নিহিন একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে কিছুদিন আগেই। ক্লাস শেষ করে ফ্যাকাল্টি রুমে ঢুকে নিজের ডেস্কে গিয়ে বসলো। রুমে এ মুহূর্তে ও একা। ইদানীং একা হওয়াকে রীতিমত ভয় পাচ্ছে নিহিন। আশপাশে কেউ থাকলে তার সাথে কথাবার্তা বলা যায়। কিন্তু একা থাকলেই ওই মানুষটার চিন্তা ভর করে মাথায়। যেকোনো মূল্যে কলরবকে খুঁজে বের করতেই হবে। শুধু একবার দেখা বা কথা হলেই চলবে। কিন্তু ওকে খুঁজে বের করার কোনো উপায় নিহিনের জানা নেই। অনেক ভেবেও কোনো কূলকিনারা করতে পারল না। ওর ডেস্কে একটা পাতাবাহার গাছ, সেদিকেই তাকিয়ে আছে। ছোটোবেলা থেকেই পাতাবাহার খুব প্রিয় ওর। তাই কলরব ওর বারান্দায় বাঁশের চোঙে অনেক অনেক পাতাবাহার লাগিয়েছিল!
ফোনটা তুলে তিথিকে কল করল নিহিন, “হ্যালো.. তিথি?”
“হ্যাঁ নিহিন বল।
“তোর সাথে খুব জরুরি একটা কথা আছে।”
“বলে ফেল।”
“তুই কি এখন অফিসে?”
“না বের হয়ে গেছি, এখন রিকশায় বাসায় ফিরছি, কী হয়েছে বলবি তো!”
“তাহলে বাসায় যা, তারপর বলি।”
“আরে ব্যাটা প্রব্লেম নাই, তুই বল তো!”
“তোর কি কলরবের কথা মনে আছে?”
“কলরব? দাঁড়া, পরিচিত লাগছে নামটা কিন্তু মনে করতে পারছি না। কে জানি পোলাডা?”
“আমার একটাই বয়ফ্রেন্ড ছিল তিথি। পাশের বাসায় থাকত যে।”
“তুই ওই ভীতুর ডিমটার কথা আবার মনে করছিস? আংকেলের ঝাড়ি খাইয়া পালাই গেছিল যে!”
“আগে আমার কথা শোন…”
“না, আমি তোর কোনো কথাই শুনব না তার সম্পর্কে। সাহস থাকলে ঠিকই তোর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করত কোনো না কোনোভাবে। তা না করে নিজের ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছিল। পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলি তুই। কিছু ভুলিনি আমি। যতদিন মনে থাকবে ততদিন আমি কোনো কথা শুনতে চাই না ওর ব্যাপারে।”
ফোন কেটে দিলো তিথি। নিহিন জানে এখন আবার ফোন দিয়ে লাভ নেই, কিছু শুনতে চাইবে না ও। তাই বাবা আর কলরবের মধ্যে কী কথা হয়েছিল তা লিখে একটা মেসেজ পাঠাল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিথি কল করল।
“নিহিন, কী বলছিস তুই? এগুলো সব সত্যি?”
“হুম, বাবা নিজেই সব বললেন কালকে। “তুই কোথায়?”
“অফিসে।”
“তুই থাক, আমি রিকশা ঘুরিয়ে চলে আসছি।”
“না, তুই বাসায় যা। আমি তোর বাসায় আসছি। ক্লাস শেষ।”
“আচ্ছা, আয় তাহলে।”
নিহিন পৌঁছতে পৌঁছতে তিথি ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। কফি হাতে বারান্দায় বসলো দুই বান্ধবী। তিথি বলল,
“আংকেল এমনটা কেন করলেন?”
“সেটাই স্বাতাবিক না? তখন কত বাচ্চা ছিলাম। কত আর ১৫ বছর বয়স ছিল আমার। ওই বয়সের প্রেম কেউ মানে?”
“আচ্ছা না মানল, কিন্তু ওকে কথা দিলেন কেন যে ওর সাথেই তোকে বিয়ে দেবে?”
“বাবা প্রথমে ওকে বলেছিলেন ও যাতে আমার সাথে আর কোনো যোগাযোগ না করে, কারণ উনি এগুলো এলাউ করেন না। এটা শুনে নাকি কলরব বলেছিল ও আমাকে বিয়ে করতে চায়। তারপর বাবা বলেছিলেন, তুমি এখনও স্টুডেন্ট, বিয়ে করবে কীভাবে? আর আমি আমার মেয়েকে তোমার সাথে বিয়ে দেবো কী দেখে? তার চেয়ে এসব বাদ দিয়ে আগে নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবো। তখন কলরব বলেছিল, ও প্রতিষ্ঠিত হয়েই আসবে বিয়ে করার জন্য। তবু ও আমাকেই বিয়ে করবে। তখন বাবা শর্ত দিয়েছিলেন যে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না। করলে বাবা ওকে আর মানবেন না।”
“আর আংকেল এসব কথার কিছুই জানাননি তোকে, তাইতো?”
“হুম। আসলে ও গান গাইত যা বাবা পছন্দ করতেন না। পরাশুনাও করছিল বিবিএ, সাধারণ একটা প্রাইভেট ইউনিভারসিটিতে। সবসময় বড় বড় চুল, মুখভর্তি দাড়ি। বাবার ওকে পছন্দ ছিল না। তুই তো জানিস বাবা কতটা ফরমাল!”
“হুম আর্মিম্যানদের নিয়ে এই এক সমস্যা। তাই বলে সে তোর সাথে কোন যোগাযোগ করবে না? করলে কি আর আংকেল টের পেতেন?”
“ও তো এমনই ছিলরে। খুব অনেস্ট।”
“এত অনেস্টি খালি বাংলা সিনেমায় মানায়, বাস্তবে না। রাগ লাগছে এসব শুনে, ধুত্তুরি।”
“আচ্ছা এসব কথা পরে হবে, আগে বল কীভাবে ওকে খুঁজে পাব?” একথা শুনে অবাক হলো তিথি।
“খুঁজে পাবি মানে? তুই কেন ওকে খুঁজবি? এমনিতেই তোর থেকে ৬ বছরের বড় ছিল, তার মানে ওর বয়স এখন ৩২। এতদিনে বিয়ে শাদি করে বাচ্চাকাচ্চা হয়ে গেছে।”
“আরে সেসব কি আমি বুঝি না? আমি জাস্ট ওর সাথে একবার কথা বলতে চাই। নাহলে শান্তি পাব না, কাল থেকে খুব অস্থিরতার মধ্যে আছি।”
“কিন্তু কেউ কি নেই যার মাধ্যমে ভাইয়াকে খুঁজে বের করা যায়?”
“না, এরকম কেউই নেই। বাবার কাছ থেকে জানতে পেরেছি যখন শেষবার ওর সাথে কথা হয়েছিল তখন ও ফিউচার ব্যাংকে চাকরি করত।”
“আরে আমাদের সাব্বিরই তো ফিউচার ব্যাংকে আছে। ওর হেল্প নেয়া যায়।”
“তাই তো! সাব্বির যে ফিউচার ব্যাংকে তা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু কলরব কোন ব্রাঞ্চে তা তো জানি না।”
“তাছাড়া সেটা তো আরও ৬ বছর আগের কথা। এখনও যে ভাইয়া ওখানেই আছে তার কী গ্যারান্টি?”
“তাহলে উপায়?”
“সাব্বিরের সাথে কথা বলে দেখ। ও যদি কোনো তথ্য দিতে নাও পারে তাতেও তো ক্ষতি নেই। চেষ্টা তো করা যাক। তাছাড়া সাব্বিরও তো প্রায় ২/৩ বছর ধরে আছে ওখানে। আর ও যেই মিশুক ছেলে, দুনিয়ার মানুষের সাথে দোস্তি ওর।”
“হুম, আচ্ছা দাঁড়া কল করি ওকে।”
ওপাশে রিং হচ্ছে। কিছুক্ষণ বাজতেই সাব্বিরের গলা পাওয়া গেল। “হ্যালো সুন্দরী!”
“সাব্বির, ফ্রি আছিস দোস্ত?”
“কেন? তোর কণ্ঠ এত সিরিয়াস কেন? কিছু হয়েছে?”
“কিছুক্ষণ কথা বলব।”
“বল, এখনও অফিসে কাজ করছি, কিন্তু সমস্যা নেই। তুই বলতে থাক।”
“তোর অফিসে কলরব নামে কেউ আছে?”
“না। কেন?”
“একজনকে খুঁজছি। ৬ বছর আগে তোদের ব্যাংকে চাকরি করত।”
“এই কি সেই কলরব, যার সাথে তোর স্কুল লাইফে অ্যাফেয়ার ছিল?”
“হ্যাঁ।”
“এতদিন পর খুঁজছিস?”
“সে অনেক কথা, দেখা হলে বলব।”
“আচ্ছা সে কোন ব্রাঞ্চে? কোন ডিপার্টমেন্টে?”
“কিছুই জানি না।”
“তাহলে কীভাবে বলব? এটা তো অসম্ভব ব্যাপার। আচ্ছা তাও চেষ্টা করব। কারণ ৬ বছর ধরে আছে এমন মানুষদের সাথে কথা বলে দেখি কিন্তু দোস্ত আমাদের ব্রাঞ্চ না হলে এত সহজে খবর পাব না আমি।’
“আচ্ছা, একটু দেখ দোস্ত।”
“ঠিক আছে।”
“রাখছি তাহলে।”
·
·
·
চলবে...................................................................................