লগ্নজিতা - পর্ব ২২ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল নাদভির। সে উঠে ফ্রেশ হয়ে এলো। তারপর কিছুক্ষণ নদীর পাড়ে হাঁটল। এর মাঝেই লগ্ন উঠে পড়ল।

তাকে দেখে নাদভি আগুন ধরাতে ধরাতে জানতে চাইল, ‘আজকের নাস্তায় কী খাবে? তুমি ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে আমি বানিয়ে ফেলি।’

লগ্ন বলল, ‘তুমি যা খাওয়াবে।’

লগ্ন চলে গেলে নাদভি চিন্তায় পড়ে গেল। এতকিছু এনেছে তারা, কী যে বানাবে বুঝতেই পারছে না। অনেক চিন্তাভাবনা করে শেষে স্যান্ডউইচ বানাল। কিছু ফল কেটে নিল। লগ্ন ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে নাদভির নাস্তা বানানো শেষ। দুজন নদীর পাড়ে বসে নাস্তা করল। নাস্তা খেতে খেতে লগ্ন বলল, ‘শোনো আমরা যদি কোনোদিন অভাবে পড়ি তাহলে তোমার এই স্যান্ডউইচ দিয়ে দোকান দিয়ে ফেলব। এত ভালো স্যান্ডউইচ তুমি বানাও! এর আগে খাওয়াওনি কেন?’

নাদভি হো হো করে হেসে ফেলল। লগ্নর প্রথমদিকের সেইসব দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। ওর হাসি দেখেই তো মজেছিল! বলল, ‘তুমি হাসলে তোমাকে খুব সুন্দর লাগে। এত কম হাসো কেন ইদানীং?’

নাদভি নদীর দিকে তাকানো ছিল। সেদিকে তাকানো অবস্থাতেই বলল, ‘ভয় হয় তাই।’

লগ্ন ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কীসের ভয়?’

নাদভি এবার লগ্নর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শুধু হাসি না, সবকিছুতেই ভয় লাগে। হারিয়ে ফেলার ভয়। যদি ভাবো পটানোর জন্য করছি? ভাবতেই পারো, একসময় তো পটানোর জন্যই করতাম।’

লগ্ন কিছুক্ষণ নাদভির চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। নাদভিও। তারপর নাদভির কাছে এসে গা ঘেঁষে বসল। হাত ধরে কাঁধে মাথা রেখে বলল, ‘তোমার যখন যা ইচ্ছে করবে তাই করবে। ভয় নেই। পটেই গেছি। আর পটানোর কিছু নেই।’

নাদভির বুকের ভেতর উথালপাথাল ঢেউ উঠেছে। সে আর কিছু বলতে পারল না।

নাস্তা শেষ করে ওরা গাড়ি নিয়ে ছুটল ব্যানফ শহরের উদ্দেশে। বিশাল রকি মাউন্টেনের পাদদেশে ছবির মতো সুন্দর একটা শহর ব্যানফ। রাস্তার দু ধারে দোকানপাট আর ট্যুরিস্টদের জনসমাগমে জমজমাট পুরো শহর। কিছুক্ষণ এদিকওদিক ঘুরে বেড়াল। টুকটাক কেনাকাটা করল। তারপর গেল বহুল প্রতীক্ষিত ব্যানফ হট স্প্রিংয়ে। এটি পাহাড়ের চূড়ায় একটি প্রাকৃতিক উষ্ণ পানির পুল। পাশেই পাহাড়চূড়ায় সারাবছর বরফ জমে থাকে। আশেপাশের প্রতিটি লেকের পানি ভয়ংকর ঠান্ডা। অথচ এই পুলে এসে পড়ছে গরম পানি! বিধাতার কী চমৎকার আশ্চর্য সৃষ্টি! প্রথমদিকে পুলটিও প্রাকৃতিক ছিল, পাথর দিয়ে বাঁধানো। পরবর্তীতে ট্যুরিস্টদের ব্যবহারের সুবিধার্থে সুইমিং পুলের মতো করে তৈরি করা হয়েছে। এটি যেহেতু পাহাড়ের চূড়ায় তাই ব্যানফ শহর নিচে। মেঘেরাও খুব কাছে। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে।

লগ্ন ও নাদভি পুলে নেমে কখনো সাঁতার কাটল। কখনো চুপচাপ পাহাড় চূড়ায় ভেসে বেড়ানো মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি খেলা দেখল। কখনো বা আবার দেখল নিজেদের, পরস্পরকে। এখন এখানে বসন্তকাল, তাপমাত্রা অনেক কম, বেশ ঠান্ডা। তারমাঝে এই গরম পানি শরীরে এত আরাম এনে দিলো যে উঠতেই ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু খিদেয় পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছিল তাই উঠতে হলো। কাপড় পালটে বেরিয়ে এলো। রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে বিকেলে ফিরে এলো ক্যাম্পগ্রাউন্ডে।

কাঠ শেষ হয়ে গেছে, নাদভি আবার কিছু কাঠ নিয়ে এলো। সূর্য ডুবলে সব অন্ধকার। তাই বেলা ফুরানোর আগেই রাতের রান্নাটা শেষ করে ফেলতে হবে। নাদভি কাঠ কাটতে শুরু করতেই লগ্ন বলল, ‘রাতের রান্নাটা আমি করি। কী খাবে বলো তো?’

নাদভি কাঠ কাটতে কাটতে বলল, ‘তোমার ইচ্ছা।’

‘আচ্ছা এটা বলো যে ভাত খেতে চাও নাকি অন্যকিছু।’

নাদভি হেসে বলল, ‘বাঙালির মন তো একটু ভাত ভাত করবেই। মিসিসাগা ছেড়ে আসার পর থেকে তো ভাত খাওয়া হয়নি।’

‘তাহলে ভাতই করি। রান্না করা গরুর মাংস যে এনেছিলাম ওটা গরম করি। সাথে দু’টুকরো মাছ ভাজা।’

নাদভি হেসে বলল, ‘ফার্স্ট ক্লাস খানা।’

লগ্ন সব প্রস্তুত করতে করতে নাদভি আগুন জ্বালিয়ে দিলো। লগ্ন রান্না বসিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কফি খাবে?’

নাদভি বলল, ‘আমি বানাই।’

নাদভি কফি বানিয়ে লগ্নর পাশে এসে চেয়ার পেতে বসল। কফি খেতে খেতে বলল, ‘জানো, মা আমার হাতের কফি খুব ভালোবাসত।’

লগ্ন নাদভির দিকে তাকিয়ে দেখে ভাবনায় ডুবে গেছে সে। হয়তো পুরোনো দিনের ভাবনা। বলল, ‘মাকে দেখাবে? ছবি আছে?’

নাদভি তার ফোন থেকে ছবি দেখাতে দেখাতে বলল, ‘শেষদিকে মায়ের অনেক ছবি তুলে রাখতাম। বুঝতে পারছিলাম হারাতে চলেছি।’

লগ্ন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল, হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে অসুস্থ একজন মহিলা। নাদভির চেহারার সাথে মিল আছে।

বলল, ‘সুস্থ সময়ের ছবি নেই?’

‘আছে। দাঁড়াও দেখাচ্ছি।’

নাদভি ফোন ঘেটে সুস্থ অবস্থার ছবি দেখাল। অসম্ভব সুন্দর ছিলেন দেখতে! ক্যান্সার কতটা বদলে দিয়েছিল! নাদভি বলল, ‘আমার স্মৃতিতে অসুস্থ চেহারাটাই ভাসতে থাকে সবসময়। তাই হয়তো ওই ছবিগুলো প্রথমে দেখিয়ে ফেলেছি। কিছু মনে কোরো না।’

লগ্ন ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কী মনে করব?’

নাদভি আমতা আমতা করে বলল, ‘না মানে, যদি ভাবো মা আসলেই অসুস্থ ছিল এটা প্রমাণ করার জন্য ওই ছবিগুলো দেখিয়েছি। আসলে ব্যাপারটা তা নয়।

‘উফ ধুর! আমি এমন কিছুই ভাবিনি। তুমি তোমার গিল্টনেসের কারণে এতকিছু ভাবছ। এসব ভাবা বন্ধ করো তো। যা গেছে তা গেছে।’

ইতোমধ্যে রান্না হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অন্ধকার হয়ে আসবে, তাই খাবার দাবার সব তাঁবুর ভেতর নিয়ে গেল।

তাঁবুতে ঢুকে নাদভি জিজ্ঞেস করল, ‘আজ একা ঘুমাতে পারবে নাকি আজও ভয় করবে?’

লগ্ন নাদভির মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। গলার পেছনে দু’হাত বেঁধে জিজ্ঞেস করল, ‘কেন আমার সাথে এক তাঁবুতে ঘুমাতে ভয় পাচ্ছ?’

নাদভির যে কী হলো! সে লগ্নর কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে বলল, ‘তা একটু পাচ্ছি বইকি।’

লগ্ন মিটিমিটি হেসে বলল, ‘তোমার স্পর্শ তো বলে না কোনো ভয় পাচ্ছ।’

‘হাতে হয়তো ভয় নেই, মনে আছে।’

‘তাহলে মন না হলেও হাত অবাধ্য হতে পারে বলছ?’

নাদভি হো হো করে হেসে উঠল। তারপর বলল, ‘তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার কোনোকিছুই অবাধ্য হবে না কখনো।’

‘আর যদি আমার ইচ্ছে করতে বাধ্য করো?’

‘এমনটা কখনোই করব না।’

লগ্ন এবার ঘোরলাগা গলায় বলল, ‘একটু করলে কী হয়? নাদভি হেসে বলল, ‘উসকাচ্ছ কেন আমাকে?

লগ্ন এবার নাদভিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘জানিনা।’

নাদভিও জড়িয়ে ধরল। সত্যিই উসকে গেছে সে। অবাধ্য হতে ইচ্ছে করছে এখন। কিন্তু এই ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দেবে না। কিছুতেই না।

নাদভি সরে গিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, খাওয়ার পানি শেষের দিকে। পানি নিয়ে আসি।’

লগ্ন বলল, ‘আমি একা থাকতে পারব না এখানে।

‘তাহলে তুমিও চলো।’

দুজন মিলে পানি আনতে গেল। পানি এনে রাতের খাবার সেড়ে দুজনে কিছুক্ষণ ক্যাম্পগ্রাউন্ডে হেঁটে এলো। তারপর যার যার বিছানায় শুয়ে পড়ল। লগ্ন কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল কিন্তু উসকে যাওয়া নাদভির সহজে ঘুম এলো না।
·
·
·
চলবে..........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp