এই নয়টি মাস যেন ছিলো এক দীর্ঘ স্বপ্নযাত্রা—প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত, প্রতিটি হৃদকম্পনে সুমনা অনুভব করেছে এক নতুন প্রাণের ধ্বনি। এখন, গর্ভাবস্থার শেষ ধাপে এসে, তার শরীর ক্লান্ত, কিন্তু মন আশায় পরিপূর্ণ। সুমনার পেট এখন পূর্ণিমার চাঁদের মতো—ভরাট, ভারী। চলাফেরা করতে একটু কষ্ট হয়। হালকা পায়ে হাঁটে, যেন প্রতিটি পা ফেলে খুব হিসেব করে। রাতে ঠিকমতো ঘুম আসে না, বালিশে সে বারবার জায়গা বদলায়। কোমর ব্যথা, পিঠে ভার, পায়ের তালু যেন হালকা জ্বলতে থাকে রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া—সবই এই শেষ পর্যায়ের সঙ্গী। ডাক্তার বলেছে, বাচ্চার মাথা নিচের দিকে ঘুরে গেছে, যেটা স্বাভাবিক। মানে বেবি এখন জন্মের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। সুমনার পায়ের গোড়ালি একটু ফুলে উঠেছে। হাতের আঙুলে মাঝে মাঝে ব্যথা ধরে আসে। হেঁটে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে।
তবুও সে প্রতিদিন আয়নায় নিজেকে দেখে, নিজের শরীরের এই পরিবর্তনগুলো দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে যায়। এই সময়টাতে তার আবেগ একটা দোলাচলে দুলে। একবার খুশিতে হাসে, একবার কান্না পায়— একবার ভাবছে,
“ছেলে হবে? নাকি মেয়ে?”
আবার একবার হঠাৎ ভয় পায়— “সব ঠিকঠাক হবে তো? বাচ্চা কি সুস্থ থাকবে?”
রাতে সে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
কারণ, এই সময়ে তার পাশে আসলে যে মানুষটির থাকার কথা সে নাই!
সেদিন সকালেই সে ফিরে এসেছে নিজের বাপের বাড়িতে। হুট করেই। কারো কোনো অনুমতি ছাড়াই। রাজকে না জানিয়ে। কারণ আর সহ্য হচ্ছিল না। সহ্য হচ্ছিল না রাজের ব্যবহার, সেই স্পষ্ট দূরত্ব, যে দূরত্ব দাম্পত্যের দেহঘনিষ্ঠতাকেও ছাপিয়ে গেছে।
শুধু শরীরেই যে দূরত্ব—তা না। চোখে মুখে কথাতেও। যতটা কষ্ট শরীরের ভারে হয়, তার চেয়ে বেশি কষ্ট হৃদয়ের ভারে। যাকে সে ভালোবেসে একদিন নিজের বুকের ভেতর জায়গা দিয়েছে, সে-ই এখন অন্য এক মানুষের মতো আচরণ করছে।
সেদিন সকালবেলা হঠাৎ রাজের ফোনে ‘টিং টুং’ মেসেজের আওয়াজে সুমনার ঘুম ভাঙে। বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে ছিল। রাজের ফোন পাশে। অটোমেটিক নোটিফিকেশন খুলে গেছে। সুমনা ফোনটা টেনে নেয়। চোখ আটকে যায় দুইটি মেসেজে।
“আজ দেখা হবে তো?”
“উত্তর দিবে তো নাকি? এখন তো বউ নেই, একা আছো। তাও সময় হচ্ছে না তোমার?”
সুমনার বুক ধক করে ওঠে। গলার ভেতর কী যেন দলা পাকায়। চোখের ওপর পর্দা পড়ে যায়। তখনই রাজের ঘুম ভেঙে যায়। সুমনাকে কাঁদতে দেখে বলে,
“কি হলো, কাঁদছো কেনো?”
সুমনা কান্নারত কন্ঠে বলে,
“তুমি অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছো!”
কথাগুলো স্পষ্ট উচ্চরণও করতে পারছিলো না সুমনা। গলা কেমন ভেঙে ভেঙে আসছিলো। রাজ স্বাভাবিক থেকেই বলে,
“এসব কি বলছো!”
রাজের প্রশ্নে সুমনা ফোনটা নিয়ে দেখিয়ে বলে,
“এটা কে?”
রাজ একটু হকচকিয়ে বলে,
“ওহ্, এটা তো নিশিতা। আমার অফিস কলিগ।”
সুমনা এবার তাচ্ছিল্যের হাঁসি হেঁসে শুধোয়,
“শুধুই অফিস কলিগ?”
সুমনার চোখের চাহনি ছিলো অন্যরকম। রাজ কিছুটা ঘাবড়েই বলে,
“এর আগেও ওর আরো একটা পরিচয় হলো, নিশিতা আমার প্রাক্তন! যার সাথে সম্পর্ক শেষ করেই আমি তোমার সাথে বিয়ে করেছি।”
কোনো মেয়েই সহ্য করতে পারবে না, তার স্বামী আর প্রাক্তনের যোগাযোগ! সুমনারও ব্যতিক্রম অনুভুতি হলো না। সুমনার কান্না যেন এবার দ্বিগুণ হলো। চোখ ভর্তি পানি নিয়ে প্রশ্ন করলো,
“আর এখন?”
রাজ চুপ। চোখ সরিয়ে নেয়।
সুমনা বলে,
“তোমার মুখে যত না কথা, তারচেয়েও বেশি আছে এই চুপ থাকার মধ্যে।”
রাজ এবার উত্তর দেয়,
“এখন শুধুই আমার বন্ধু, আর কিচ্ছু না!”
“ওহ্, সেজন্যই তুমি করে সম্মোধন এখনো? তোমাকে মনে পড়ছে এসব বলা!”
“তুমি ভুল বুঝছ
রাজকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে, সুমনাই বলে,
“আমি ভুল বুঝছি না রাজ। তোমার পুরনো প্রেম উতলে পড়ছে, যেখানে তোমার বউ বাচ্চা থাকা সত্বেও! ছিহ্! ভাবতে পারছি না আমি!”
তারপর আর দেরি করেনি সুমনা। কারো দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে এসেছে। এখন সে বাপের বাড়িতে। মা বারবার মাথায় হাত রাখে। খেয়াল রাখে।
সুমনা ভেতর থেকে ভাঙছে কিন্তু বাইরেটা শক্ত রাখছে।
কিন্তু বাচ্চাটা… সে কি এসব বোঝে? হয়তো বোঝে না, একটা প্রাণ তো সবকিছু টের পায়, না বুঝলেও অনুভব করে।
পরশু দিনই ডেলিভারির ডেট।
সুমনার চোখে-মুখে কেবলই অবসন্নতা আর অভিমান। তারপর কতগুলো দিন কেটে গেছে। রাজ আর সুমনার ভেতর তার পর থেকে আর স্বাভাবিক কথা হয়ে উঠেনি! প্রতিবারই সমাপ্তি হয়েছে ঝগড়া দিয়ে। রাজের ভাষ্যমতে সুমনা তর্ক করে, আর সুমনার কাছে রাজ পুরোটাই বদলে গেছে! এভাবেই চলেছে তাদের কথোপকথন! সুমনার চোখের পানি দিয়ে বালিশ ভিজিয়েছে রাজের কথায়। এরকম ঝগড়াঝাটি পর আজ কতগুলো দিন পেরিয়ে দেছে, একটিবারও ফোন করেনি রাজ। একটিবারও ‘কেমন আছো’ বলেনি। একদিন যে মানুষটা সুমনার পায়ের হালকা মোচড় দেখলে ওষুধ নিয়ে ছুটে আসত, আজ তার চরম কষ্টে পর্যন্ত সে নেই। নিজের মনে মনেই সুমনা আওরাতে থাকে,
“তাহলে কী রাজের জীবনে সত্যিই আমি নেই?
নতুন কেউ এসেছে? আমার যত্ন নেওয়ার, পাশে থাকার দায়িত্বটুকু কারো ভালোবাসার ছায়ায় বিলীন হয়ে গেছে?”
তার চোখে জল আসে না আর। শুকিয়ে গেছে সব—প্রেম, অপমান, অভিমান। শুধু জেগে আছে ভেতরের কষ্ট,। সুমনা ভাবে—এই আমি কি তবে আমার সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্তের ফল ভোগ করছি?
নিজের সব ছেড়ে, পরিবার, সমাজের চোখরাঙানি, সব কিছু অগ্রাহ্য করে যে ছেলেটাকে নিয়ে জীবন গড়তে চেয়েছিল সে, সেই ছেলেটাই আজ তার সবচেয়ে বড় ভরসাহীনতা।
পেটের বাচ্চা একটু লাথি মারে যেন, মা কষ্ট পেলে সন্তানও বুঝে। মায়ের গর্ভে থাকা একটি সন্তান—সে কথা বলতে পারে না, হাসতেও শেখেনি, চোখ খুলে দেখেনি পৃথিবীর রং—তবু সেই প্রাণটাই কোনো শব্দ না বলে বলে দিয়েছে,
“আমি আছি মা, তুমি থাকো—আমার জন্য।”
এই যন্ত্রণার ভার বইতে বইতে ক্লান্ত হয়ে যায় সুমনা! মন খুলে কতদিন কথা বলে না, অভিযোগ কাকে করবে? এইসব তো তার নিজেরই গড়া, নিজেই গড়েছে নিজের ভবিষ্যত! এভাবেই পেরোচ্ছে দিন। বুকের মধ্যে রাজের সুন্দর স্মৃতি আবার রাজেরই করা অপমান বা দুর্ব্যবহার নিয়ে চোখের পানি দিয়ে।
“সারাক্ষণ রুমের মধ্যে শুয়ে বসিস থাকিস কেন?”
মায়ের ধমকানি শুনে সুমনা পেছন ফিরে তাকায়। আজকাল আর ইচ্ছে করে না কারো সাথে কথা বলতে, মিশতে। কিছুতেই কিছু ইচ্ছে করে না।
“উঠ বলছি, সবার সাথে কথা বললেও তো মন ফ্রেশ থাকে।”
সুমনা বলে,
“কোথায় যাবো মা?”
“আপাতত তোর বাবার সাথে চা খেতে আয়।”
সুমনাও আর না করলো না। সে চায় না, তার জন্য কেউ অতিরিক্ত চিন্তা করুক। তাই মা'য়ের পিছু পিছু ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলো। সেখানে চায়ের কাঁপে চুমুক দিচ্ছে দাদী আর বাবা। দুজনকে দেখে চুপই রইলো। হুট করেই সুমনার দাদী বলে উঠলো,
“ডেলিভারির ডেট কবে দিছে রে?”
“পরশু দিন, দাদী।”
বিজ্ঞের মতন দিলরুবা বেগম ভাব নিয়ে বললো,
“ডাক্তারেরা এরম কয়ই। আল্লাহয় দিলে তোরে ঘরের ভিতর পার করলেই হয়।”
তখনই মাঝখানে কথা বললেন সুমন রহমান।
“আম্মা, এখন কেউ ঘরে বাচ্চা জন্ম দেয়?”
“আমরা দেই নাই? তুই হোস নাই!”
“সেসব পুরনো কথা। এখন হাসপাতাল আছে।”
ছেলের কথায় তিনি কিছুটা মুখ বেঁকিয়েই বলে,
“হাসপাতালে তো বহুত টেকা নিব!”
“নিলে নিব!“
দিলরুবা বেগম এবার সুমনাকে শুধোয়,
“কিরে টাকা-পয়সা কত আছে লগে?”
“আম্মা? সুমনারে কি জিগ্যেস করেন? ওর কাছে টাকা?”
“হ, বাচ্চা হইব আর টাকা থাকব না? ক্যান? ওর জামাই আছে না? পেটের বাচ্চার বাপ আছে? বাপ যখন হইছে তখন দায়িত্ব নিয়ে টেকা দিব না?”
সুমনা নিশ্চুপ। তার কাছে কোনো টাকা পয়সা নেই। রাজ সুমনাকে প্রথম প্রথম খরচ বাবদ কিছু টাকা পাঠাতো। কিন্তু সেদিনের পর থেকে যোগাযোগ ও বন্ধ বা সেসব কথাই হতো না! কথাও বন্ধ, সাথে টাকা দেওয়াও! সুমনা মাথা নিচু করে থাকে। সুমন রহমান ফের বলে,
“আমি আছি না, আম্মা?”
বরাবরের মতনই দিলরুবা বেগম মুখ বেঁকিয়ে বলে,
“তুইই তো আছোস, ওষুধপত্র হইতে খাওন দাওন সবেতেই তুইই।”
সুমনা নীরবে সেখান থেকে চলে আসলো নিজের রুমে। বারবার কানের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলো দাদীর কথা। কথাগুলোতে রাগ হচ্ছে না। রাগ কেনই বা হবে? সত্যিই তো বলেছে দাদী। রাজেরই তো উচিত ছিলো। সুমনাকে ডাক্তার বলে দিয়েছে ওর অনেক সমস্যা, সেজন্য বাচ্চা সিজারিয়ান ডেলিভারিই হতে পারে। তার জন্য বেশ ভালো পরিমানেই টাকা খরচ হয়, সেটাও সে জানে। এতগুলো টাকাই বা তার বাবা দিবে কেনো, বাচ্চার বাবা থাকতে? ঠিকই তো আছে! সুমনা এবার ফ
রাজকে কল দিলো।
“হ্যালো?”
কয়েকদিন পর রাজের কন্ঠ শুনে সুমনার গলা শুকনো, শব্দগুলো গলায় কাঁটা হয়ে আঁটকে আছে। বলতে পারছে না! তবুও বললো,
“কেমন আছো?
“আছি, তুমি কেমন আছো সুমনা?”
“নিজের বাড়িতে কেউ খারাপ থাকে না!”
সুমনার কথা শুনে রাজের ভ্রু কুঁচকালো! মেয়েটা আগের মতনই। সেই প্রেমিকা সুমনা আর বউ সুমনার মধ্যে ফারাক খুঁজে পেয়েছে সে। এখনের সুমনা ভালো না, খালি ঝগড়া করে। তর্ক করে। এমনটাই বলেছে রাজ।
“এসবই বলবে! আর কি?
রাজের উত্তরে সুমনা বুঝলো, আর কিছু নেই আগের মতন! ফাটল একবার ধরলে আর মুছে না!
“আর তোমার বাচ্চা?”
“সে আসবে সঠিক সময়েই। আমি জানি।”
“খোঁজ নিয়েছো?”
সুমনার প্রশ্নে রাজের চটজলদি উত্তর,
“হুম।”
সুমনা অবাক হয়ে শুধোয়,
“কই, ফোন তো করোনি!”
“তোমার বাবার সাথে প্রায়ই কথা হতো। যেদিন তুমি ডাক্তার কাছে যেতে চেক আপের জন্য।”
এক মুহুর্তের জন্য সুমনা নিশ্চুপ হলো। ভাবতে লাগলো রাজ তার বাচ্চার খোঁজ ঠিকই নিয়েছে, আড়াল থেকে! চাইলে পারতো সুমনাকে কল করতে। তাও করেনি! কথাগুলো মনে আসতেই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো আপনাই।
“তাহলে পরশু দিন ভর্তি হওয়ার ডেট, জানো নিশ্চয়ই?”
“জানি, তুমি না বললেও! সঠিক সময়ে সেখানে পৌঁছে যেতাম আমি।”
“জানো যখন, তখন এটাও জানার দরকার তোমার বাচ্চা পৃথিবীতে আসার যে খরচ হবে, সেটার দায়িত্ব ও তোমার নিতে হবে।”
“আমার বাচ্চা আমিই দায়িত্ব নিব, সুমনা! তাই স্বাভাবিক।”
সুমনা এবার ভেঙে বললো,
“তাহলে টাকা পাঠিয়ে দাও।”
“এখন?”
“এখনই পাঠাবে!”
“কত?”
“আপাতত চল্লিশ পঞ্চাশ হাজারই পাঠাও। সব মিলিয়ে!”
রাজ কিছুটা অবাক স্বরে বলে,
“এত্ত টাকা! কই পাব?”
“পাওয়ার কথা, চাকরি করছো বেশ ভালো কয় মাসই। এখনি পাঠিয়ে দাও।”
ফোনের ওপাশে হঠাৎ রাজের কণ্ঠ আরো রুক্ষ হয়ে ওঠে,
“সুমনা, আমি এত টাকা পকেটে নিয়ে ঘুরছি না! কাল বেতন পেলে একত্রে পাঠিয়ে দিব। আর মনে হয় না, এতগুলো দিতে পারবো, হবে?”
সুমনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ভাবে, একেবারেই রাজ টাকা না দিলে অন্তত ডেলিভারির সময়ে! বিষয়টা খুবই বাজে এবং সাথে অসম্মানেরও হবে। যেটা সুমনা চাইছে না।
“ঠিকআছে!”
“তাহলে আর কি?”
রাজের প্রশ্নে সুমনা বলেই ফেলে,
“নতুন জনকে নিয়ে ভালো আছো তাই না?”
“খোলসা করে বলো!”
“কেন? তোমার পুরনো মানুষ নতুন হয়ে ফিরেছে তোমার জীবনে। তোমার প্রাক্তন!”
রাজের গলার স্বর উচ্চ হয়ে আসলো।
“তুমি আবার ভুলভাল বলছো সুমনা!”
সুমনাও আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে,
“আমি ভুলভাল বলছি না! সেদিন যা দেখেছি তাই সত্যি!”
“উফ! বলেছি না, আমরা শুধুই অফিস কলিগ, ফ্রেন্ড। আর কিছুই না!”
“আবার অনেক কিছুই, তাই না?”
রাজ রাগ দেখিয়ে বলে,
“বারবার বলেছি কথা শুনতে পাও না তুমি? ওই নিশিতার পরামর্শেই চাকরিটা পেয়েছি। আমার এরকম দুঃসময়ে! এখন শুধু প্রাক্তন সেজন্য অকৃতজ্ঞ হয়ে মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে রাখব? ও টেক্সট করেছিলো দেখা করা মানে মিটিং এর জন্য। সেদিনও বলেছি!”
সুমনার এবার কান্নার গতি বাড়ে। এতদিন পর কল দিয়ে এভাবে কথা শোনা লাগলো?
“শাক দিয়ে মাছ ঢেকো না!”
রাজের এবার রাগ চরম পর্যায়ে গিয়ে ঠেকলো।
“তোকে সেদিনও বুঝিয়েছি৷ বুঝিস নাই! বারবার উল্টাপাল্টা কথা বলে আমার মাথা উল্টিয়ে দিস। জানিস না, আমার টাকা দরকার? এইতো টাকা চাইলি! সেগুলো কোথা থেকে দিব? কাজ করেই তো! তোর বকবক শুনলে মন আর কাজে বসে না। নিশিতাও তো এত কথা বলে না! আমাকে মোটিভেট করে। এত কথার চেয়ে সোজা কথা তোমার আমাকে ভালো না লাগলে নাই, তাও এসব কথা বলবে না!”
এক মুহূর্তে সুমনার বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে পরে। কাঁপা কন্ঠে শুধোয়,
“এখন এতই বিরক্তি, ছেড়ে যাওয়া?”
“হ্যাঁ! বলো সেটাই চাও তো তুমি? ডির্ভোস? তালাক! বলব আমি? আরো সহজ না? বলবো তালাক? বলো? বেশ বলছি.....
সুমনা ফোনটা কেটে দেয়। সহ্য করতে পারে না আর। কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে পড়েছে। হেঁচকিও উঠেছে! তালাক, শব্দটা এত সহজে উচ্চারণ করতে পারলো রাজ? কথা গুলো সুমনার কানে বাজছে! যেই মেয়ের ইস্যু ধরে সে বেরিয়ে আসলো আজকেও তার জন্যেই রাজ রেগে গিয়ে এসব বললো! কীভাবে পারলো?
যার জন্য পরিবার, সব ছেড়েছিলো, সেই মানুষটাই তাকে ছেড়ে দিতে চাইছে?
যার জন্য দাদীর ভর্ৎসনা গিলেছে, কটূ কথা সহ্য করেছে, রাতের পর রাত শুধু ভবিষ্যৎ ভাবনায় জেগে থেকেছে, সেই মানুষটা এক মুহূর্তেই বলে ফেললো ছাড়ার কথা!
তাহলে রাজের প্রেম কি মিথ্যে ছিল?
তার গর্ভে যে সন্তান—যে রাজের রক্তের অর্ধেক—সেই সন্তানের অস্তিত্বটাও কি রাজের কাছে মূল্যহীন? সুমনা কেঁপে ওঠে। গায়ের কাপড় ভিজে যায়। একটা হিম স্রোত গড়িয়ে পড়ে পায়ের পাতা পর্যন্ত। যাকে এতখানি ভালোবাসলো সেই মানুষটা বাদে সুমনার ভালো থাকাই হয়ে উঠছে না, সবার সাথে থেকেও! এত দুরত্ব, তৃতীয় ব্যক্তি, ভুলবোঝাবুঝি, এসব আর সইতে পারছে না যেনো। কম তো হয়নি! সুমনা ঢোক গিললো। মাথায় ঘুরলো পুরনো চিন্তা! যেমন বিয়ের আগে করতো, রাজকে না পেলে সুইসাইড করবে। তেমনি এখনো ভাবলো, রাজকে ছেড়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়! আবার এসবও মানা সম্ভব হচ্ছে না, রোজ রোজ কষ্ট পাওয়া, কাঁন্না করা!
যার জন্য সব ছাড়লো, সেই তাকে ছেড়ে দিলে বাঁচকে কি নিয়ে? এই দিন দেখার আগে মৃত্যুই শ্রেয়! তখনই পেটের ভেতরটা যেন নড়ে উঠলো। জানান দিলো ভেতরের প্রাণের কথা।
সুমনা সুইসাইডই করে নিতো, যদি না তার সাথে আরেকজন না থাকতো! সে এখন শুধুই এক নারী নয়—সে একজন মা। তাকে এখন বাঁচতে হবে। তার সন্তানের জন্য বেঁচে থাকতে হবে!
সুমনা উঠে গিয়ে ড্রয়ার খুললো। ধুলোমাখা একটা ডায়েরি তুলে নিলো হাতে। এই ডায়েরিটা অনেকদিন খোলা হয়নি। বিয়ের আগে লিখতো রাজকে নিয়ে—ভবিষ্যতের স্বপ্ন, ভালোবাসার প্রতিটা স্পর্শময় সন্ধ্যা—সবই ছিল পাতায় পাতায়। আজ আবার সেই ডায়েরি খুললো, তবে রাজের জন্য নয়। আজ লিখবে শুধুই তার সন্তানের উদ্দেশ্যে। যে আসেনি এখনও, অথচ তার অস্তিত্বই আজ সুমনাকে টিকিয়ে রেখেছে। ডায়েরির পাতায় প্রথমে তারিখ লিখলো। তারপর থেমে থেমে, হাত কাঁপিয়ে লিখলো—
"প্রিয় সন্তান,
তুমি এখনও আসোনি, তবু তুমি আছো। আমার শরীরের গভীরে নয়, আমার বাঁচার কারণ হয়ে—তুমি আছো। আজ যদি তুমি না থাকতে, আমি বাঁচতাম না। আজ যদি তোমার ছোট্ট হৃদয় আমার মধ্যে না ধুকপুক করতো, আমি হয়তো অনেক আগেই থেমে যেতাম।
তুমি জানো? আজ খুব কষ্ট পেয়েছি।
তোমার বাবা... জানো? ‘
‘ভেবেছিলাম সে-ই আশ্রয়,
হয়ে গেল সে-ই নিঃস্বয়ের ভয়।
যার নামে কেটে ছিলো দিন রাত,
সে-ই দিলো হৃদয়ে প্রলয়পাত!’
না, আমি তোমাকে তিক্ততা দিয়ে বড় করতে চাই না। এসব বলবো না। কেবল এটুকু বলি—আমি একা হয়ে গেছি, বাঁচার কোনো কারণই নেই। কেবল তোমার জন্যই আমি আজও শ্বাস নিচ্ছি। তোমার জন্যই আমি মৃত্যুর কিনার থেকে ফিরে এসেছি আজকে। তুমি আমার বেঁচে থাকার শেষ প্রান্তে ঝুলে থাকা আলো। এসো, খুব শীঘ্রই এসো। তোমার ছোট্ট পা-জোড়া নিয়ে হেঁটে এসো আমার কোলে। আমি তোমায় বুকে টেনে নিই।
তারপর… তারপর আমার ছুটি! দায়িত্ব শেষ।
সুমনা লেখা শেষ করে পাতাটা বন্ধ করলো না। খুলেই রাখলো—জানলা দিয়ে আসা হালকা বাতাসে পৃষ্ঠাটা একটু কেঁপে উঠলো, যেন স্নেহের হাত বুলিয়ে গেলো কেউ।
·
·
·
চলবে……………………………………………………