বাংলাদেশের শীর্ষ স্কিনকেয়ার ব্র্যান্ড ' অরিকা '। এই ব্র্যান্ডের ময়েশ্চারাইজার এবং সানস্ক্রিন এর ফর্মুলা, টেক্সচার এবং প্রোডাক্টের গুনাগুন অনুযায়ী সাশ্রয়ী মূল্যের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রোডাক্ট দু'টোর জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে! ট্রেন্ডিং স্কিনকেয়ার আইটেমের মধ্যে এই দু'টো প্রোডাক্ট নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। ঐন্দ্রীর বড্ড লোভ অরিকা'য় ইন্টার্নি করার। তবে তার মনে সংশয় কাজ করতো, এতো বড় স্কিনকেয়ার কোম্পানি তাকে তাদের কোম্পানিতে ইন্টার্নি করার সুযোগ আদও দেবে কি? তার সিজিপিএ হাই! ক্লাসের তুখোড় মেধাবী শিক্ষার্থী তকমাটা তার দখলে। যেখানে আর দশটা শিক্ষার্থী ৭ ডিজিট পরিমাণ অর্থ ব্যায়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে সেখানে সে এডমিশন টেস্টে তৃতীয় স্থান অর্জন করে প্রতি সেমিস্টারে ৩.৯০ এর ওপর সিজিপিএ তুলে বাকিদের তুলনায় বলা যায় ফ্রীতেই পড়ছে! এদিকে তার কিছু ক্লাসমেট তাকে জানাল, অরিকা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ মানের একটি কোম্পানি। আর দেশের ছোট থেকে বড় সকল কোম্পানিগুলোতে তাদের প্রধান চাহিদা থাকে পাবলিক ভার্সিটির স্টুডেন্ট। অরিকাও এক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম নয়। অরিকায় কর্মরত সিংহভাগ কর্মকর্তা এসেছেন পাবলিক ইউনিভার্সিটি থেকে। ইন্টার্নির ক্ষেত্রেও ইদানীং কর্তৃপক্ষ পাবলিক ভার্সিটিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। অতএব সে যেন অরিকা'য় ইন্টার্নি করার দিবাস্বপ্ন দেখা বন্ধ করে। এই কথাগুলো যথেষ্ট ছিল ঐন্দ্রীর আত্মবিশ্বাস ভেঙেচুরে দিতে। অথচ বোকা মেয়েটা বুঝলোই না তার সফলতায় জ্বলেপুড়ে নিতান্তই অবান্তর কথা শুনিয়ে দিয়েছে ওই গুটিকয়েক মানুষ গুলো।
ঐন্দ্রী যখন অরিকা'য় ইন্টার্নিশিপের জন্য আবেদন করার সিদ্ধান্ত হতে পিছু হটতে যাচ্ছিল তখন ত্রপা তাকে একচোট ধমকায়,
-" বলদ মেয়ে! প্রাইভেটে পড়িস বলে কি হয়েছে? তুই কি ফেলটু মার্কা স্টুডেন্ট নাকি যে ওরা তোকে নিবে না। চাকরি করতে গেলে যেখানে তোকে প্রথমেই নিয়ে নিতো সেখানে তুই তো করতে যাচ্ছিস ইন্টার্নি।এতো আইগুই না করে এপ্লিকেশন করে দে। নেক্সট ছুটিতে এসে যেন আমি তোকে অরিকা'য় দেখি। "
ত্রপার ধমকটা অবশ্য কাজে লেগেছিল। ও শুনেছিল ত্রপার কথা। এই পৃথিবীতে একটামাত্র মানুষ যার কথা সে মান্য করে চলার সর্বাত্নক চেষ্টা করে।ইন্টার্নিশিপের জন্য আবেদন করার তিনদিনের মাথায় পড়ন্ত বিকেলে তার কাছে ফিরতি ইমেইল এলো, যে ইমেইল লিখা ছিল তার স্বপ্ন পূরণের প্রথম ধাপটি ও ছুঁতে পেরেছে। তবে বিধাতার সৃষ্টি করা এই পৃথিবীতে আমরা যে জিনিসগুলো সহজে পেয়ে যাই কেন যেন সেসবেই যত সব ঝামেলা লুকানো থাকে। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল ঐন্দ্রীর সাথে যখন ও অরিকা'য় প্রথমবারের মতো পা ফেলল।
—————
-" কিরে ঐন্দ্রী? অফিসে যাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি নেই? এখনো আসছিস না কেন? " তাহিনা চেঁচালেন।
ঐন্দ্রী হুড়মুড়িয়ে এসে টেবিলে বসল। ৪র্থ বর্ষের ক্লাস শুরু হয়েছে কাল। সেমিস্টার শুরু হওয়ার সাথে সাথেই পুরোদস্তুর পড়াশোনা শুরু করে দিয়েছে ও। সেসব গুছিয়ে নিতে নিতেই ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে। তাইতো ভোরের পাখি ঐন্দ্রীর আজ আর ভোরবেলা দেখা মিলেনি। নাস্তার প্লেটটা আগ বাড়িয়ে নিতেই তাহিনা এসে একপ্রকার ছো মেরে তার হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে নিলেন।
-" এখন আর নাস্তা করা লাগবে না। বাহির থেকে খেয়ে নিস কিছু। খেতে বসলে দেরী হয়ে যাবে। আজকেই তো অফিসের প্রথম দিন না? কাজে লেট হয়ে যাবে, যা জলদি যা। "
ঐন্দ্রী শুকনো গলায় বলল, " আজকে অফিস না ভাইভা। আমি আপাতত প্রাথমিকভাবে সিলেক্ট হয়েছি। চূড়ান্তভাবে সিলেক্ট হব ভাইভার পর। "
-" সে যাইহোক এখন বের হ তো তুই। ঢাকার যেই জ্যাম এখন না বের হলে পৌঁছাতে পারবি না। আর বেতনের ব্যাপারে ভাল করে জিজ্ঞেস করে আসিস। "
অপমানে থমথমে হয়ে আছে ঐন্দ্রীর মুখ। ও চটজলদি সেখান থেকে উঠে গেল। বেড়িয়ে যাওয়ার আগে দেখল তার ভাগের পরোটা এবং ডিম পোচটা তাহিনা তূর্ণার পাতে তুলে দিচ্ছেন। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেড়িয়ে এলো। তার জীবনের রোজকার গল্প এটা। তাহিনার জন্য সকালের নাস্তাটা তার কখনোই করা হয়না। তিনি সবসময় নানান বাহানায় তাকে সকালে খাওয়ার সুযোগটুকু থেকে বঞ্চিত করেন।
অরিকার মেইন ব্রাঞ্চ গুলশানে। প্রথমে বাসে চড়ে এরপরে রিকশা নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাল ঐন্দ্রী। তার ভাইভা হবে এখানে। অফিসটা বাহির থেকে দেখতে চোখ ধাঁধানো সুন্দর। কাচ দিয়ে আবিষ্ট ১৬ তলা ভবন। স্টাফদের দিক নির্দেশনা মোতাবেক সে লিফটে করে ১৪ তলায় এলো। তাকে ১৬০৪ নাম্বার রুমে যেতে বলা হয়েছে। সেখানে যেতেই দেখল ওটা আসলে ওয়েটিং রুম। তার মতো আরো দশ - পনের জন ক্যান্ডিডেট ইতিমধ্যে অপেক্ষারত অবস্থায় বসে রয়েছে। সামনের দিকে বসল ও। বিগত কয়েকদিন যাবৎ ভাইভা নিয়ে না ভাবলেও চূড়ান্ত মুহূর্তে এসে তার অস্বস্তি কাজ করছে। ওর অস্বস্তি বাড়িয়ে দিতে কিছুক্ষণ পর একজন অফিসার এসে বললেন,
-" আপনাদের জন্য একটা সুখবর রয়েছে। গত দু'দিন ধরে চলা ভাইভা কেবল বোর্ড অফ ডিরেক্টর'স থেকে নেয়া হলেও আজ এই ভাইভা বোর্ডে যুক্ত হচ্ছেন স্বয়ং অরিকার ও'নার জায়িন উসমান। সো বি প্রিপেয়ার্ড ক্যান্ডিডেট'স। স্যার কিন্তু খুবই স্ট্রিক্ট একজন পারসোন। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ভুল তার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনা। "
সুখবর না ছাইঁ! অফিসার স্পষ্টত তাদের সাথে মশকরা করে গেল। রুমে অবস্থান করা সবার চোখমুখে চাপা আতঙ্ক খেলা করছে। কেও কেও তো জায়িন সম্মন্ধে ভালো জ্ঞান থাকায় আশা ছেড়ে দিয়ে বসে আছে! সবার উদ্বেগ, উৎকন্ঠা খেয়াল করে ঐন্দ্রীর চেহারা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গিয়েছে।
একে একে ক্যান্ডিডেটদের ডাক পড়তে লাগল। বের হওয়ার পর তাদের মধ্যে বেশিরভাগ ক্যান্ডিডেটের চেহারা ছিল মলিন, আশাহত। অবশেষে ঐন্দ্রীর ডাক পড়ল। সে দোয়া দরুদ পড়ে প্রবেশ করল ভাইভা রুমে।
-" মে আই কাম ইন স্যার? "
ভেতর থেকে মেয়েলি কন্ঠস্বর ভেসে এলো, " ইয়েস কাম ইন। "
ঐন্দ্রী ভেতরে ঢুকে সালাম দিল। ভাইভা নিচ্ছেন পাঁচজন। তার মধ্যে ওর নজর কাড়ল মাঝে দৃঢ়প্রত্যয়ে, মেরুদণ্ড সোজা হয়ে বসা লোকটার দিকে। তার দু'পাশে বাকি দু'জন রয়েছে। যেন রাজার দু'পাশে মন্ত্রী মহলের বাকি সদস্যরা বসে। বসার ভঙ্গি, মুখোশ্রীতে ছড়ানো দৃপ্তি দেখে ঐন্দ্রী অনুমান করলো ইনিই হচ্ছেন অরিকার ও'নার!
ঐন্দ্রীকে নিজের পরিচয় দিতে বলা হলো। পরিচয় পর্ব শেষে তাকে একাডেমিক বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্নপর্ব চালানো হলো। খুব সহজ প্রশ্ন। তবে বলতে গিয়ে সে কিছুটা অস্বস্তিবোধ করছিল কারণ না তাকিয়েও বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছে মাঝে বসা জায়িনের ধূর্ত দৃষ্টি তার পানেই নিবদ্ধ। জায়িন বাদে বাকি চার জন প্রশ্নপর্বের প্রাথমিক ধাপ শেষ করে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল জায়িনের পানে। থুতনিতে হাত রেখে চেয়ারে পিঠ এলিয়ে বসে থাকা জায়িন এবার সটান হয়ে বসল। হাতের আঙুলের মাঝে একটা পেন্সিল ঘোরাতে ঘোরাতে জলদগম্ভীর কন্ঠে শুধাল,
-" অরিকায় কাজ করার জন্য আপনি কি নিজেকে যোগ্য মনে করেন? "
ঐন্দ্রী ধীমি স্বরে জানাল,
-" জি। "
-" কেন? "
-" কারণ আমার এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান আছে। আমার রেজাল্ট, একাডেমিক পারফরম্যান্সও ভাল। "
হাতের আঙুলের ফাঁকে অনবরত ঘূর্ণায়মান পেন্সিলটাকে জায়িন ক্ষ্যান্ত দিল। কন্ঠে শীতলতা টেনে ও শুধাল,
-" ওয়েল... মিস. ঐন্দ্রীলা জামান, আপনার বাবা মুনতাসিব সাদিক যিনি কিনা একজন প্রতারক... " এতটুকু বলে থামল জায়িন। ঐন্দ্রীর মুখোশ্রীতে ফুটে ওঠা হতবিহ্বলতা এবং বিব্রতভাব দেখে ফের বলল,
-" আপনার বাবার ফ্লোরেনা প্রতিষ্ঠানটি অরিকার বিশস্ত এবং অনেক বছরের পুরনো রিটেইলার। বাংলাদেশে অরিকার প্রোডাক্টের সিংহভাগ সেল হয় ফ্লোরেনা থেকে। যেহেতু উনি বহু পুরোনো রিটেইলার তাই আমাদের ল্যাব ভিজিট করার সুযোগ পান। এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তিনি আমাদের বেস্টসেলার প্রোডাক্টগুলোর ফর্মুলেশন চুরি করার চেষ্টা করেছেন। এখন প্রশ্ন করতে পারেন এতে তার লাভ? তার লাভ হচ্ছে প্রায় ২০ কোটি টাকা! তিনি মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে ইন্ডিয়ান এক নামদামী ব্র্যান্ডের কাছে ফর্মুলেশন বিক্রি করার চুক্তি করেছিলেন। শুধু ফর্মুলেশন বিক্রিই নয় আমাদের যেই প্রোডাক্ট তাদের কাছে যেত সেই প্রোডাক্ট গুলোতে তিনি অবৈধভাবে প্যারাবেন পুশ করার ট্রাই করেছেন। তবে তিনি সফল হতে পারেননি অবশ্য। তার আগেই তিনি অরিকার ' সিকিউরিটি এন্ড এলার্ট ' টিমের কাছে ধরা পড়ে যান। ফ্লোরেনা হাইপে উঠেছিল অরিকার জন্য। কারন অরিকার প্রোডাক্ট সরাসরি ফ্লোরেনাতে সাপ্লাই করা হতো। আপনার বাবা মুনতাসিব সাদিক যে অরিকার জন্য আজ আসমানে উঠেছে সেই অরিকার সাথে প্রতারণা করেছেন তিনি। "
ঐন্দ্রী থমকাল! ফ্লোরেনাতে এতো বড় কান্ড ঘটে গেছে? কই, ফুপি তো কিছু বললেন না। ফ্লোরেনার শেয়ার হোল্ডার হিসেবে তো ফুপাও রয়েছেন। এতো বড় ঘটনা ঘটে গেল অথচ বাড়ির পরিবেশ কি শান্ত! কেও তাকে কিছু জানায়নি অব্দি। অবশ্য জানানোর কথাও না। ঐন্দ্রী ও বাড়ির একজন অদৃশ্যমান, অবহেলিত ব্যাক্তি। তাকে কোনো ব্যাপারেই কখনো কিছু জানানো হয়না। সে নিজেও আগ্রহবোধ করেনা।
ঐন্দ্রী তারস্বরে জানাল , " এসব আমাকে কেন বলছেন?"
-" আপনাকে বলছি কারণ আপনি মুনতাসিব সাদিকের মেয়ে। আপনিও যে তার মতো আমাদের সাথে এমন প্রতারণা করবেন না তার কি গ্যারান্টি? "
-" আমি মুনতাসিব সাদিকের মেয়ে নই। তিনি আমাকে কন্যা হিসেবে ত্যাজ্য করেছেন জন্মের পর। তাই তার মতো এমন জঘন্য কাজ করার প্রশ্নই আসেনা। "
পাশ থেকে আরেকজন বলে উঠলো,
-" এটা একটা ট্র্যাপ নয় তার কি গ্যারান্টি? হতে পারে আপনারা নাটক সাজিয়েছেন। সম্পর্ক নেই এই বিষয়টা পুরো একটা স্ক্যাম! বাবার অসম্পূর্ণ কাজটাই আপনি সম্পূর্ণ করতে এসেছেন। বেশ মোটা অঙ্কের টাকাই পেতে যাচ্ছিলেন সাদিক সাহেব। টাকার লোভ সামলাতে পারছেন না হয়ত আপনারা বাবা, মেয়ে। তাই শেষ চেষ্টা করতে এসেছেন এখানে মিথ্যা নাটক সাজিয়ে। "
-" অরিকা এতোবড় নামীদামী ব্র্যান্ড। সেই ব্র্যান্ডের সাথে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল আপনারা কি কোনো স্টেপ নেননি? স্টেপ নিলে তো আজ আমাকে এসব ব্যাপারে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করতেন না। সকল তথ্য আপনাদের হাতেই থাকতো। আপনারা তা না করে আমাকে আক্রমণাত্মক প্রশ্ন করছেন, অপদস্তও করেছেন। এই ঘটনা কবেকার তা তো আমি জানিনা তবে ঘটনাটা ঠিকভাবে ইনভেস্টিগেট করুন, মুনতাসিব সাকিবের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করুন তাহলে সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। আসছি। "
টেবিলের ওপর থেকে কাগজপত্র গুলো তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিল ঐন্দ্রী। কোনোরূপ বাক্য ব্যায় না করে চটজলদি বেড়িয়ে পড়ল। ঐন্দ্রীর তড়িঘড়ি প্রস্থান দেখে জায়িনের পিছে দাঁড়ানো তার ব্যাক্তিগত সহকারী জিজ্ঞেস করলো,
-" স্যার মেয়েটা এভাবে চলে গেল... সিকিউরিটি টিমকে ইনফর্ম করব? "
জায়িন গম্ভীর কন্ঠে আওড়াল, " দরকার নেই। "
-" ওকে স্যার। "
—————
ঐন্দ্রী অফিস থেকে গার্ডেন এড়িয়াতে গেল। ক্লান্ত শ্রান্ত দেহটা টেনে একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ল ও। দৃষ্টি আকাশপানে ফেলে ঘন ঘন শ্বাস টানল। নিঃশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। ভেতরটা যন্ত্রণায় জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে ওর! যেই বাবা ওকে কোনোদিন নিজের ঔরসজাত সন্তানই মনে করলো না সেই বাবার করা অপরাধে আজ তাকে অপদস্ত হতে হলো। দু'হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে উঠল ও। ওর ক্রন্দনস্বরে ভারী হয়ে উঠল চারিপাশ।
-" এই তুমি কাঁদো কেন? "
ঐন্দ্রী অনুভব করল তার হাতে কোনো বাচ্চার হাতের স্পর্শ। ও পিটপিট করে তাকিয়ে দেখল চার কি পাঁচ বছরের বাচ্চা তার দিকে কেমন চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে। সে কিছু বলবে তৎক্ষনাৎ বাচ্চাটা এগিয়ে এসে ওর গাল ধরে চুমু খেল। মাথা নিচু ছিল তার। তাই বাচ্চাটির চুমু খেতে তেমন কোনো সমস্যাই হয়নি। ছোট বাচ্চাটা তার দু গালে ছোট্ট দু হাতের থাবা বসাল।
-" কেঁদোনা দেখো আদর দিয়েছিনা আমি? আদর দিলে আর কাঁদতে হয়না হুঁশ! "
আদুরে গলার আবদার। ঐন্দ্রী গলে গেল মুহূর্তে। বাচ্চাটিকে ঝাপটে ধরে ও আরো কিছুক্ষণ কাঁদল। অদ্ভুতভাবে ছোট্ট শিশুটি একটুও বিরক্তবোধ করলো না, বরঞ্চ সে তার ছোট্ট হাত দিয়ে ঐন্দ্রীর চুলে বুলিয়ে দিতে লাগল।
ক্ষণিকের মাঝে স্বাভাবিক হয় ঐন্দ্রী। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে নিজের করা কর্মকান্ডে লজ্জিত বোধ করল। ছোট থেকে নিজের দুঃখ কষ্টের সময় কখনো কেও তাকে পাশে বসে একটু সান্ত্বনা দেয়নি। আজ যখন এই অপরিচিত ছোট্ট একটা বাচ্চা এসে তাকে একটুখানি আদুরে গলায় আহ্লাদ করলো অমনি খেইঁ বসল।
-" নাম কি তোমার? "
-" আমার নাম শুদ্ধ। তোমার নাম কি?"
-" ঐন্দ্রী। "
-" অন্দি? "
ঐন্দ্রী হেঁসে ফেলল। " উঁহু... আমার সাথে বলো, ঐ..ই..ন্দ্রী। "
-" ঐ..ই...ন্দ্রী "
-" এইতো হয়েছে। এবার একসাথে বলো তো দেখি। "
-" ঐন্দ্রী। "
ঐন্দ্রী মিষ্টি করে হাসল। শুদ্ধের সাথে এক দু'টো কথা বলতে শুরু করে তারা বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ গল্প করল। ঐন্দ্রী বলেছে কম শুনেছে বেশি। শুদ্ধই যত গল্পের ঝুলি নিয়ে বসেছে। একটা অপরিচিত মানুষের সাথে এই বাচ্চাটার এতো সহজে মিশে যাওয়া দেখে ঐন্দ্রী যারপরনাই অবাক হয়েছিল। ওদের গল্পের মাঝে জায়িনের পিএ ছুটতে ছুটতে এলো।
-" শুদ্ধ? এখানে কি করছো তুমি? জায়িন স্যার তোমাকে খুঁজছে। জলদি এসো। "
-" আরেকটু থাকি না নীরদ আঙ্কেল। "
-" থাকতে পারো। আমি তোমাকে জোর করবোনা। কিন্তু পরে স্যার যখন তোমাকে আর আমাকে বকবে তখন কিন্তু আমাদের কেও বাঁচাতে আসবেনা। "
শুদ্ধর মুখোশ্রীতে মলিনতা ভর করলো। ওর ভালো লেগেছে ঐন্দ্রীকে। মেয়েটা তার সব কথা এতো মনোযোগ দিয়ে শুনেছে। কি সুন্দর তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। চুমুও দিয়েছে। তার কথা কেও এতোটা মনোযোগ দিয়ে শোনেনা একমাত্র বাবা বাদে।
শুদ্ধ বেঞ্চি থেকে নেমে দাঁড়াল। মন খারাপ করে বলল,
-" আমি যাই হ্যা? বাবা বকবে নয়তো আমাকে আর নীরদ আঙ্কেলকে। তুমি কি আমার বাবার অফিসে কাজ করো? তাহলে তো আমাদের আবার দেখা হবে তাই না? "
ঐন্দ্রী বিভ্রান্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, " বাবা? "
উত্তরটা এলো নীরদের পক্ষ হতে, " জায়িন উসমান স্যারের ছেলে ও। "
-" ওহ্! নাহ্ শুদ্ধ আমি তো এখানে কাজ করি না। আর করতেও চাইনা। " শেষোক্ত বাক্যটি নিম্ন গলায় বলল ও।
-" তাহলে আমাদের আর দেখা হবে না?" শুদ্ধের কাঁদো কাঁদো কন্ঠ। ঐন্দ্রীর মায়া হলো বড্ড! শুদ্ধকে সান্ত্বনা দিলো,
-" দেখা হবে তো। আমি আসব আবার তোমার সাথে দেখা করতে। "
-" সত্যিই? "
-" সত্যিই। "
শুদ্ধ ঐন্দ্রীকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানাল। নীরদ তাকে নিয়ে দৃষ্টিসীমানা পার হতেই ও মৃদু শ্বাস ফেলল। আনমনে ওপরে দৃষ্টি ফেলতেই দেখল ঠিক ১৪ তলায় একটি অবয়ব তার পানে দৃষ্টি ফেলেই তাকিয়ে রয়েছে। দূর থেকে তার লম্বা, সুঠাম শারীরিক গঠন ব্যাতিত আর কিছুই ঐন্দ্রীর নিকট স্পষ্টত না। কপালে ভাজ ফেলে তীক্ষ্ণ নজরে তাকাতপই
শ্রান্ত দেহ নিয়ে বাড়ি ফিরে এলো ঐন্দ্রী। আশানুরূপভাবে তাহিনা তাকে জেরা করলেন এবং যখন শুনলেন ওর ভাইভা ভাল হয়নি তখনি তোলপাড় শুরু করে দিলেন। ঐন্দ্রী না শোনার ভান করে ঘরে চলে এলো। ঠিক তার ছয়দিন পর তার ফোনে অরিকা থেকে একটি অপ্রত্যাশিত ইমেইল এলো,
Dear Oindree,
Congratulations! We are happy to inform you that you have been selected for internship position at our skincare brand. Your performance during viva was truly commendable.
We're exited to have you on board and look forward to starting this journey with you.
Best Regards,
Orika
·
·
·
চলবে……………………………………………………