লগ্নজিতা - পর্ব ০৯ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          লগ্নর মাস্টার্সের অ্যাডমিশন হলো ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনে। এই ইউনিভার্সিটি আমেরিকার ওয়াশিংটন স্টেটের সিয়াটল শহরে অবস্থিত। দেশ ছেড়ে যাবার সময় যখন প্লেনে চেপে বসে সবারই হয়তো মন খারাপ হয়, কিন্তু লগ্নর মনে হলো এতদিনে সে শ্বাস নিতে পারছে। তার প্রিয় শহর আর সেই শহরের মানুষগুলো তাকে শ্বাস নিতে দিচ্ছিল না।

—————

কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ি নয়, লগ্ন সরাসরি সিয়াটলে নেমে আগে থেকে বুক করে রাখা এক কামরার একটি এয়ারবিএনবিতে উঠল। আত্মীয় বন্ধুদের আহা উহু শোনার মতো কোনো ইচ্ছে তার নেই।

প্রথম দুটো দিন ঘুমিয়েই কেটে গেল। এরপর বের হলো বাসা খুঁজতে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে একটা এক কামড়ার স্টুডিও এপার্টমেন্ট পেয়ে গেল। অ্যাপার্টমেন্টটা একটু পুরোনো। এই ভাড়াতেই সে ঝকঝকে তকতকে বাসায় উঠতে পারত তবে সেক্ষেত্রে নিজস্ব কামরা হয়তো থাকত, কিন্তু ফ্ল্যাট শেয়ার করতে হতো। সেটা চায় না সে। আজকাল মানুষজন ভালো লাগে না তার। একা থাকতেই সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

নতুন বাসায় উঠে ফার্নিচার বলতে একটা ম্যাট্রেস আর বালিশ ছাড়া কিছুই কিনল না লগ্ন। রান্নাঘরের টুকিটাকি জিনিসপত্র দেশ থেকেই নিয়ে এসেছিল। প্রয়োজনের সব জিনিসই তার কাছে আছে। আরাম আয়েশ, বিলাসিতা আর শখের জিনিস নিজের উপার্জনে কিনবে। এমনিতেই বাবার ওপর অনেক চাপ পড়ে গেছে। এখন পার্ট টাইম চাকরি খুঁজছে সে। সিয়াটলের মতো ব্যস্ত শহরে কাজের অভাব হবে না বলেই তার বিশ্বাস।

লগ্নর ক্লাস শুরু হতে আরো সপ্তাহখানেক বাকি। বাসা খোঁজা ও গোছানো হয়ে গেছে। এখন ক্লাস শুরু হওয়ার আগ অবধি অফুরন্ত সময় তার। তাই গুগল ম্যাপে দেখতে লাগল আশেপাশে কী আছে। তখন দেখে লেক ওয়াশিংটন তার বাসার খুবই কাছে। ১৫ মিনিটের হাঁটা পথ। ব্যস বেরিয়ে পড়ল। ম্যাপ ধরে যখন লেকের পাড়ে পৌঁছল তখন নিজেই অবাক হয়ে গেল। নীল জলরাশির ওপাড়ে ছোটবড় কত পাহাড়। আর সে যে তীরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে অযত্নে ফুটে রয়েছে অজস্র ডেইজি ফুল। এই সৌন্দর্য নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা দায়। হঠাৎ করে লগ্নর মনে হলো জীবনে হিমেল, ইফতি কিংবা নাদভি সব মিথ্যে। এই মুহূর্তটাই কেবল সত্যি!

ফেরার পথে একটা কফিশপে বারিস্তা লাগবে এমন একটা বিজ্ঞাপন দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো এক্সপেরিয়েন্স না থাকলেও চলবে, কিন্তু বারিস্তা কোর্সের সার্টিফিকেট থাকা লাগবে। যেহেতু এধরনের কিছু তার নেই তাই সে বেরিয়ে গেল। সে বের হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই একটা মেয়েও বের হলো কফিশপ থেকে।

মেয়েটা ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি ইন্ডিয়ান?’

লগ্ন জানাল সে বাংলাদেশি। মেয়েটি এবার হেসে পরিষ্কার বাংলায় বলল, ‘আমি কলকাতার’

তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, ‘সঙ্গীতা।’

লগ্ন মেয়েটির সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘আমি লগ্নজিতা।’

দুজনে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিল। সঙ্গীতা বলল, ‘তুমি নতুন এসেছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘এখানে সরকার থেকে নিউকামারদের জন্য ফ্রিতে বিভিন্নরকম কোর্সের ব্যবস্থা রয়েছে। সেখান থেকে বারিস্তা কোর্স করে নিতে পারো। আমি এই কফিশপে কাজ করি। সার্টিফিকেট ছাড়া নেবে না ঠিক আবার শুরুতে সবটা নিজেরাই শিখিয়ে নেবে। তাই কোনোরকম একটা কোর্স করা থাকলেই হবে। কিংবা অন্যকিছুতে ইন্টারেস্টেড থাকলে সেসবও করে নিতে পারো। জব পেতে সুবিধে হবে।’

‘তাই নাকি? তাহলে তো খুবই ভালো হয়।’

সঙ্গীতা ওয়েবসাইট অ্যাড্রেসটা লিখে দিয়ে দ্রুত পা চালাল, তার বাসের

সময় হয়ে এসেছে।

লগ্ন বাড়ি ফিরে ওয়েবসাইট চেক করে দেখে নানান পদের কোর্স। কোনটা রেখে কোনটা করবে! যেহেতু ফ্রি তাই সে দুটো কোর্স নিল। একটা বেকিং আরেকটা ফ্রেঞ্চ ভাষা। বেকিংয়ের কোর্সটা স্বল্পমেয়াদি ফ্রেঞ্চের আবার অনেকগুলো ধাপ। ৩ মাস থেকে শুরু করে ২ বছর পর্যন্ত অনেকগুলো ধাপ আছে। যার যতটা ইচ্ছে শিখতে পারে। একটা বাড়তি ভাষা শেখার ইচ্ছে তার অনেকদিনের। এবার সুযোগ পেয়ে সেই ইচ্ছেটাকেই জাগ্রত করল আবার। পড়াশোনা ও কাজের চাপ বুঝে নাহয় কোর্সগুলো করা যাবে। ক্লাস শুরু হওয়ার পর লগ্ন বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বেকিংয়ের কোর্সটা শেষ হওয়ার তিন দিনের মাথাতেই সে একটা বেকারিতে পার্ট টাইম জব পেয়ে যায়। এরপর থেকে তার সময় যে কোনদিক দিয়ে যায় নিজেও টের পায় না।
·
·
·
চলবে.........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp