পেট্রা অফিস থেকে ফিরতেই রায়ান এল ঘরে। পেট্রা তাকে দেখে বলল, ‘তুই এ সময় বাসায়? কোচিংয়ে যাস নি?
‘গিয়েছিলাম, ম্যাথ ক্লাস না করে চলে এসেছি।’
পেট্রা চুলটা খোঁপা করে ভাইয়ের সামনে গিয়ে বলল, ‘কেন? কী হয়েছে?
‘সরি দি।
‘কী আকাম করেছিস?
‘সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটরটা হারিয়ে ফেলেছি। ক্যালকুলেটর ছাড়া ক্লাসে গেলে স্যার মারে।
‘কবে হারিয়েছে?
‘সপ্তাহখানেক।
‘এত দিন আগে হারিয়েছিস আর আজকে বলছিস?
‘আমি খুঁজছিলাম, যদি পাই।’
‘এখন ক্যালকুলেটরের দাম কত?
‘তেরো-চৌদ্দ শ-তে পাওয়া যাবে সম্ভবত।’
পেট্রা আলমারি থেকে ১৫০০ টাকা বের করে রায়ানের হাতে দিল। রায়ান বলল, তোর অনেক সমস্যা হয়ে যাবে এই মাসে। তাই না দি?
‘কিছু হবে না। তুই তাড়াতাড়ি ক্যালকুলেটরটা কিনে নিস।’
‘দি আরেকটা কথা।’
‘কী, বল।
‘মাকে বলিস না। আমাকে কেটে ফেলবে।’
পেট্রা ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, এটা কি আমাকে শিখিয়ে দিতে হবে পাগল?
‘লাভ ইউ দি।’
পেট্রা হাসল। ভাইয়ের গালটা ধরে বলল, ‘লাভ ইউ টু। পরীক্ষার তো বেশি দেরি নেই। রেজাল্টটা ভালো করিস, ভাই। আমি মেডিকেলে পড়তে পারি নি, মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারি নি। প্রিয়াঙ্কা তো ধারেকাছেও ছিল না। কিন্তু তোর যোগ্যতা আছে, আমি জানি তুই চেষ্টা করলেই পারবি। এই একটাই চাওয়া তোর কাছে আমার। এই চাওয়াটা পূরণ কর, সব কষ্ট ভুলে যাব।’
‘আমি পারব, দি। তুই দেখিস, আমি পারব।’
পেট্রা তৃপ্তির হাসি হাসল।
রাতে খাওয়ার পর পেট্রা ও রায়ান টিভির সামনে বসল। শিখা বাড়তি খাবারদাবার ফ্রিজে তুলে রাখছিলেন। পেট্রা বলল, ‘মা, ক্রিসমাসের শপিংয়ে যাব কাল সকালে। অন্য কোনো কাজ রেখো না।’
শিখা নিজের কাজ করতে করতেই বললেন, আমার জন্য একটা কফিন কিনিস।’
পেট্রা ও রায়ান চমকে তাকাল। পেট্রা বলল, তুমি কী বলছ এসব?
‘এই বিয়েটাও ভেঙে গেছে। ছেলেপক্ষ খোঁজ নিয়ে শুদ্ধর কথা জানতে পেরেছে। এমনসব কাজ করেছিস, মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারি না। এর চেয়ে মরণ ভালো।
পেট্রা বলল, তুমি গোপন রাখো কেন? আমি তো আগেই বলে দিয়েছি, কোনো বিয়ের কথাবার্তা বললে তুমি আগেই প্রিয়, শুদ্ধর ব্যাপারে সব বলে নেবে।’
‘এসব জেনে কোনো রিকশাওয়ালাও তোকে বিয়ে করবে না। আর খবরদার, ওই বিশ্বাসঘাতক ছেলেটার নাম নিবি না আমার সামনে।
‘মা, প্রিয়র সম্পর্কে এসব কথা বলবে না। ওর পরিস্থিতিটা তুমি বুঝবে না।
‘ওর জন্য অপেক্ষা করে করে সময়মতো বিয়ে করিস নি তুই। এরপর নিজেরা বিয়ে করে কত ইতিহাস তৈরি করলি। এরপর সেই বিয়েও টিকিয়ে রাখতে পারলি না। এদিকে এখন আমি তোক বিয়ে দিতে পারছি না। এখন কোথায় সে? নিজে তো ঠিকই বিয়ে করে সুখের সংসার করছে।”
রায়ান এসব আর শুনতে পারছিল না। তাই উঠে নিজের ঘরে চলে গেল। পেট্রা বলল, ‘তো কী হয়েছে, মা? সে বিয়ে করে সুখী হয়েছে, আমিও বিয়ে করে সুখী হব।’
‘তোকে কেউ বিয়ে করলে তো তুই সুখী হবি। আমাদের দেশে কয়জন খ্রিষ্টান আছে? পাত্রই তো পাই না। যা-ও পাই, একটা না একটা গ্যাঞ্জাম লেগেই যায়। ইশ, কত ভালো ভালো প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছি তোর কথায়। তখন যদি জানতাম পড়াশোনা হলো একটা ছুতা, তুই আসলে ওই হিপোক্র্যাটের জন্য বিয়ে করছিস না, তাহলে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিতাম।’
পেট্রা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শিখা বললেন, ‘এই ক্রিসমাসে আমার কিছু লাগবে না। শুধু এক শিশি বিষ কিনে দিস। তোকে খাইয়ে মেরে তারপর আমিও খেয়ে মরে যাব। এ ছাড়া নিষ্কৃতি নেই আমার। তোর বাপটা তো মরে বেঁচে গেছে।
নিজের ঘরে বসে এসব কথা শুনে রায়ান আর চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। দি খুব শক্ত, সে কাঁদছে না। কিন্তু কষ্টে নিশ্চয়ই বুক ফেটে যাচ্ছে। মা কি এটুকু বুঝতে পারছে না, যা হয়েছে, তাতে দির কোনো দোষ নেই? মা কেন দিকে এসব কথা বলছে? মা কি দির কষ্টটা একটুও বোঝে না?
—————
গভীর রাতে বন্ধ দরজার ভেতর কাঁদতে কাঁদতে মাথাব্যথা হয়ে গেল পেট্রার। কী করবে সে? কী করবে? অভিমানে মাথা কাজ করছিল না। মা ইতিমধ্যে অনেকবার তাকে মরার কথা বলেছে। সে মরে গেলে কি সত্যিই মা শান্তি পাবে? কিন্তু সে তো মরার কথা ভাবতেও পারে না। সে মরে গেলে রায়ানের পড়াশোনার কী হবে? সংসার কীভাবে চলবে? আর শুদ্ধ? প্রিয়র বিয়ের দিন শুদ্ধর বলা কথাগুলো আজও কানে বাজে পেট্রার। শুদ্ধ প্রিয়র মোবাইল থেকে কল করেছিল। পেট্রা শুদ্ধর গলা শুনে অবাক হয়ে বলেছিল, ‘শুদ্ধ! বাবা তুই কী করে ফোন করলি? তোর বাবা ফোন করতে দিল?
‘আজকে জুম্মাবার। বাবা তো নামাজ পড়তে গিয়েছে, মা। আর আমি সে জন্য চুরি করে ফোন করতে পেরেছি।’
‘আচ্ছা। কেমন আছে আমার বাবাটা?
‘ভালো না, মা। তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।’
পেট্রার চোখের জল সেদিন কোনো বাধা মানে নি। শুদ্ধকে বুঝতে দিচ্ছিল না যদিও। শুদ্ধ বলেছিল, ‘মা, আজকে নাকি বাবার বিয়ে। তুমি কি জানো, মা?
হ্যাঁ, জানি।
‘সত্যিই কি বাবার বিয়ে হয়ে যাবে, মা?
পেট্রার বুকভাঙা কান্নায় কোনো শব্দ ছিল না।
হ্যাঁ।
‘আর বাবার বিয়ে হয়ে গেলে কি বাবা আর আমাদের ভালোবাসবে না?
‘অবশ্যই বাসবে, বাবা।
‘দাদা বলেছে যে আন্টিটা বাবার বউ হয়ে যাবে, তাকে নাকি আমার মা বলে ডাকতে হবে?
পেট্রা কিছু বলতে পারল না। শুদ্ধ বলল, আমি কোনোদিনও আর কাউকে মা বলব না। কোনো আন্টিকেও না, আর কাউকেই। আন্টিই বলব।’
পেট্রা কিছু বলতে পারছিল না। কেবল অবুঝ শিশুটির অভিমানী কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল।
‘আমি কদিন ধরে বাবাকে ভালোবাসছি না, মা।
‘কেন বাবা? কেন ভালোবাসছিস না বাবাকে?
‘কারণ, বাবা তোমার সাথে আর দেখা করতে দেবে না বলেছে। বাবা খুব নিষ্ঠুর, বাবা খুব পচা, বাবা খুব খারাপ। আমাদের স্কুলের আইসিটি টিচারের চেয়েও খারাপ বাবা।
‘ছি বাবা, বাবার সম্পর্কে এসব কথা বলতে হয় না। বাবা সবার ভালোর জন্যই এসব করছে। বাবা একটু রাগী, একটু কঠিন, কিন্তু খারাপ না। বাবা পৃথিবীর সেরা মানুষ। বাবা মাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু আমাদের যে ধর্ম আলাদা, সে জন্য আমরা কখনো একসাথে থাকতে পারব না।’
‘ধর্ম কি খুব ইম্পরট্যান্ট, মা?
‘হা মা, ধর্মের চেয়ে ইম্পরট্যান্ট কিছু নেই।
‘এ জন্যই কি বাবার বিয়ে হচ্ছে?
‘হ্যাঁ।’
‘আমাকে এসব কেউ বলে না কেন, মা? বাবার কেন বিয়ে হচ্ছে, তা আমি দাদাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি, আমার তো মা আছে, তাহলে কেন আরেকটা মা আসবে? দাদা বলেছে, আমি ছোট, আমি বুঝব না। কিন্তু এই যে তুমি বললে আমি তো বুঝেছি, মা।’
‘বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলে?
‘না, বাবাকে ভয় পাই। যদি তোমার ছবিও না দেখতে দেয়!
পেট্রা মুখে ওড়না চেপে ধরল। কান্নাটা ছেলেকে শোনাতে পারবে না সে। শুদ্ধ বলল, একটা ভালো কথা আছে, জানো মা?
‘কী ভালো কথা, মা?
‘বাবা আমাকে বলেছে, আমি বড় হলে তোমার সঙ্গে মিট করতে পারব।’
‘আচ্ছা, এটা তো খুব ভালো কথা।
‘তুমি চিন্তা কোরো না, মা, আমি যখন বড় হয়ে যাব, তখন আমি তোমার কাছে যাব। আমি বড় হয়ে গেলেও তোমাকে চিনতে পারব, সত্যিই চিনতে পারব। যদি দূর থেকেও দেখি, আর যদি দাদার মতো আমার মোটা চশমাও লাগে, তবু আমি তোমাকে চিনতেই পারব। আমি তো তোমার ঘ্রাণ শুঁকেই তোমাকে চিনতে পারি! তোমার মনে নেই, প্রিয়াঙ্কা আন্টি সব সময় আমার চোখ বেঁধে দিয়ে তুমি সাজত কিন্তু আমি চিনে ফেলতাম?
‘হ্যাঁ বাবা, আমার সব মনে আছে।
একসময় শুদ্ধও কান্না শুরু করে দিল। হাউমাউ করে কাঁদছিল আর বলছিল, ‘আমি বড় হলেই তোমার কাছে চলে যাব। কেউ আমাকে জোর করতে পারবে না। এখন তো আমি রাস্তা চিনি না, তাই যেতেও পারি না। কিন্তু তুমি দেখো মা, আমি ঠিকই একদিন রাস্তা চিনে চলে যাব। তুমি কিন্তু আমাকে কোলে নিয়ো, বড় হয়ে গিয়েছি, তাই বলে কোলে না নিয়ে থেকো আবার।’
মা-ছেলে সেদিন হাউমাউ করে কেঁদেছিল। পাগলের মতো উল্টোপাল্টা বলছিল। সেদিনের কথা পেট্রা কোনোদিন ভুলবে না। সে কীভাবে মরবে তার ছেলেটাকে রেখে! ছেলেটা তো বড় হয়ে তার কোলে ফিরে আসবে। তত দিন তো অন্তত বেঁচে থাকতে হবে। জীবনে যত কষ্টই আসুক, যত কঠিন সময়ই আসুক, বেঁচে থাকতেই হবে!
—————
প্রিয় রেস্টুরেন্টে প্রিয়াঙ্কার জন্য অপেক্ষা করছিল। প্রিয়াঙ্কা এসে বসতেই প্রিয় বলল, ‘এই, তোর কি বাচ্চাকাচ্চা হবে নাকি?
প্রিয়াঙ্কা লজ্জা পেয়ে বলল, ‘জানতাম তোমার মতো ঠোঁটকাটা লোক এ কথা বলবেই। এ জন্য আসতে চাচ্ছিলাম না।
প্রিয় হেসে বলল, ‘আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখে, সুইটহার্ট। এত বড় একটা খুশির খবর আমাকে জানালি না কেন?
একেবারে জানাতাম।
‘কয় মাস?’
‘পাঁচ মাস।
‘কগ্রাচুলেশনস।
‘থ্যাংক ইউ, প্রিয়দা। এবার বলো কেন ডেকেছ?
‘সামনে ক্রিসমাস না?
প্রিয়াঙ্কার মনে পড়ে গেল, প্রত্যেক ক্রিসমাসে ঘুম থেকে উঠেই বালিশের পাশে উপহার ও চকলেট পেত। তাদের বিশ্বাস ছিল, ওই উপহার সান্তাক্লজ এসে দিয়ে যেত। কিন্তু বড় হতে হতে বুঝল, উপহারগুলো আসলে বাবা রাখত। তারা তিন ভাইবোন সারা বছর এটার জন্য অপেক্ষা করত। বাবা মারা যাওয়ার পরও তারা এই উপহার পেত। প্রিয় কখনো বাবার অভাবটা বুঝতে দিতে চাইত না। বাপহীন অচল এই তিন ভাইবোনের মাথার ওপর ছায়ার মতো থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করত সে। অথচ জীবনটা কত অদ্ভুত! এখন শুধু পেট্রার ছায়া হয়েও থাকতে পারল না প্রিয়! প্রিয়াঙ্কাকে চুপ হয়ে থাকতে দেখে প্রিয় বলল, কী ভাবছিস এত?
‘কিছু না।
‘রায়ানকে বলেছিলাম এবার একটু সাহায্য করতে।
প্রিয়াঙ্কা চমকে উঠল, সর্বনাশ! প্রিয় এত কিছুর পর পেট্রাকে ছেড়ে দিয়েছে বলে রায়ান তাকে দুচোখে দেখতে পারে না, আবার কিছু বলে বসে নি তো! প্রিয়াঙ্কা বলল, ‘দাদা, রায়ান কি সাহায্য করবে না বলেছে?
‘হ্যাঁ, ওর বোধ হয় আমার ওপর খুব রাগ।
‘ভাইয়া, আমি ওর হয়ে মাফ চাচ্ছি। বোঝোই তো, ছোট মানুষ, মাথা গরম। তোমার কাছে অনেক এক্সপেক্টেশন ছিল ওর, তাই ও ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে নি। ও তো আর আমাদের মতো এত কিছু বোঝে না।
‘পেট্রা অনেক কষ্টে আছে, তাই না?
‘এ কথা বলছ কেন, দাদা? রায়ান তোমাকে কিছু বলেছে?
রায়ান খুব কড়া কথা শুনিয়েছে। মা পেট্রার সঙ্গে কী ধরনের কথা বলে, সেটাও বলেছে। রায়ানের ধারণা, প্রিয় ইচ্ছা করে পেট্রার সঙ্গে টাইম পাস করেছে। বিয়ে নামক খেলা খেলেছে এবং পেট্রার জীবনটা নরক করে দিয়েছে। কিন্তু এসব কথা প্রিয়াঙ্কাকে বলার কোনো মানে হয় না। তাই প্রিয় বলল, ‘না, তেমন কিছু না। শুধু সাহায্য করবে না, এটাই বলেছে। পেট্রা থেকে দূরে থাকতে বলেছে। যা-ই হোক, বাদ দে এসব কথা। তুই তো জানিস শুদ্ধর সাথে দেখা করতে দিই না বলে তোর বোনের আমার ওপর রাগ। দেখা তো দূরের কথা, আমার ফোনও ধরে না। আমি কিছু উপহার আর চকলেট এনেছি, এগুলো ক্রিসমাসের সকালে যে কোনোভাবে হোক পেট্রার মাথার কাছে চলে যাওয়া চাই। এখানে কোথাও আমার নাম লিখি নি, কারও কোনো সন্দেহ হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।’
‘তুমি কী দিয়েছ আমি জানি না। কিন্তু এটুকু জানি যা-ই দিয়েছ, পেট্রা দেখেই বুঝে ফেলবে যে তুমি দিয়েছ।
প্রিয় হেসে বলল, ‘পেট্রা তো বুঝবেই। আমি অন্যদের কথা বলছি। বাসায় ঢোকানোর সময় আশা করি কোনো সমস্যা হবে না।
‘আচ্ছা। এবার বলো আমার ভাগেরটা কই?
প্রিয় তিনটা ব্যাগ দিয়ে বলল, ‘তোদের তিন ভাইবোনের জন্য। ব্যাগের ওপর যার যার নাম লেখা আছে।’
প্রিয়াঙ্কা নিজের ব্যাগটা খুলে দেখল র্যাপিং করা উপহার, সঙ্গে কিছু চকলেট। ওখান থেকে একটা চকলেট তুলে খেতে শুরু করে দিল। প্রিয় হাসল। তারপর কী ভেবে প্রিয়াঙ্কা হঠাৎ আবেগী হয়ে পড়ল। চোখে জল এসে গেল। বলল, ‘দাদা, সারা জীবন যদি পেট্রা তোমার সাথে থাকতে পারত, তাহলে দুনিয়াটাই ওর কাছে স্বর্গ হয়ে যেত।
‘উঁহু। যদি আমি আর শুদ্ধ পেট্রার সাথে সারা জীবন থাকতে পারতাম, তাহলে আমাদের দুনিয়াটা স্বর্গ হয়ে যেত।
—————
রাতে সবার আগে শুদ্ধ শুয়ে পড়ে। তারপর প্রিয় শোয়, সবার শেষে নিকিতা আসে। আজ প্রিয় বিছানায় শুতেই শুদ্ধ উঠে বসল। নিকিতা তখনো ঘরে আসে নি। প্রিয় জানত, আজ শুদ্ধ কিছুতেই ঘুমাবে না। তাই মোটেও অবাক হলো না। বলল, কিরে ব্যাটা, জেগে আছিস যে!
‘বাবা, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
‘কী কথা, বাবা?
শুদ্ধ বাবার কোলের কাছে এসে পা গুটিয়ে বসল। তারপর বলল, ‘আচ্ছা বাবা, কারোর কি দুইটা মা থাকতে পারে?
প্রিয় অবাক! না জানি কী হয়েছে যে এটুকু বাচ্চার মুখে এই কথা! বলল, ‘কী হয়েছে, শুদ্ধ? কেউ কিছু বলেছে?
‘হ্যাঁ, দাদু আমাকে বলে কিনিকিতাকে আন্টি বলো কেন? ও তো তোমার মা হয়। তোমাদের বিয়ে হয়ে যাওয়ার আগেও বলেছে, যে আসবে, তাকে মা ডাকতে হবে। কিন্তু বাবা, দুইটা মা কী করে হয়? সবার তো দেখি একটাই মা। তোমারও তো একটাই মা ছিল, তাই না? তাহলে আমার কেন দুইটা মা হবে?
কী জবাব দেবে প্রিয়? শুদ্ধর কিছু প্রশ্নের সামনে পড়ে অসহায় লাগে নিজেকে। প্রিয় শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাবা, দুনিয়াতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যা একটু অন্যরকম, আমরা যা জানি, তার সাথে মেলে না। অনেক প্যাঁচ আছে। যখন বড় হবি, তখন নিজের বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে যেটা ঠিক মনে হবে, সেটাই ঠিক। আজকের এই প্রশ্নের উত্তরও সেদিন পাবি।
‘বাবা, একটা কথা বলি, রাগ কোরো না?
‘বল।’
‘তোমাদের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করলেই তোমরা বলল, এখন বুঝবি না, বড় হলে বুঝবি কিন্তু মাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে মা বুঝিয়ে বলত আর আমি বুঝে ফেলতাম।
‘মা অনেক বোঝাতে পারে যে।’
‘আমি মাকে অনেক ভালোবাসি, বাবা। তুমি দাদুকে বলে দিয়ো, আমি নিকিতা আন্টিকে মা বলতে পারব না। নিকিতা আন্টি তো আন্টি, অনেক ভালো একটা আন্টি, আমি খুব পছন্দ করি আন্টিকে। কিন্তু আন্টি কি কখনো মা হয় নাকি, তুমি বলো তো? তুমি কি তোমার আন্টিদের কাউকে মা বলতে পারবে?
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে গেল শুদ্ধ। প্রিয় সব শুনে বলল, ‘তা তো ঠিকই। কিন্তু ব্যাপারটা টেকনিক্যালি হ্যাঁন্ডেল করতে হবে, বুঝেছিস?
‘কীভাবে, তুমি শিখিয়ে দাও।’
‘এই ধর, দাদার সামনে নিকিতাকে কিছুই বলবি না। মাও না, আন্টিও না, তাহলে তো আর সে প্রেশার দিতে পারবে না।’
‘হুম, ইউ আর রাইট। কিন্তু বাবা, তার মানে কি নিকিতা আন্টিও আমার মা হয়?
প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘হয়, আবার হয় না। এটা শুধু বড় হলেই বুঝবি। তোর মা হয়তো বোঝাতে পারত কিন্তু আমি পারছি না।’
শুদ্ধ নিমগ্ন হয়ে কী যেন ভাবল, তারপর হেসে বলল, ‘ঠিকাছে বাবা।
শুদ্ধ শুয়ে পড়ল। প্রিয় এবার অবাক হলো। সে ভেবেছিল আজ শুদ্ধ তার মায়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইবে। তা না করে এসব বলল। ভালো হয়েছে, কথা বলতে চাইলেই কি দিতে পারত? শুদ্ধ বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ও বাবা, বারোটা তো বেজে গেছে, ক্রিসমাস আজ। আজ কি মায়ের সাথে কথা বলতে পারব? যদি ঈদের দিন সবার সাথে কথা বলতে হয়, মোবারক বলতে হয়, তাহলে ক্রিসমাসেও তো বলতে হয়।
প্রিয় ছেলেকে শক্ত করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলল, ঠিকাছে কিন্তু এখন না, কাল কথা বলিস।
শুদ্ধ লাফিয়ে উঠে বাবার গালে চুমু দিতে লাগল। প্রিয় হাসছিল। এমন সময় নিকিতা ঘরে ঢুকল। হেসে বলল, ‘ও মা গো! বাপ-ছেলে এত খুশি যে?
শুদ্ধ বাবাকে ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে নিকিতাকে জড়িয়ে ধরল। নিকিতাও ধরল। শুদ্ধ নিকিতাকে টেনে বিছানায় বসিয়ে দুই গালে দুটো চুমু দিল। তারপর বলল, আন্টি, তুমি ভালো আছ?
প্রিয় এসব দেখে হাসছিল। নিকিতাও হাসতে হাসতে বলল, ‘হ্যাঁ বাবা, অনেক ভালো আছি। তুমি আছ যে আমার সাথে! তুমি কেমন আছ?
শুদ্ধ বলল, আমিও অনেক ভালো আছি। পুরো গ্যালাক্সির সমান ভালো আছি।’
নিকিতা বুঝতে পারছিল না এত খুশির কারণ কী! প্রিয় বলল, ‘এই পাগলা! ঘুমাতে আয়।
শুদ্ধ শুয়ে পড়ল। নিকিতাও আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে শুদ্ধ ঘুমিয়েও গেল। নিকিতা বলল, তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ?
প্রিয় ঘুমায় নি কিন্তু সাড়া দিল না, চোখ বন্ধ করে ছিল। হয়তো শুদ্ধর খুশির কারণ জানতে চাইবে কিংবা অন্য কিছু। কিন্তু সে এখন কোনো কথা বলতে চাচ্ছে না, তার আগামীকালের কথা ভেবে খুব নার্ভাস লাগছে। এখনো এমন কেন হয়?
নিকিতা উঠে বসল। শুদ্ধর মাথার ওপর দিয়ে প্রিয়র একটু কাছে গেল। কিন্তু আর কিছু করার সাহস হচ্ছে না। কিছু করতে গেলেই তো বকে। কিন্তু মাঝেমধ্যে মনটা যে মানতে চায় না। স্বামী তো! অনেক উল্টাপাল্টা কথা ভেবেও নিকিতা প্রিয়র আরও একটু কাছে গেল। প্রিয়র গলার কাছে নাক নিয়ে ঘ্রাণ নিল। মনে মনে বলল, ‘কবে তুমি আমাকে কাছে টেনে নেবে, প্রিয়? এই অপেক্ষার শেষ কি কখনো হবে না?
প্রিয়র অস্বস্তি হচ্ছিল। এর চেয়ে কথা বলাটাই ভালো ছিল। মেয়েটাকে এত বকে, এত বাজে কথা বলে, তবু সে কোথায় পায় এত সাহস? প্রথম থেকেই বাজে ব্যবহার করে এসেছে। তাহলে ভালোবাসা হলো কী করে তার? অবশ্য মেয়েটার বয়সটাই তো এমন। এই বয়সে তো সবারই ভালোবাসা পেতে ইচ্ছা করে, স্বামী থাকতেও তার আদর, ভালোবাসা কিছুই পায় না। মেয়েটা ভাগ্যদোষে বাবা এবং তার যুদ্ধের মাঝে পড়ে কষ্ট পাচ্ছে! কিন্তু সে-ইবা কী করবে? সে তো পেট্রা ছাড়া অন্য কারও কথা ভাবতেই পারে না। তার মন, শরীর–সবই যে শুধু পেট্রাকেই চায়!
নিকিতা প্রিয়র চুলের ভেতর হাত বোলাতে লাগল। সে জানে না প্রিয় জেগে আছে না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে থাকলে থাকুক, সেই সুযোগে একটু অনুভব করুক। আর জেগে থাকলেও থাকুক, বুঝুক সে কতটা চায় প্রিয়কে! প্রিয় মনে মনে বলতে লাগল, ‘প্লিজ, ডোন্ট কিস মি।’
নিকিতা প্রিয়র কপালে খুব ভয়ে ভয়ে ঠোঁট ছোঁয়াল। প্রিয় কি ধমক দেবে, নাকি আরেকটু বাড়াবাড়ি করলে ধমক দেবে, সেটা ভাবতে ভাবতেই নিকিতা নিজের জায়গায় সরে গেল। প্রিয় হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
·
·
·
চলবে.....................................................................................