তাবাসসুমের বাবা এসেছেন সকাল নয়টার দিকে৷ বউ, মেয়েদের নিজ পিতৃগৃহে রেখে, তিনি চাকরিসূত্রে সিলেট থাকেন। মাঝে মাঝে ছুটি হলেই তিনি অস্থির হয়ে চলে আসেন সেই সিলেট থেকে। এবারও ছুটিতে এসেছেন৷ পাঁচদিনের ছুটি।
তাবাসসুম আর তনু বাবার সাথে বসে বসে গল্প করছে৷ তনু এটা-সেটা বলে বোনের নামে নালিশ জানাচ্ছে বোনের নামে। তাবাসসুম তনুর কথা শুনে ঠোঁট বাঁকাচ্ছে। তনু একপর্যায়ে বাবার বাহু ধরে বলে উঠল—
“বাবা জানো? আপু প্রচন্ড ঝগড়াটে হয়েছে৷ আগে তো আমার সাথে ঝগড়া করতো এখন বাহিরের মানুষের সাথেও করে৷ তাও বড়দের সাথে। তুমি শিখিয়েছো না ঝগড়া অভদ্ররা করে৷ আপু দিনদিন অনেক অভদ্র হয়ে যাচ্ছে বাবা।”
তাবাসসুম তনুর দিকে দাঁতে দাঁত চেপে তাকালো। শয়তান মেয়ে কোথাকার। ও শুধু ঝগড়া করে নাকি? ওই লোকটা করে না?
তোফায়েল সাহেব বড় মেয়ের দিকে তাকালেন একবার। অতঃপর ছোট মেয়ের পানে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন—
“কার সাথে ঝগড়া করেছে আমার মেয়ে?”
“নতুন ভাড়াটিয়ার সাথে।”
তোফায়েল সাহেব মেয়ের পানে তাকিয়ে গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করলেন—
“তুমি ভারাটিয়াদের সাথে ঝগড়া করছো?”
তাবাসসুম সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল—
“আমি ঝগড়া করিনা বাবা। ওই লোকটাই আমার সাথে ঝগড়া করেন। তনু মিথ্যে বলছে।”
তনু তাবাসসুম কথার পিঠে বলল—
“তুই আগে আগে রুশান ভাইয়ের সাথে ঝগড়া শুরু করিস।”
তাবাসসুম মুখ বাকিয়ে বলল—
“রুশান ভাইয়ের চামচা।”
তনু ক্ষেপে উঠে বলল—
“কি বললি তুই?”
এক কথায় দুই কথায় দুজনের ঝগড়া লেগে গেল। তোফায়েল সাহেব মেয়েদের ঝগড়া কিছুক্ষণ দেখলেন। কতদিন পরপর তিনি মেয়েদের খুনশুটি দেখতে পান। তিনি ভেবেছেন এবার ট্রান্সফার হয়ে শহরের এদিকে চলে আসবেন৷ বুড়ো বয়সটা বউ, মেয়েদের নিয়ে একটু সময় নিয়ে কাটাবেন।
ঝগড়া যখন মারামারিতে এসে রূপ নিবে নিবে ভাব, তোফায়েল সাহেব মেয়েদের আটকালেন। দুই মেয়ের পাশে দুহাত দিয়ে দিলেন। তাবাসসুম, তনু দুজন দুজনের থেকে মুখ ঘুরিয়ে বসে পড়ল। তোফায়েল সাহেব, মেয়েদের ঘুরিয়ে দুজনকে দুপাশ থেকে জড়িয়ে ধরলেন। হাসি মুখে
বললেন—
“হয়েছে হয়েছে। বাবা কিন্তু আরেকটা কথা বলেছে তোমাদের, যত যাই হোক কখনো দুজন দুজনের উপর রাগ করে থাকবে না। কথা বলা বন্ধ করবে না। সেই কথা মনে আছে?”
দুজন একসাথে উত্তর দিল—
“হ্যাঁ।”
“এবার দুজন দুজনের দিকে তাকাও।”
বাবার কথায় তাবাসসুম তনু দুজন দুজনের দিকে তাকালো। দুজন দুজনের মুখ দেখে হেসে দিল। তোফায়েল সাহেব হাসলেন। মুনায়া বেগম সেই মুহুর্তে উপস্থিত হলেন সেখানে।
তোফায়েল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন—
“মেয়েদের পেলে তো নাওয়া-খাওয়াও ভুলে যাও। ক'টা বাজে সে খেয়াল আছে তোমাদের? দুটো বাজতে চলল। তিনজনই এখন গোসলে যাবে যাও।”
তাবাসসুম বলল—
“আরেকটু পরে যাই মা। বাবার সাথে আরেকটু গল্প করি।”
“এখনই যাবে। গল্প পরেও করতে পারবে। যাও এখন।”
বাড়ির গিন্নির কথা শুনে অগত্যা তিনজনই উঠে পড়ল। যার যার মতো ফ্রেশ হতে গেল তিনজনে। না হয় পরে দেখা যাবে, বাড়ির গিন্নি রাগে বোম হয়ে তাদের ব্লাস্ট করে দিলো।
—————
বিকেলের দিকে তাবাসসুম, তনু আর তোফায়েল সাহেব ছাদে এসেছেন ছাদের গাছগুলোর আগাছা পরিষ্কার করতে। প্রতিবার ছুটিতে তিন বাপ মেয়ে মিলে তারা এই কাজটি বেশ আনন্দের সাথে করে থাকেন। ছাদে হরেক রকমের গাছ। ফুলের গাছগুলো তাবাসসুমের লাগানো। তাবাসসুমের নাম না জানা আরও অনেক গাছ আছে যেগুলো তোফায়েল সাহেব লাগিয়েছেন। তোফায়েল সাহেব প্রচন্ড গাছপ্রেমী। তিনি প্রতিবার ছুটিতে আসলেই কোনো নতুন নতুন গাছ নিয়ে এসে বাড়ির ছাদে লাগান। তাবাসসুমদের সেসব গাছের নাম বলেন। কিন্ত ওতগুলো গাছ হওয়ায়, দুজনের কেউ নামগুলো মনে রাখতে পারে না। হাতে গোনা কয়েকটা তাদের মনে আছে।
তোফায়েল সাহেব গাছের আবর্জনা পরিষ্কার করছেন তাবাসসমু আর তনু তোফায়েল সাহেবকে সাহায্য করছে। তোফায়েল সাহেব পানির বালতি আনতে বললে, তাবাসসুম অন্য সাইড থেকে পানির বালতি এনে তোফায়েল সাহেবকে দেয়। তোফায়েল সাহেব তার অতি যত্নের গাছগুলোতো পানি ঢালেন।
সহসা তাবাসসমু বলে উঠল—
“বাবা আমি ওদিকটায় যাই আমার গাছগুলোর দিকে। তনু তোমাকে সাহায্য করুক।”
“হ্যাঁ যাও। তনুকেও নিয়ে যাও।”
“না ও তোমাকে সাহায্য করুক। আমি ওই গাছগুলো দেখি।”
“আচ্ছা।”
তাবাসসুম তার অতি যত্নের ফুল গাছগুলোর সামনে এসে দাঁড়ালো। তার প্রিয় দোলনচাঁপা গাছে কলি এসেছে। বর্ষার শুরুর দিকে তারা ফুটবে। তাবাসসুম দেখল, টবের ভিতর মাটিতে বেশ ঘাস হয়েছে৷ তাবাসসুম বসে পড়ল টবের সামনে। ঘাসগুলো টেনে উঠালো। প্রায় সবগুলো টবেই একই অবস্থা। তাবাসসুম সবগুলো একে একে আস্তে আসাতে পরিষ্কার করতে লাগলো৷ সহসা কানে কোনো পুরুষালী হাসির শব্দ কানে আসতে তাবাসসুম মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। রুশানকে দেখল। রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কারও সাথে হেসে কথা বলছে। কিয়ৎক্ষণ তাবাসসুম সেই হাস্যজ্বল মুখশ্রীর পানে তাকিয়ে রইল। পরক্ষণেই তার মন খারাপ হলো। নিশ্চয়ই লোকটা তার প্রেমিকার সাখে কথা বলছে। তনু তো বলেছিল, লোকটা নাকি তার প্রেমিকাকে অনেক ভালোবাসে।
তাবাসসুম মুখ ঘুরিয়ে নিলো। একটা ছেলের প্রেমিকা থাকতেই পারে। তাতে তার কি? তার কেন মন খারাপ হচ্ছে? তার তো অবাক হওয়ার কথা। এটা ভেবে যে, এই ঝগড়াটে লোকটারও প্রেমিকা আছে। কিন্তু সে অবাক হতে পারছে না কেন? মন খারাপ কেন হচ্ছে?
“কি করছেন?”
সহসা পুরুষালী কন্ঠে তাবাসসুম ভাবনা থেকে বেরিয়ে পিছনে তাকালো। ঘাড় ঘুরিয়ে রুশানকে দেখে সামনে তাকিয়ে বলল—
“দেখছেন তো।”
রুশান হেসে বলল—
“আমি দেখছি বলে কি আপনি বলবেন না?”
তাবাসসুম ভ্রু কুঁচকে তাকালো রুশানের পানে। কথাটা বুঝেনি সে। তবে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে রুশান তার সামনে বসে পড়ল। টব থেকে কিছুটা মাটি নিয়ে, তাবাসসুমের কপালের বাম পাশে লাগিয়ে দিয়ে হেসে বলল—
“নাউ পার্ফেক্ট। একদম বাচ্চাদের মতোই লাগছে। দু পাশে বাচ্চাদের মতো গোল গোল দুটো টিপ দিয়ে।”
বলেই রুশান ঠোঁট টিপে হাসল। তাবাসসুম অবাক চোখে তাকিয়ে রইল কেবল।
·
·
·
চলবে……………………………………………………