মুখে দিয়া বাইরে যান খুকার আব্বা।"

আব্বাস উদ্দিন ওনার কথা শুনলেন কিন্তু থামলেন না। সকলের রাগ এসে জমা হলো চিত্রলেখার উপর। তিন জোড়া অগ্নিদৃষ্টি নিবদ্ধ রইল মেয়েটার দিকেই। কেবল তারাকেই খুশি দেখাল। যেন আব্বার এমন সিদ্ধান্তে ও খুশি। জাবেদা বেগম চিত্রলেখার দিকে কয়েক পা এগিয়ে এসে বিশ্রি এক গালি ছুঁড়লেন, "মা'গি'র ঝি তোর লাইগা যদি মোর সংছার ভাইঙ্গা যায়। তোরে জ্যান্ত কবর দিমু‌।"

চিত্রলেখার তরকারি ঢালা শেষ। বড়ো বাটিটা হাতে তুলে উঠে দাঁড়াল। জাবেদা বেগমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাসল মিষ্টি করে, "সতীন আইলে সংসার ভাইঙ্গা যায় না তো আম্মা। এই যে মোর তো ভাঙে লাই। তাহলে আপনের ক্যান ভাঙব? শাশুড়ি, বউমা একলগে সতীনের সংসার করমু। কষ্ট পাইবেন না আম্মা।"

কথাটা বলেই খাবার ঘরের দিকে হাঁটা ধরল চিত্রলেখা। জাবেদা বেগম কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই চিত্রলেখাকে কেমন অদ্ভুত লাগল ওনার নিকট। সাহিল দাঁত কিড়মিড় করে ওখান থেকে প্রস্থান করল। হয়তো এরপর চিত্রলেখার কপালের খারাপ টুকু আরেকটু বাড়বে। রুহানি সাহিলের পিছু ছুটল। 

তারা প্রাণোচ্ছল কণ্ঠে আওড়াল, "মাইয়া গোরে এতডা অবহেলা করতে লাই। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো যোদ্ধা একজন মাইয়া। ভাবী জিন্দাবাদ।"

জাবেদা বেগম মেয়ের দিকে তেড়ে যেতেই এক ছুটে পালাল তারা। ওনার ভেতরে অস্বস্তি বাড়তে লাগল। উনি জানেন মানুষটা রেগে কথাটা বলেছে কিন্তু পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস নেই। যদি সত্যিই রাগের বসে এমনটা করে বসে। তাহলে উনি কী করবেন? ওনার ভালোবাসার মানুষটার ভাগ অন্যকে কীভাবে দিবে? ঘরের দাওয়ায় ধপ করে বসে পড়লেন। একটা মাটির খুঁটির সাথে মাথাটা ঠেকিয়ে আঁখি যুগল বুজে নিলেন। আমরা মানুষেরা বড্ড উদ্ভট জাতের হয়ে থাকি। নিজেরা খারাপ কোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া না অবধি অন্যের সেই কষ্টটা আমাদের কাছে কেবল এক টুকরো তামাশা হয়ে রয়ে যায়।
·
·
·
চলবে………………………………………

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp