তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো - পর্ব ০১ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          আজ অনেকদিন পর পুরোনো ডায়েরিটা খুলে বসেছে নিহিন। অভিমানে যা খোলা হয়নি বহুদিন। কলরবের প্রত্যেকটা চাহনির কথা লেখা আছে এ ডায়েরিতে, আছে নিহিনের প্রত্যেকটা দীর্ঘশ্বাসের কথা। রাগ, অভিমান, অপমান ও দুঃখের জল গড়িয়ে পড়ছে নিহিনের চোখ থেকে। রাগটা আসলে কার ওপর করা উচিত? কলরবের ওপর নাকি বাবার ওপর? নাকি অদৃষ্টের ওপর? বুঝতেই পারছে না সে!

দিনগুলোর কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে নিহিনের। আজ থেকে ১০ বছর আগের কথা। ক্লাস টেনে পড়ত তখন। কলরব পড়ত ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারে। বয়সের ব্যাবধানটা নেহাত কম ছিল না। তবুও প্রতিটা বিকেল নিহিনকে দেখার জন্য দুটি চোখ উদগ্রীব হয়ে থাকত পাশের বাসার বারান্দায়। প্রথম প্রথম খুব বিরক্ত হতো ও, কিন্তু আস্তে আস্তে ভালোলাগাটা কীভাবে যেন চলেই এলো। একটা সময় এলো যখন নিহিনও অপেক্ষা করত সে দুটি চোখে নিজেকে সমর্পণ করার জন্য। বৃষ্টি এলেই নিহিন ছাদে যেত ভিজতে, তা দেখে কলরবও যেত তার বাসার ছাদে। চোখে চোখ পড়তেই লজ্জা পেয়ে নেমে আসত নিহিন। নূপুর পায়ে রিনিঝিনি চলার শব্দে কলরব টের পেত নিহিনের অস্তিত্ব। আর ওদিকে কলরবের গিটারের টুং টাং শব্দ যেন জানান দিত অপেক্ষমান দুটি চোখের হাহাকারের কথা।

কিন্তু কলরব এত ভীতুর ডিম ছিল যে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস শুধু দেখেই গেছে ওকে, কিছু বলার সাহস পায়নি। নিহিনেরই বা কী দায় পড়েছে যে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাবে! কিন্তু এসেছিল, সে দিনটিও একদিন এসেছিল যেদিন কলরব তার ভালোলাগার কথা জানিয়েছিল। নিহিনের জন্মদিনে গান গেয়ে নিহিনকে উইশ করেছিল কলরব। উপহার দিয়েছিল এক গাদা চকোলেট আর বেলি ফুলের মালা। সঙ্গে ছিল একটা বিশেষ উপহার.. চিকন একটা নূপুর যার একপাশে একটা হৃদয় আকৃতির সাদা পাথর। সেদিনই শুরু হয়েছিল দুজনের পথ এক হয়ে যাওয়ার।

নূপুরটা বের করল নিহিন, অনেক বছর পড়ে ছিল এ ড্রয়ারে। কালচে হয়ে গেছে, পায়ে পরল। প্রথমবার পরিয়ে দিয়েছিল কলরব। কী সাহসটাই না হয়েছিল ওর! ভাবলেই এখন গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। রাত বারোটার পর টয়লেটে যেতে ভয় পেত যে মেয়ে, সে মেয়ে কি না ছাদের চাবি চুরি করে রাত ১ টার সময় ছাদে গিয়েছিল কলরবের সাথে দেখা করতে! দুটো বাসা অনেক কাছাকাছি ছিল। ছাদের দেওয়াল টপকে এসে পড়েছিল কলরব।

তখন মোবাইল ছিল না নিহিনের। আর মোবাইলের প্রয়োজনও ছিল না অবশ্য। নিহিনের জানালা আর কলরবের বারান্দা তো ছিলই। রাতের পর রাত কেটেছে চোখে চোখ রেখে, হাজার কথার হাজার স্বপ্ন বুনে। মাঝখানে ছিল শুধু দুটো গ্রিলের বেড়ি। স্বপ্নের মত কেটেছিল সে তিনটি মাস

তারপর ঠিকই নিহিন একদিন ধরা পড়ে গেল বাসায়। আলতাফ সাহেব নিহিন কে বলেছিলেন, “যা হয়েছে ভুলে যাও। তুমি না জেনেই একটা ভুল করে ফেলেছ। ছেলেটা ভালো না, আমি খোঁজ নিয়েছি ওর ব্যাপারে আর কথাও হয়েছে ওর সাথে আমার।”

আলতাফ সাহেবের কাছে এর বেশি আর কোনো প্রশ্নের উত্তর পায়নি সেদিন নিহিন। তাকে ঘর বদলে অন্য ঘরে দেয়া হলো। কলরবকে ফোন করে পেল, না সে, মোবাইল বন্ধ। কলরবের বারান্দার দরজাটাও বন্ধ থাকত, ১০/১৫ দিন পর নতুন ভাড়াটিয়া এসে খুলেছিল সেই দরজা। কলরবের আর কোনো খোঁজ পায়নি নিহিন। কেঁদে ভাসিয়েছিল অনেক রাত। অপেক্ষা করেছে অনেক দিন। তারপর অভিমানে, রাগে একসময় ভুলেও গিয়েছিল সবকিছু।

কিন্তু আজ আলতাফ সাহেব বললেন, কলরবকে তিনি সময় দিয়েছিলেন! বলেছিলেন, নিহিনের সাথে কোনোরকম যোগাযোগ না করে যদি ওর জন্য অপেক্ষা করতে পারে এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে এসে বিয়ের প্রস্তাব দেয় তবেই কলরবের সাথে বিয়ে দেবেন নিহিনের! কিন্তু যদি কখনো কোনোভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাহলে তখনই সব শেষ। আর নিহিন যাতে যোগাযোগ করতে না পারে তাই ফোনের সিম, বাসা সবকিছু বদলে ফেলতে বলেছিলেন। এসব কথা আলতাফ সাহেব ঘুণাক্ষরেও জানতে দেননি ওকে। কলরব প্রত্যেকটি কথা মেনে নিয়েছিল, যোগাযোগ করেনি। ঠিকই ৪ বছর পর নিজেকে তৈরি করেই এসেছিল নিহিনকে বিয়ে করতে কিন্তু ততদিনে নিহিনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। আসলে আলতাফ নিজেই একসময় কলরবকে দেওয়া কথা ভুলে গিয়েছিলেন, কারণ কলরব যে এতটাই সিরিয়াস তা তিনি ভাবতেই পারেননি। নিহিনের বিয়ে হয়েছে শুনে এরপর আর কোনো যোগাযোগ করেনি কলরব।

বিয়েটা হলেও সংসারটা ভেঙ্গে গিয়েছে নিহিনের…পড়াশুনা শেষ করে ভালো চাকরি করছে এখন, ঘুরছে ফিরছে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। ভাইবোনদের নিয়ে আনন্দ করছে, বেশ আছে। শুধু আবার বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না কিছুতেই, বলছে আরও পরে। তাই আলতাফ সাহেবের দুঃখের শেষ নেই। তাই হয়তো আজ সবটা বললেন তিনি। কিন্তু না বললেই বোধহয় ভালো হতো। খুব ভালো ছিল এতদিন, কারণ একটা রাগ ছিল কলরবের ওপর। এখন তো সে রাগটাও চলে গেল! এখন?

কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না নিহিন। আজ এতদিন পর আবার ডায়াল করল কলরবের সে নাম্বরটিতে, যদি পাওয়া যায়! এতদিনে নিশ্চয়ই বিয়ে করে সংসার করছে সে, তাতে কী! শুধু একবার কথা বলতে চায় ও, আর কিছু না। কিন্তু ওপাশ থেকে যথারীতি সুকণ্ঠী মেয়েটির কন্ঠস্বর ভেসে এলো, “আপনার ডায়ালকৃত নম্বরটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, দয়া করে আবার চেষ্টা করুন।”
·
·
·
চলবে...................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp