পেট্রা প্রিয়র সবগুলো গোপন নম্বরে ফোন করেছে, সব বন্ধ। অফিসে ফোন করে জানল সে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। সব বন্ধুবান্ধবের কাছেও খোঁজ নিয়েছে। কেউ কিছু জানে না। অদ্ভুত মানুষ একটা। যেহেতু ছেলেটা সাথে আছে, সেহেতু যেখানেই যাক, তাকে তো বলে যাওয়া উচিত ছিল। নানা রকম দুশ্চিন্তা মনে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। ওরা যেখানেই থাকুক, যেন ভালো থাকে।
—————
মোবাইল ও ল্যাপটপে পেট্রার যত ছবি ও কল রেকর্ডিং ছিল, সবকিছুর ব্যাকআপ ছিল। প্রিয় সব রিকভার করে নিল। আফসোস লাগছে, চিঠি এবং ওর সাথে কাটানো মুহূর্তের অসংখ্য স্মৃতিবিজড়িত জিনিসগুলোর জন্য।
প্রিয় শুদ্ধকে নিয়ে কক্সবাজার সিটিতে গিয়ে দুজনের জন্য কিছু কাপড়চোপড় কিনে আনল। প্রতিদিন বাবা-ছেলে মিলে সমুদ্রে গোসল করে, ইচ্ছেমতো ডাব খায়, সন্ধ্যা হলেই কাঁকড়া আর গলদা চিংড়ি খেতে যায়, অনেক রাত পর্যন্ত বার্মিজ মার্কেটে ঘোরে। এভাবে ওদের দিন ভালোই কাটছিল। খুব খুশি শুদ্ধ। প্রিয়র মনে হলো নানান ঝামেলায় শুদ্ধকে নিয়ে অনেক দিন কোথাও যাওয়া হয় নি কিন্তু যাওয়া উচিত ছিল। এটুকুতেই ছেলেটা এত খুশি!
ঢাকা থেকে আসার সময় ৫০ হাজার টাকা তুলে এনেছিল প্রিয়। একদিন লাঞ্চ করে রেস্টুরেন্টে বিল দিতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল টাকা প্রায় শেষ। হোটেলে আজকের বিল দেওয়া হয় নি। তাই এটিএম বুথ থেকে কিছু টাকা তুলল। টাকা তুলে হোটেলের উদ্দেশে রিকশা নিতেই খেয়াল হলো একটা বড় রকমের ভুল করে ফেলেছে। বাবর খান তার ক্ষমতার বলে বের করে ফেলবে কোন বুথ থেকে টাকা তোলা হয়েছে। কক্সবাজারে আছে জানলে ওদের বের করা তার দুই মিনিটের কাজ। তা তিনি যেখানেই থাকুক না কেন।
রিকশা ঘুরিয়ে ব্যাংকে গেল প্রিয়। আরও ৫০ হাজার টাকা তুলল। আজই কক্সবাজার ছাড়তে হবে। সে জানে তার বাবার হাত ও মাথা দুটোই তার থেকে বেশি লম্বা। যাতে বিয়ে না করতে হয়, সে জন্য একবার সে দেশের বাইরে চলে যেতে চেয়েছিল। বাবর খানের জন্য ভিসা পেল না। পরেরবার জাল পাসপোর্ট বানিয়ে যেতে চাইল। এয়ারপোের্ট থেকে বাবর খানের লোকজন ধরে আনল। তাই এবার আর সেই ভুল করবে না। দেশেই থাকবে। ধরা তো পড়তেই হবে, তবে এবার বাবাকে ভালো করে ঘোল খাইয়ে ছাড়বে।
রেন্ট-এ-কার থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করল প্রিয়। হোটেলে ফিরে যাবতীয় বিল পরিশোধ করল। তারপর ল্যাপটপ, মোবাইল, কাপড়চোপড় নিতে রুমে গেলে শুদ্ধ জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, এত তাড়াহুড়া করছ কেন? কী হয়েছে?
‘বাপ প্লিজ, কিছুক্ষণ চুপ করে থাক। কক্সবাজার ছেড়ে তোর সব প্রশ্নের উত্তর দেব।
শুদ্ধ বুঝল সিরিয়াস কিছু হয়েছে। সব গুছিয়ে শুদ্ধকে নিয়ে নিচে নামতেই ধাক্কা খেলো প্রিয়। সঙ্গে সঙ্গে বড় একটা পিলারের পেছনে লুকিয়ে পড়ল। রিসেপশনে কয়েকজন লোক ওদের খুঁজছে। কথাবার্তায় সেটাই বোঝা যাচ্ছে। লোকগুলো সরাসরি রুমে যেতে চাচ্ছে। হোটেলের ম্যানেজার তাদের ওয়েটিং রুমে বসতে বলছে। এই নিয়ে তর্কাতর্কি চলছে। বের হতে হলে ওদের সামনে দিয়েই বের হতে হবে। ইশ, কেন সে আবার হোটেলে ফিরতে গেল! নিজের ওপর নিজেরই রাগ লাগছে এখন। হঠাৎই প্রিয়র মাথায় এই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা বুদ্ধি এল। আবার ফিরে গেল নিজের রুমে গিয়ে রিসিপশনে কল করে বলল, ‘আমার খোঁজে কেউ এসেছে?
‘জি স্যার। আমি এতক্ষণ ফোন করছিলাম আপনাকে।
‘হ্যাঁ, আসলে আমি ছেলেকে গোসল করাচ্ছিলাম। তাই ফোন ধরতে পারি নি। আপনি ওনাদের রুমে পাঠিয়ে দিন।
‘সরি স্যার, বাইরের গেস্টদের রুমে যাওয়ার অনুমতি নেই। আমি তাদের বলেছি ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে কিন্তু তারা রিসিপশন থেকে নড়ছেনই না। দয়া করে আপনি একটু আসবেন?
‘শিওর। আমি আসছি।’
ফোন রেখে প্রিয় ভাবতে লাগল কী করবে সে এখন। সে ভেবেছিল ওই লোকগুলোকে রুমে পাঠালে, রিসিপশন ফাঁকা হবে এবং সে বেরিয়ে যাবে।
এবার তো পড়ল মহাবিপদে। এত সহজে ধরা পড়ে যাবে? এসব আবোলতাবোল ভাবছিল যখন, তখনই রুম সার্ভিসের লোক এল।
‘স্যার, আপনাকে একটু নিচে যেতে হবে।’
প্রিয় ছেলেটার হাতে দশ হাজার টাকা দিয়ে বলল, ‘যেভাবে হোক, আমাকে হোটেল থেকে বের করে দাও। ভয় পেয়ো না, আমি কোনো অসৎ কাজ করি নি। বাড়ি থেকে পালিয়েছি। তাই বাবা লোক পাঠিয়েছে ধরে নেওয়ার জন্য। তুমি নিচে গিয়ে বলবে আমরা রুমে নেই। ভয় পেয়ো না, তুমি ফাঁসবে না।
বাবার কথা শুনে শুদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিন্তু কিছু বলল না। রুম সার্ভিসের ছেলেটা বলল, ‘স্যার, পুরো হোটেল সিসি ক্যামেরার আওতায়। আমি অবশ্যই ফেঁসে যাব।’
‘রুমের মধ্যে তো আর সিসি ক্যামেরা নেই। তুমি টাকাটা নাও আর আমাকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা বলে দাও।’
ছেলেটা কিছুক্ষণ ভেবে টাকাটা নিল। তারপর বলল, এই রুম থেকে বের হয়ে ডান দিকের একদম শেষপ্রান্তে একটা ইমার্জেন্সি সিঁড়ি আছে। ওটা দিয়ে নামলেই হোটেলের লন পড়বে। ঘোরাঘুরি করছেন, এমন ভাব করে বেরিয়ে যাবেন।
‘থ্যাংকস আ লট।
‘কিন্তু স্যার, আরেকটা সমস্যা রয়ে গেল। এতক্ষণ খেয়াল ছিল না আমার।
‘কী?
‘আমি যে রুমে ঢুকেছি, সেটা তো সিসি ক্যামেরায় রেকর্ড হয়েছে। আপনি বের হবেন, ওটাও রেকর্ড হবে। পরে তো জানাজানি হবেই যে আপনার পালানোর সাথে আমি জড়িত ছিলাম। আমাকে ছেড়ে দিন। স্যার।’
‘ঠিকাছে, আমি তোমাকে বেঁধে রেখে যাই। তাহলে আর কেউ তোমাকে সন্দেহ করবে না।
ছেলেটা অবাক হয়ে বলল, ‘জি স্যার?
নিজের শার্ট দিয়ে প্রিয় ছেলেটার মুখ বাঁধতে বাঁধতে বলল, তোমার কোনো ভয় নেই, আমি হোটেলের সব বিল একটু আগেই শোধ করে এসেছি। হোটেল ক্ষতিগ্রস্ত না হলে ব্যাপারটা নিয়ে অত মাথা ঘামাবে না। তা ছাড়া আমি কোনো উগ্রপন্থী নই। খারাপ লোকও নই। কোনো অন্যায় করেও আসি নি।
হোটেলের বিছানার চাদরটা তুলে সেটা দিয়ে ছেলেটার হাত দুটো জানালার গ্রিলের সঙ্গে বেঁধে দিল প্রিয়। তারপর ছেলেটার বলা রাস্তা দিয়ে শুদ্ধকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
—————
ভাড়ার গাড়িটা দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে। কক্সবাজারের থেকে বেরিয়ে এসেছে অনেকক্ষণ হলো। শুদ্ধ চুপ করে আছে। সে কিছুক্ষণ আগে অল্প সময়ের মধ্যে বাবাকে অনেকগুলো অন্যায় কাজ করতে দেখেছে। অথচ তার বাবাই বলে, কখনো অন্যায় কাজ করবে না। এতকিছু কেন হলো তাকে জানতে হবে। সে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, আমরা বাড়ি থেকে পালিয়েছি এটা আমাকে আগে বললে না কেন?
‘বললে তুই কারণটা জানতে চাইবি আর জানলে কাঁদবি, তাই বলি নি।
বলো, আমি কাঁদব না।’
ছেলেটা হয়তো এসব দেখে তাকে ভুল বুঝছে তাই প্রিয় ভাবল, কষ্ট পেলে পাক। সত্যিটা জানার অধিকার ওর আছে। তাই বলল, ‘নিকিতার ওপর রাগ করে বেরিয়েছি। তোর দাদা আমাদের খুঁজছে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। তাই পালাচ্ছি।’
‘নিকিতা মার ওপর রাগ করেছ কেন বাবা? নিকিতা মা তো ভালো। আমাকে অনেক আদর করে।’
‘তোর মায়ের চিঠিগুলোর কথা মনে আছে তোর?
‘হ্যাঁ, এত্ত এত্ত চিঠি। কী সুন্দর হ্যান্ডরাইটিং!
‘আর ড্রয়ারে রাখা জিনিসগুলো? যেগুলো আমরা দুজন মিলে দেখতাম?
‘হ্যাঁ, সব মনে আছে তো বাবা। মায়ের গন্ধমাখা সব জিনিস।
‘নিকিতা সব পুড়িয়ে দিয়েছে। এখন তুই বল, যেখানে নিকিতা থাকবে সেখানে কি আমাদের থাকা উচিত?
কথা শেষ করে উত্তরের জন্য ছেলের দিকে তাকাল প্রিয়। শুদ্ধ উত্তর দিতে পারল না। সে কাঁদছে।
·
·
·
চলবে...................................................................................