মিসিসাগা টু ব্যানফ জার্নিতে ছোটখাটো কফি বিরতির পর প্রথম বড়সড়ো স্টপেজ ছিল অন্টারিও প্রভিন্সের থানডার বেতে। থানডার বে শহরটি মিসিসাগা থেকে ১৩৮৪ কিলোমিটার দূরে। ভোর ছটায় রওনা হয়েছিল তারা। থানডার বে পৌঁছাল রাত ৮টায়। টানা ১৫ ঘণ্টা ড্রাইভ করে নাদভি প্রচণ্ড ক্লান্ত। রাতটা এখানে থাকার জন্য একটা হোটেলে দুটো রুম বুক করে রেখেছিল। রাতের খাবার খেয়েই তারা যার যার রুমে ঘুমিয়ে পড়ল। রাতে খুব ভালো ঘুম হলো।
ভোরবেলা আবার বেরিয়ে পড়ল। আজকের গন্তব্য সাসকাচোয়ান প্রভিন্সের গাল লেক। সেখানেও হোটেলে দুটি রুম বুক করা আছে। অন্টারিও প্রভিন্সের পর ম্যানিটোবা প্রভিন্স পার হয়ে তারপর সাসকাচোয়ান প্রভিন্স। ম্যানিটোবা প্রভিন্সের উইনিপেগ শহরে লাঞ্চ করে যখন আবার রওনা হচ্ছিল তখন লগ্ন আগেই গিয়ে স্টিয়ারিংয়ে বসল। নাদভি অবাক হলো।
লগ্ন বলল, ‘আমি এতটাও অমানবিক না যে একটানা এত ড্রাইভ করাব তোমাকে দিয়ে। যতক্ষণ পারি আমি চালাই। এরপর আবার তুমি চালিয়ো।’
নাদভি আপত্তি করলেও লগ্ন তা টিকতে দিলো না। সে রেজাইনা পর্যন্ত টানা ৬ ঘণ্টা গাড়ি চালাল। রেজাইনাতে কফি ও হালকা স্ন্যাকস খেয়ে আবার রওনা হলো। এবার আর নাদভি লগ্নকে সুযোগ দিলো না। লগ্নরও কষ্ট হচ্ছিল তাই ছেড়ে দিলো। আরও তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করার পর তারা পৌঁছল গাল লেক। রাতটা গাল লেকে কাটিয়ে পরদিন ভোরবেলা আবার যাত্রা শুরু করল। এবার আর কোনো বড় স্টপেজ নেই। আজ দুপুরের আগেই মাত্র ৫ ঘণ্টা ড্রাইভ করেই তারা পৌঁছবে তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্য আলবার্টা প্রভিন্সের ব্যানফে।
তারা যাচ্ছে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে। যত পশ্চিমে যাচ্ছে তত প্রকৃতি তার সৌন্দর্য ছড়াচ্ছে। গাল লেকের কিছুদূর পর থেকেই আলবার্টা প্রভিন্সের শুরু। আলবার্টা প্রভিন্সে ঢোকার পর থেকেই কানাডিয়ান মাউন্টেইন তাদের আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করল। বিশাল বড় হাইওয়ের দুপাশে অসীম জঙ্গল। রাস্তার ওপর প্রায়ই বড় বড় ব্রিজ পড়ছে। এই ব্রিজগুলো বানানো হয়েছে জঙ্গলের এপাশ থেকে ওপাশে হাতি, ভালুকসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীদের অবাধ চলাচলের জন্য। কি চমৎকার ব্যবস্থা! যতদূর চোখ যায় কেবল সারি সারি পাইন গাছ দেখা যায়। আর তারই মাঝে কখনো দূরে দেখা যায় বিশাল বিশাল ত্রিভুজাকৃতির পাহাড়। পাহাড়গুলোর শুরু দেখা যায়, শেষ দেখা যায় না। কখনোবা আবার বিশাল পাহাড়ের সামনে রাস্তার সাথে লাগোয়া লেক পড়ছে, কখনোবা আবার নদী। কী অপূর্ব দৃশ্য! লগ্ন পাহাড় ভালোবাসে। বাংলাদেশ ও ভারতের অনেক পাহাড় তার ঘোরা হয়েছে। কিন্তু এমন বিশালত্ব সে খুব কমই দেখেছে। মনপ্রাণ ভরে যাচ্ছে তার। হঠাৎ সে একটা হাত বাড়িয়ে নাদভির হাত ধরল।
নাদভি তাকাতেই সে বলল, ‘থ্যাংক ইউ সো মাচ। শুধু এই সৌন্দর্যটা দেখার জন্যই গাড়িতে আসতে চেয়েছিলাম। নাদভি হেসে আবার ড্রাইভিংয়ে নজর দিলো।
বলল, ‘তোমার এই খুশি দেখার জন্য আমি দুদিন কেন টানা দুমাস গাড়ি চালাতে পারব।’
লগ্ন অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘মাত্র দুমাস?’
নাদভি হেসে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে লগ্নও হেসে দিলো।
বেলা এগারোটা নাগাদ তারা পৌঁছল ব্যানফ শহরে। এখন শহর ঘুরলে দেরি হয়ে যাবে। পরে শহর ঘুরবে বলে এখন সরাসরি ক্যাম্প গ্রাউন্ডের দিকে চলে গেল।
তারা বুকিং দিয়েছিল লেক লুইস ক্যাম্পগ্রাউন্ডে। সেখানে পৌঁছে দুজনেরই চোখ কপালে উঠে গেল। তাদের ক্যাম্পসাইটের পাসে দিয়েই বয়ে চলেছে খরস্রোতা পাথুরে নদী। নাম তার বো। নদীর ওপারে পাইন গাছের জঙ্গল আর ডান পাশে পাইন গাছের আড়ালে মপ্ত সব পাহাড়ের লুকোচুরি খেলা। লগ্ন নদীর পাড়ে গিয়ে পা ভেজাল। কনকনে ঠান্ডা পানি! দ্রুত পাড়ে উঠে এলো সে। নাদভি প্রকৃতির চেয়ে বেশি উপভোগ করছে লগ্নর উচ্ছ্বাস।
লগ্ন বলল, ‘কী কেমন লাগছে? মনে হচ্ছে না শাস্তিটা পেয়ে বরং জিতে গেছ?
নাদভি হো হো করে হেসে উঠল।
ক্যাম্পগ্রাউন্ডে টয়লেট, গোসল, খাবার পানি সবকিছুর সুব্যবস্থা আছে। প্রতিটি ক্যাম্পসাইটে ডাইনিং এরিয়া হিসেবে ব্যবহারের জন্য কাঠের টেবিল ও তার দুপাশে দুটি বেঞ্চ তৈরি করা আছে, এছাড়াও আছে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা। আছে ইলেকট্রিক সাপ্লাইও। তাই ফোন ল্যাপটপ চার্জ দেওয়া নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। এমনকি চাইলে লাইটের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।
ক্যাম্পগ্রাউন্ডে আগুন জ্বালানোর জন্য কাঠ কেটে রেখে দেয়। যদিও টুকরোগুলো অনেক বড় বড় থাকে। সেগুলো এনে ছোট ছোট টুকরো করে নেয়। নাদভি সদ্য কেনা কুড়াল দিয়ে জীবনে প্রথম কাঠ কাটল প্রথমদিকে একটু অসুবিধা হলেও পরে অভ্যস্ত হয়ে গেল। ক্যাম্পসাইটে আগুন জ্বালানোর জন্য একটা হাফ ড্রামের মতো বস্তু দেওয়া থাকে। যার ভেতরে কাঠের টুকরো দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়। ওপরে একটা রডের ঢাকনার মত থাকে। আগুন পোহানো ছাড়াও চাইলে এর ওপর রান্না করা যায়। অনেকে আবার চুলা নিয়ে আসে। তবে ওরা এই আগুনেই রান্না করবে। নাদভি আগুন জ্বালিয়ে দিলো। তারপর গেল খাওয়ার পানি আনতে। পানি এনে তাঁবু টানাতে শুরু করল। এরমধ্যে লগ্ন রান্নাবান্নার জিনিসপত্র বের করল। যাতে দ্রুত রান্না হয় তাই সে চট করে একটা পাত্রে খিচুড়ি বসিয়ে দিলো। কষানোর ঝামেলায় যায়নি, মসলা মেখে পানি দিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। তারপর নাদভিকে তাঁবু টানানোতে সাহায্য করল। তাঁবু টানানো হয়ে যেতেই নাদভি লগ্নকে সাহায্য করতে এলো। খিচুড়ি প্রায় হয়ে এসেছে। লগ্ন বেগুন ভাজার জন্য বেগুন কাটছিল। এরমধ্যে নাদভি ডিম ভাজার জন্য পেঁয়াজ মরিচ কেটে দিলো। ভাজাভুজি হতে হতে খিচুড়ি পুরোপুরি হয়ে গেল। এরপর দুজনে খেতে বসল।
নাদভি খিচুড়ি মুখে দিয়েই বলল, ‘আহ এটা তোমার সেরা রান্না।’
লগ্ন হেসে বলল, ‘বলেছে তোমাকে। আসলে যে এত কাজ করে খিদেয় মরে যাচ্ছিলে এটা বলছ না।’
নাদভি হেসে বলল, ‘এত কাজ করে খিদে পেয়েছে এটা সত্যি। কিন্তু রান্নাটাও ভালো হয়েছে। সঙ্গে আছে এমন অবিশ্বাস্য সুন্দর প্রকৃতি। খাবার মজা না লেগে উপায় কী?’
‘এটা ঠিক। এত সুন্দর জায়গায় বসে যা খাব তাই বোধহয় ভালো লাগবে।’
বিকেলটা কফি হাতে নদীর পাড়ে বসে কাটিয়ে দিলো দুজনে। কতশত গল্প হলো! সূর্য ডোবার পরে এখানে আর করার তেমন কিছু নেই। শরীরও ক্লান্ত তাই যার যার তাঁবুতে ঢুকে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর লগ্ন ফোন করল।
নাদভি ধরল, ‘হ্যালো।’
লগ্ন আমতা আমতা করে বলল, ‘একবার আমার তাঁবুতে আসবে?’
‘আসছি।’
নাদভি লগ্নর তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে ডাক দিতেই লগ্ন তাবুর চেইন খুলে দিলো। নাদভি ভেতরে আসতেই লগ্ন তাকে বসতে বলল। বাইরে যে ক্যাম্পিনিং চেয়ারে তারা বসেছিল সেই চেয়ারই এখন ঘরে এনে রেখেছে।
নাদভি সেখানে বসে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার?’
লগ্ন মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘তোমার বেডটা এই তাঁবুতে নিয়ে এসো।’ নাদভি অবাক হয়ে বলল, ‘কেন, তোমার ভয় লাগছে?’
লগ্ন এবার ধমকে উঠল, ‘কেন, এই জঙ্গলের মধ্যে ভয় লাগাটা কি অস্বাভাবিক?’
‘না, তা না। কিন্তু তাহলে দুটো তাঁবু আনার মানেটা কী হলো?’
এবার লগ্ন চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আরে তখন কি জানতাম নাকি সন্ধ্যার পর এমন গা ছমছমে অনুভূতি হবে?
নাদভি মুচকি হেসে বলল, ‘আচ্ছা নিয়ে আসছি।’
‘এই, এই তুমি হাসলে কেন? এতবড় সাহস তোমার?’
‘কই না তো, হাসিনি।’
নাদভি তাঁবু থেকে বেরিয়ে একা একাই হাসল। তারপর তার বেড ভাঁজ করে লগ্নর তাঁবুতে নিয়ে এলো। সঙ্গে প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র। বিছানা গুছিয়েই কম্বল টেনে শুয়ে পড়ল সে। কিছুক্ষণ পর লগ্ন ডাকলো, ‘নাদভি ঘুমিয়ে পড়েছ?’
‘না।’
‘তোমার মনে আছে একটি রাত কি অবলীলায় তোমার বুকে মাথা গুঁজে ঘুমিয়েছিলাম।
নাদভি বলল, ‘মনে থাকবে না কেন? আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন আর কষ্টের রাত ছিল যে সেটা।’
‘আর আমার জীবনের স্বপ্নের। রাত পেরোতেই স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।’
‘আম সরি লগ্ন।’
লগ্ন আর কথা বলে না। চোখের জলে ভিজে যেতে থাকে তার বালিশ নাদভি উশখুশ করতে থাকে। আর কোনো কথা বলার সাহস পায় না।
·
·
·
চলবে..........................................................................