লগ্নজিতা - পর্ব ০৩ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অনিশ্চিত। যে লগ্ন বিয়ের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, সে এখন অপেক্ষার প্রহর গুনছে। সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেয় বিয়েতে সম্মতি দিয়েছে। প্রথম দেখার পর থেকে প্রতিদিন ইফতির সাথে ফোনে কথা হচ্ছে। ঘন ঘন দেখাও হচ্ছে। নতুন জীবন শুরুর আগে যতটা সম্ভব দুজন দুজনকে জেনে নেওয়া। ইফতিকে যত দেখছে মুগ্ধ হচ্ছে লগ্ন। মনে হয় যেন আল্লাহ তাকে ওরই জন্য ওর মনের মতো করে সৃষ্টি করেছেন।

আগামীকাল সকালে লগ্ন বন্ধুদের দাওয়াত দিতে রাজশাহী যাবে। তবে এর কোনো দরকার ছিল না, বন্ধুবান্ধবদের ফোনে দাওয়াত দিলেই যথেষ্ট। কিন্তু এই সাড়ে চার ঘণ্টার রাস্তায় ইফতিকে সঙ্গী করতে ইচ্ছে করছে। তাদের যতবার দেখা হয়েছে বড়জোর ঘণ্টাখানেকের জন্য দেখা হয়েছে। এই একটা সুযোগ দীর্ঘ সময় একসাথে কাটানোর। তার যদি লজ্জাশরম একটু কম থাকত, তাহলে অবশ্যই বাবা-মাকে বিয়ের দিন এগিয়ে আনার জন্য অনুরোধ করত। একটা মানুষ নতুন বউকে রেখে বিয়ের পনেরো দিন পরেই তেরো হাজার কিলোমিটার দূরে চলে যাবে, এ কেমন নিষ্ঠুরতা?

ফোনের ওপাশে রিং হচ্ছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ইফতির গলা পাওয়া গেল, ‘হ্যালো।’

‘আগামীকাল সকালে ফ্রি আছ?’

ইফতি হেসে বলল, ‘তুমি বললে ফ্রি থাকব।’

লগ্ন ইতস্তত করে বলল, ‘না। ব্যস্ততা থাকলে দরকার নেই। বিয়ের আয়োজন করছো, ব্যস্ততা থাকতেই পারে।’

‘আগে বলবে তো কী বিষয়? দেখা করতে চাও?’

লগ্নর লজ্জা লাগছিল এভাবে বলতে। তবু সময় চলে গেলে আর ফিরে আসবে না। লজ্জাশরম বিসর্জন দিয়ে সে স্পষ্ট গলায় বলার চেষ্টা করল, ‘আমি কাল রাজশাহী যাব। তোমার সময় থাকলে আমার সাথে যেতে পারো। একা যাচ্ছি।’

ইফতি উত্তেজিত হয়ে বলল, আরে বাপরে! এমন লোভনীয় প্রস্তাব কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়?’

লগ্ন ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল, ‘লোভনীয় মনে হলো কেন?’

ইফতি হেসে বলল, ‘দেখো প্রেম এক জিনিস, আর বিয়ে আরেক জিনিস, বিশেষ করে এরকম অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। প্রেমে এখনই পাওয়া সম্ভব। বিয়েতে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। অপেক্ষা করতে করতে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। এমন অপেক্ষার খরাময় দিনে তোমার সাথে এত দূরের যাত্রার প্রস্তাব অবশ্যই লোভনীয়।’

লগ্ন লজ্জা পেয়ে মুখ টিপে হাসল। তবে ধরা দিলো না।

স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘তাহলে কাল ভোরে চলে এসো। ভোরে রওনা না হলে সব কাজ শেষ করে কালই ফিরতে পারব না।’

‘ছ’টায় রওনা দিলে হবে?’

‘হবে। এক ঘণ্টায় ঠাকুরগাঁও থেকে অনায়াসে চলে আসতে পারবে। আমি আগে থেকে তৈরি থাকব। তুমি এলেই রওনা হব।’

রাজশাহীর সব বন্ধুদের বিয়ের দাওয়াত দেওয়া শেষ করে লগ্ন ও ইফতি দুপুরের খাবার খেতে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল। খাওয়াদাওয়া শেষ করে বের হওয়ার পর রেস্টুরেন্টের সামনেই একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটল। ইফতির কথায় লগ্ন হো হো করে হাসছিল। ঠিক সেই সময়েই হিমেলের সাথে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। হিমেল অবাক চোখে তাকাল ইফতির দিকে।

তারপর লগ্নর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাহ ভালোই আছ দেখছি।’

লগ্নর প্রচণ্ড রাগ লাগল। সে বলল, ‘তুমি ভালো থাকতে পারলে আমি কেন পারব না?’

হিমেল তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘তোমার বান্ধবীদের কাছে শুনেছিলাম আমাকে হারিয়ে অনেক শোকে আছ। এই তোমার শোকের নমুনা!’

ইফতি জানে না এই লোক কে, কী চায়। তবে আন্দাজ করতে পারছে। এর কথাবার্তার ধরন ভালো লাগেনি। লগ্নর বিরক্তিও তার চোখ এড়ায়নি।

তাই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নিজে নেওয়ার জন্য ইফতি বলল, ‘এক্সকিউজ মি। কী সমস্যা আপনার?’

হিমেল বলল, ‘আমি আপনার সাথে কথা বলছি না।’

ইফতি দৃঢ় গলায় বলল, ‘কিন্তু আমি আপনার সাথে কথা বলছি। কারণ আপনি আমার হবু স্ত্রীর সাথে উঁচু গলায় কথা বলছেন।’

হিমেল কড়া গলায় বলল, ‘আপনার হবু স্ত্রী আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল। আমি তাকে যা খুশি বলতে পারি।’

ইফতি মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘যখন ছিল তখন বলেছেন। এখন নেই। এখন তার সাথে উঁচু গলায় কথা তো দূরে থাক, নিচু গলায় কথা বলতেও আমার অনুমতি নিতে হবে।’

ইফতির কথায় লগ্ন মনে সাহস পেল।

সে কড়া গলায় বলল, ‘কী ভেবেছিলে? তুমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করে ফেলার পর আমি তোমাকে পরকীয়ার প্রস্তাব দেবো?’

হিমেল আর একটি কথাও না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে লগ্ন জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার জানতে ইচ্ছে করছে না এই অসভ্যটাকে আমি কীভাবে ভালোবেসেছিলাম?’

ইফতি ঠোঁট উলটে বলল, ‘না তো।’

‘কেন?’

‘ভালোবাসা তো এমনই। কোনো যুক্তি থাকে না।’

লগ্ন আর কিছু বলল না। সত্যিই তো। ভালোবাসা ব্যাপারটাই খুব অযৌক্তিক।

ইফতি একটু থেমে বলল, ‘আমারও ছিল এমন অযৌক্তিক ভালোবাসা। তাই খুব ভালোভাবেই বুঝি।’

ইফতিও তারই মতো ধোঁকা খাওয়া দলের লোক জেনে কেমন মায়া হচ্ছে লগ্নর, আহারে! কিন্তু ইফতি হিমেল সম্পর্কে একটা বিষয়ে জিজ্ঞেস না করলেও, ইফতির পুরোনো প্রেমিকা সম্পর্কে তার একশোটা বিষয় জানতে ইচ্ছে করছে। নারী মন কী অদ্ভুত!
·
·
·
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp