নিক অনেকক্ষণ ধরে নোহারার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিঃশব্দ সন্ধ্যায় ওর দৃষ্টি আটকে আছে সেই তলার বারান্দায়, যেখানে নোহারা থাকে। আজ কাজ থেকে ফিরে আসতে বেশ দেরি হয়ে গেছে তার। তবু অপেক্ষা শেষ হচ্ছে না। নিক চাইছে সরাসরি কথা বলতে। মেয়েটার আচরণ তাকে দ্বিধায় ফেলেছে। বুঝে উঠতে পারছে না এই দূরত্বের মানে কী? চাইলেই সে শপের সামনে দাঁড়াতে পারতো। কিন্তু সে জানে এই সময়টায় নোহারাকে ওখানে আর পাওয়া যাবে না। নিকের মুখস্থ হয়ে গেছে নোহারা ঠিক কখন বাড়ি ফেরে।
কিন্তু আজ সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তবু মেয়েটার দেখা নেই। অস্থির হয়ে উঠলো সে। পকেট থেকে ফোন বের করে ধীর হাতে কল লাগালো। স্ক্রিনে লিটেল গার্লফ্রেন্ড লেখাটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। কতক্ষণ টুট টুট শব্দ করে ফোনটা কেটে গেলো। নিক ফোন নামিয়ে চমকে উঠলো। আবারো উপরের তলায় চোখ রাখলো সে। সামনে এগিয়ে ভিতরে ঢুকলো। পাশের চেয়ারে বসে থাকা দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলো,
"নোহারা আজ বাসায় ফিরেছে জানেন কী?"
দারোয়ান চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করলো,
"কে নোহারা?"
নিক ফোন থেকে নোহারার একটা ছবি বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বলতে লাগলো,
"ওর আরেক নাম নুরুল।"
দারোয়ান নিককে ফোন ঘাঁটা হতে থামালো। মাথা নাড়িয়ে বললো,
"নুরুলরে আমি ভালো মতোই চিনি। ওর গ্রামের বাড়ি নরসিংদীতে না? আমার ও ওদিকেই বাড়ি আছিলো। ওয় আজকা বাড়ি ফেরে নাই আমিও খেয়াল করছি। কিন্তু মাঝেমধ্যেই এমন করে। তয় তুমি কেডা আবার?"
নিক একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে শান্ত গলায় বললো,
"আমি ওর বন্ধু। মানে ওর খুব কাছের মানুষ। ও বাড়ি ফিরলে একটু জানাবেন আমাকে? আমি আমার নাম্বারটা দিচ্ছি একটু লিখে রাখুন।"
দারোয়ান নিজের বয়স্ক হাতে নাম্বারটা ফোনে টুকে নিলো।নিক নাম্বার দিয়ে সেই স্থান থেকে বাইরে বেরিয়ে আসলো। নোহারাকে আরো কয়েকবার কল করলো। বেশ অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে নোহারা কল ওঠালো। নিক উত্তেজিত হয়ে পড়লো।
কঠোর গলায় শুধালো,
"এই মেয়ে! কোথায় আছো?"
নোহারার ব্যথিত স্বর শোনা গেলো। সে ফিসফিসিয়ে বললো,
"সন্ধ্যা ভাইয়া! আমার খুব ভয় করছে।"
"কি হয়েছে?"
চমকে উঠলো নিক।
নোহারা আরো নিচু স্বরে বললো,
"আমি গ্রামে যাওয়ার জন্য বাসে উঠেছিলাম। কিন্তু বাসটা কোথায় যাচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। রাস্তা চেনা লাগছে না। লোকগুলোকে দেখে আমার আরো ভয় লাগছে।"
"এই রাতে গ্রামে? কোথায় আছো? কোন বাসে উঠেছো?"
নিকেরও মাথা কাজ করছে না। নোহারার কিছু হয়ে গেলে সে একদম ঠিক থাকতে পারবে না।
নোহারা শুধু বাসের নামটাই বলতে পারলো।নিক নোহারাকে স্বান্তনা দিয়ে বললো,
"লিটেল গার্লফ্রেন্ড! তুমি আমার ব্রেভ গার্ল ওকে? সো ভয় পাবে না। তোমার বয়ফ্রেন্ড খুব শীঘ্রই আসছে। সো একটু অপেক্ষা করো। ওকে? এন্ড আই লাভ ইউ।"
নোহারা নিকের মিষ্টি কথা শুনে ছোটখাটো একটা শক খেলো। ঢোক গিলে সে ফোনটা কেটে দিলো।
কিছুক্ষণ পূর্বে জানালায় মাথা রেখে সে ঘুমানোর ভান করেছিল। তখনই ফোনটা অনবরত বাজছিল তাই উঠাতে পারছিলো না। বাসের নিঃশব্দতা ফোনের শব্দে ভেঙে গিয়েছিল। আর যে কয়টা লোক ছিল নোহারার দিকে আরো বেশি করে মুখিয়ে তাকানো শুরু করে দিয়েছিল। তাই নোহারা প্রথমেই ফোনটা চুপিসারে সাইলেন্ট করে ফেলে তারপর কল ওঠায়।
বাসের লোকজনকে সন্দেহজনক লেগেছিল যখন বাসের হেলপার তার বরাবর পাশের একটা সিটে বসে নোহারাকে দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। নোহারা পেছনের মানুষদের দিকেও তাকায় সবার চোখ নোহারার দিকেই ছিল। এতেই নোহারার ভয় লেগে যায়। সে বাইরে রাস্তায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু অন্ধকারে রাস্তাগুলো দেখেও অচেনা মনে হয়। আরো ভয়ে শরীর হিম হয়ে যায়। মনে হতে থাকে ইশশ আজ রাতে কেনো যে বের হতে গেলাম।
******
অনন্যাকে গেস্ট রুমে নিয়ে আসে রুম্পা। রুমটা বেশ সাজানো গোছানোই। কিন্তু বেশি আসবাবপত্র নেই। তবে যাই আছে সব দেখেই বোঝা যাচ্ছে দামী ব্র্যান্ডের। রুম্পা ঘরটা একটু ঝাড়ু দিয়ে দিলো। ঝাড়ু দেওয়া শেষে অনন্যার দিকে তাকিয়ে বললো,
"আমি রান্নার কাজ করি বেশিরভাগ। মাঝেমধ্যে টুকটাক এইটা ওইটা করি। কিন্তু আপনের এই রুম আপনেরেই ঝাড়ু দিতে হইবো। মাগনা থাকতাছেন এইটুকু তো করতেই পারবেন হু?"
অনন্যা হেসে ফেললো। রুম্পার কাঁধে হাত রেখে বললো,
"তা তো পারবোই। কিন্তু তোমার এরকম কঠোর কথা শুনে মুগ্ধ ই হলাম। বেশ ভালো লাগলো।"
রুম্পা ঘাবড়ে গেলো। অনন্যার হাত কাঁধ হতে সরিয়ে বললো,
"কি কইতাছেন আমি কিছু বুঝতাছি না।"
অনন্যা মৃদু হেসে রুম্পার তেল দেওয়া চুল ঠিক করে দিয়ে বললো,
"এই যে সবার কাছে নিজেকে শক্ত রাখার বিষয়টা আমার ভালো লেগেছে। আর মেয়ে আমাকে নিয়ে তোমাকে আর চিন্তা করতে হবে না।"
রুম্পা বিস্ময়ে মুখ খুলতে পারলো না। অনন্যা তাকে জোর করে বাইরে পাঠিয়ে দিলো। রুম্পা যাওয়ার পর অনন্যা বিছানায় এসে বসলো। চোখ ঘুরিয়ে রুমটা একবার ভালোমতো দেখে নিলো। অতঃপর বিছানায় শুয়ে পড়লো। এই রুমে সে একা থাকলেও এই বাড়িতে মানুষ আছে। বিশেষ করে কৌশিক স্যার! এই ব্যাপারটাই অনন্যার খুব ভালো লাগছে। মনের মধ্যে শান্তি শান্তি অনুভব হচ্ছে। আবারো সেই দিনগুলো কবে যে ফিরে আসবে। কবে আবার প্রিন্সটাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোতে পারবে এই চিন্তায়ই অনন্যা কে ঘিরে ধরেছে। ভবিষ্যতে কি হবে অনন্যা জানে না কিন্তু কৌশিক স্যারকে সে হাতছাড়া করতে চায় না। আবার স্যারের মাকে আজ ওপেন চ্যালেঞ্জ দিয়ে এসেছে সে।
অনন্যা মনে মনে বললো,
"মিসেস হার্ট ! তোমার ভালোই বাড় বেড়েছে। বড়দেরকে এভাবে চ্যালেঞ্জ করো।
আহ! প্রিন্স সামনে থাকলে এভাবেই হয়তো কথা বলতো নাকি অনন্যাকে বাহবা দিতো?"
আচমকাই আবারো খুব কষ্ট হচ্ছে অনন্যার। খুব কষ্ট! সে উঠে বসলো। রুমের দরজাটা খোলা ছিল। চুপচাপ পা টেনে বাইরে বেরিয়ে এলো অনন্যা। চুপচাপ করিডোরে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালো। ডান পাশে তিনটি ঘর সারি ধরে দাঁড়িয়ে। প্রতিটির দরজাই বন্ধ। বাঁ পাশে আরেকটু দূরে দেখা গেলো আরো দুটো রুম।
অনন্যা তখনো দ্বিধায় রয়েছে। নিঃশব্দ পায়ে করিডোরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কৌশিক স্যারের ঘরটা ঠিক কোনটা। এই এক প্রশ্নেই বারবার চোখ ছুটছে দরজাগুলোর দিকে। ডান পাশের রুমটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো অনন্যা। হাত বাড়িয়ে নব ছোঁয়ার আগ মুহূর্তে থেমে গেলো। অজানা সংকোচে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সামনে।
চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে পাশের রুমে এগিয়ে গেলো সে। নব ঘুরিয়ে দেখলো লক করা। তবু আরও এক দু'বার চেষ্টা করলো নিশ্চিত করার জন্য। হাল ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে পা টেনে নিজের রুমের দিকে ফেরত চললো। ঠিক তখনই ওর রুমের ডান পাশের দরজার সামনে পৌঁছাতেই হঠাৎ করেই শব্দ হলো। দরজা খোলা হচ্ছে কারও। চমকে দাঁড়িয়ে গেলো অনন্যা। কিছু বোঝার আগেই দরজাটা পুরোপুরি খুলে গেলো আর দেখা গেল কৌশিক স্যারকে। স্যারের শরীরের উপরের অংশে কোনো পোশাক নেই। নিচের দিকে শুধু হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট পড়া।
অনন্যার চোখ মুহূর্তেই স্থির হয়ে গেলো। ভ্রু কিছুটা উঁচুতে উঠে গেল। ঠোঁট অল্প অল্প কাঁপছে। থমকে দাঁড়িয়ে রইল সে। আর বুকের ভেতরটা ধকধক করতে লাগলো। আর চোখ দুটো চট করে সরিয়ে ফেলতেও পারছে না। কৌশিক স্যারের এই রূপ দেখে একটা বিষয় মাথায় চলে আসলো অনন্যার।
কৌশিক ও অনন্যাকে চোখের সামনে দেখে চমকে উঠলো। দ্রুত নিজের দরজা বন্ধ করে দিতে চাইলো। কিন্তু অনন্যার বদৌলতে তা আর সম্ভব হলো না। অনন্যার দরজা ধরে ফেললো। আর ভিতরে ঢুকে দরজা আটকিয়ে দিলো। দরজার সামনে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।
কৌশিক অনন্যাকে দেখে বিছানার দিকে তড়িঘড়ি পায়ে এগিয়ে গেলো। বিছানায় পড়ে থাকা ময়লা স্যান্ডো গেঞ্জিটাই শরীরে পড়ে নিলো। কৌশিকের শরীরের উপরে সজ্জিত বিন্দু বিন্দু ফোঁটাগুলো খুব সুন্দর করে মুছে গেলো।
অনন্যা মুখ থেকে টু শব্দটিও করলো না। শুধু ধীরে পায়ে কৌশিকের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো। কৌশিক অনন্যার আচরণে হতবাক হয়ে গেল। ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলো,
"আর ইউ ওকে? এভাবে কাছে এগিয়ে আসছেন কেন? আর রুমে প্রবেশ করার পারমিশন কে দিলো আপনাকে?"
অনন্যা এতোটাই কাছে এগিয়ে এসেছে যে কৌশিক না পারতে বিছানায় পড়ে গেলো। অনন্যা কৌশিকের ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ কৌশিকের দিকে তাকিয়ে থেকে নিচুতে ঝুঁকে পড়লো সে। কৌশিকের স্যান্ডো গেঞ্জি চট করে তুলে সে কিছু একটা দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কৌশিক তাকে আটকিয়ে বললো,
"এই কি হচ্ছেটা কী? আজ কি আমার শরীরে কলঙ্ক লাগিয়ে ছাড়বে?"
অনন্যা সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
"চুপ করুন তো। আমাকে কাজ করতে দিন।"
"কি এমন কাজ? আজব! আমার শরীরে কি তোমার কাজ লেখা আছে?"
অনন্যা এবার কঠোরভাবে কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
"পিছনে ঘুরুন। আমি আপনার পিঠ দেখবো।"
কৌশিক হকচকিয়ে বললো,
"অনন্যা শিকদার! লজ্জা শরম বলতে কি কিছু নেই তোমার? নিজের স্যারের শরীর দেখার জন্য এসব অদ্ভুত আচরণ করছো!"
অনন্যা আরো কাছে এগিয়ে আসলো। একদম কৌশিকের মুখের সামনে এসে পৌঁছালো অনন্যা। চোখে চোখ রেখে ফিসফিসিয়ে বললো,
"যেই মূহুর্ত থেকে আমাকে কোলে নিয়েছেন, যেই মূহুর্ত থেকে আমাকে খাইয়ে দিয়েছেন ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে আমাদের সম্পর্ক অন্য কিছুতে পরিবর্তিত হয়ে গেছে।তাই বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না, স্যার। চুপচাপ পিছনে ঘুরুন আর আমাকে দেখতে দিন।"
কৌশিক পিটপিট করে তাকালো। মুখটা একটু উঁচু করতেই অনন্যার নাকে কৌশিকের নাক স্পর্শ করে গেলো। কৌশিকের হৃৎপিণ্ড হঠাৎই এতো জোরে আওয়াজ করছে যে সে সামলাতে পারছে না। কে জানে অনন্যা শব্দটা শুনছে কিনা। শুনলেও কি ভাবছে কে জানে।
কৌশিক এক হাত অনন্যার কাঁধে রেখে অল্প একটু ধাক্কা দিয়ে বললো,
"একটু সরুন। আমি পিছনে ঘুরে দাঁড়াচ্ছি।"
অনন্যা সরে দাঁড়ালো। কৌশিক স্যান্ডো গেঞ্জি নামিয়ে পিছনে ঘুরে দাঁড়ালো সে। অনন্যা কৌশিক স্যারের পিছনে দাঁড়িয়ে লোকটার স্যান্ডো গেঞ্জি ধীরে ধীরে উঠাতে লাগল।
কৌশিক স্যার বিরক্তের সাথে বললো,
"আজ আমার সবকিছু আপনাকে দেখিয়ে ফেললে আমার বউকে কি দেখাবো!!"
অনন্যা কৌশিকের পিঠে কিছু দাগ খুঁজতে খুঁজতে বললো,
"অন্য কাউকে এই শরীর দেখালে আপনাকে থেঁতলে ফেলবো।"
অনন্যার এই কথায় কৌশিক একদম চুপ হয়ে গেল। কৌশিক স্যারের চুপ হয়ে যাওয়া দেখে অনন্যা মৃদু হাসলো। কিছুক্ষণ পর স্যারের গেঞ্জি ছেড়ে দিয়ে অনন্যা চিন্তায় পড়ে গেলো।
উত্তেজিত স্বরে বললো,
"নেই! আপনার শরীরে কোনো দাগ নেই। কিন্তু কেনো? আমি এসবের লজিক বুঝতে পারছি না।"
কৌশিক সামনে ফিরে সরু চোখ নিয়ে বললো,
"কিসের লজিক? কি বুঝতে পারছো না তুমি?"
অনন্যা দুই হাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরলো। কৌশিক স্যারের দেহে কিছু দাগ ছিল যেটা ওনাকে পুরোনো দিনের অত্যাচার, নির্যাতনের কথা মনে করিয়ে দিতো। কিন্তু এই কৌশিক স্যারের দেহে সেসবের কিছুই নেই। একদম পরিষ্কার তার দেহ। কিন্তু এমন কেনো?
কৌশিক কিছুটা কাছে এগিয়ে আসলো। অনন্যার হালচাল দেখে ওর সন্দেহ হতে লাগলো। চিন্তিত গলায় বললো,
"কি হয়েছে?"
"না কিছু না।"
অনন্যা চোখ তুলে বললো।
পিছন ফিরে সে রুম থেকে চলে যেতে নিচ্ছিল। কৌশিকই ওর হাতটা ধরে ওকে থামিয়ে দিলো। অনন্যা থেমে গেল, কিন্তু মনের ভেতরে প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল হাজারটা। কৌশিক শুধালো,
"আর ইউ ওকে?"
অনন্যা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
"একটু আগে কি খুঁজছিলে?"
অনন্যা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। কৌশিক তার হাত ছেড়ে দিলো। অনন্যা নিচু স্বরে বললো,
"আমি বারবার একই জায়গায় থেমে যাই। আমি কেনো ঠিক ডিসিশনটা নিতে পারছি না? জানেন আমি কেনো তার জন্য পাগল? কারণ উনি আমাকে এতো ভালোবেসেছেন যে নিজের এতো বছরের জীবন আমার জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। একবার নয় বারবার। আমি তাকে কেনো খুঁজবো না? কেনো তার জন্য পাগলামি করবো না? উনি নাই এই কথা স্বীকার করে আমি এই পৃথিবীতে বাঁচতে পারবো না।"
অনন্যার চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি ঝরে পড়লো। সে অশ্রু আটকাতে পিছমুখী ঘুরে গেলো। নাক টেনে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। তখনই কৌশিক বলে উঠলো,
"উনি নেই কে বলেছে?"
অনন্যার পা থেমে গেলো। কৌশিক বলতে লাগলো,
"উনি আছেন তোমার হৃদয়ে। উনি আছেন তোমার শরীরে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা তোমার অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে আছে বলেই উনি খুব সুখে আছেন।"
অনন্যা আর অশ্রু ধরে রাখতে পারলো না। দরজা খুলে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো এই রুম থেকে। নিজের রুমে দরজা লাগিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো সে।
কৌশিক অনন্যার চলে যাওয়া দরজার দিকে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলো। এরপর ধীরে ধীরে বিছানায় গিয়ে বসল। একসময় চোখ তুলে তাকালো সামনে রাখা বড় আয়নার দিকে। সেখানে প্রতিফলিত চেহারাটা তাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে। এই মুখ,এই চোখ,এই অভিব্যক্তি! এসব কি সত্যিই তার নিজের? কেনো মিল খুঁজে পায় সে অন্য কারো সাথে? এ কি শুধুই কাকতাল? না কি কোনো অদৃশ্য নিয়তির ইঙ্গিত? কেনো মিললো? কেনো বিধির বিধানে এমন আশ্চর্যজনক ঘটনা লেখা হলো? অনন্যা চলে গেছে কিন্তু অন্তরের দুঃখ কৌশিকের কাছে বিলিয়ে দিয়ে গেছে। মেয়েটার জন্য না চাইতেও কৌশিকের ভেতরটায় কষ্ট হচ্ছে। সত্যি তো অনন্যার হাসবেন্ড কোথায়? এই বাচ্চার বাবার দায়িত্বটাই কে নেবে?
*****
নোহারা শক্ত করে বাসের হ্যান্ডেল আঁকড়ে ধরে আছে। বাসটা আগের চেয়ে অনেক বেশি গতি নিয়ে রাতের নিস্তব্ধ রাস্তায় ছুটে চলছে। নিজের বোকামির কথা মনে পড়তেই মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিল সে। এমন রাতে, এমন ফাঁকা বাসে উঠে ভুলই করেছে। অন্য কোনো উপায় ভাবা দরকার ছিল কিন্তু তাড়াহুড়ো আর উত্তেজনায় সে সেসব নিয়ে একটুও ভাবেনি।
এসব নিয়ে চিন্তা করতে করতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে তাকিয়ে ছিল নোহারা ঠিক তখনই পেছন থেকে কাঁধে কারো হাতের চাপ পড়লো। ঢোক গিলে সে পিছনে তাকানোর প্রস্তুতি নিলো কিন্তু তার আগেই লোকটা পাশে এসে বসলো। কোনো কথা না বলে নোহারার কাঁধে থাকা ব্যাগটা টান মেরে নিয়ে ফেললো ওর কাছ থেকে। পেছনে থাকা আরেকজনের দিকে ছুঁড়ে দিল সেটি।
নোহারার ভেতরটা কেঁপে উঠলো। মুখ থেকে নিজে থেকেই বেরিয়ে এলো অসহায় চিৎকার। কিন্তু সে করুণ চোখে অনুভব করলো ব্যাগ নেওয়াতেই থেমে থাকেনি । লোকটা এখন ওর হাত ধরে জোরে টানাটানি শুরু করে দিয়েছে, শরীরে হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে। চেনা শহরের বুকেও অচেনা আতঙ্কে ঢেকে যাচ্ছে নোহারার চোখ-মুখ।
নোহারা সহ্য করতে না পেরে জোর গলায় বললো,
"ছাড়ুন! ছাড়ুন আমার হাত।"
কিন্তু লোকটা ছাড়ার কোনো নাম গন্ধও নিচ্ছে না। উল্টো পিছনের লোকগুলো আবার উঠে এসেছে। নোহারার দিকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হাসি দিচ্ছে । নোহারার কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। সবার হাত ধীরে ধীরে নোহারার দিকে এগিয়ে আসছে। নোহারা সবার হাত কাছে আসতে দেখে বাসের জানালার দিকে সেঁটে যেতে লাগলো। গলা ফাটিয়ে সে চিৎকার করে বসলো। আচমকাই জোরে ব্রেক কষে বাসটা থেমে গেলো। সবাই সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। নোহারাও হ্যান্ডেল ধরে চিন্তিত দৃষ্টি নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে প্রাণে ওর বিশ্বাস নিশ্চয়ই নিক এসে গেছে ওকে বাঁচাতে। নিশ্চয়ই ছেলেটা খুঁজে নিয়েছে ওকে। কিন্তু নোহারার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো যখন বাসে একটা অপরিচিত যুবককে উঠতে দেখা গেলো। শ্যামলা গড়নের যুবকটিকে দেখে সবাই এক ধরনের ভয় পেয়ে গেলো। নোহারার থেকে ছিটকে দূরে সরে গেলো লোকগুলো।
হেল্পার এগিয়ে এসে বললো,
"এখান থেকে যাত্রী উঠাই না আমরা। তাই নেমে যান।অন্য বাস ধরুন। "
ছেলেটা মৃদু হেসে বললো,
"একজন উঠালে কীইবা হবে? দুই পয়সা বেশি কামাতে পারলে তো আপনাদেরই লাভ! তাছাড়া আমি নরসিংদী যাচ্ছি।এই বাসটাও আমার জানামতে নরসিংদী যাচ্ছে? যখন এই চার পাঁচজন মানুষকে আপনারা নিতে পারছেন তাহলে একি জায়গায় আমি গেলে দোষ কি?"
যুবকটি হেল্পারের পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। নোহারার পেছনের সিটে নিজের জায়গা করে নিলো। ড্রাইভার আবারো গাড়ি চালাতে শুরু করলেন নোহারা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। মনে মনে ধন্যবাদ জানালো লোকটিকে।
নোহারা নিক কোথায় আছে তা জানার জন্য কয়েক বার কল লাগালো। কিন্তু কল কেউ ধরছে না দেখে নোহারা আরো চিন্তিত হয়ে পড়লো। এভাবেই কেটে যেতে লাগলো অপেক্ষার প্রহর। প্রায় আধাঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর বাসটি আবারো এক স্থানে থামলো। তখনি বেশ পার্ট নিয়ে বাসে উঠতে দেখা গেলো নিকোলাই ভেস্পারকে। নোহারার দিকে তাকিয়ে এক চোখ মারলো নিক। নোহারা মাথা নাড়িয়ে কপাল চাপড়ালো। নিক হাঁটতে হাঁটতে নোহারার পাশে এসে বসলো। প্রচন্ড হাঁপিয়ে গেছে বলে বাসের সিটে মাথা হেলিয়ে দিলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
"লিটেল গার্লফ্রেন্ড! খুব আফসোস হয় কেনো যে নিজের শক্তি হারালাম আমি। অনেক অপেক্ষা করে ফেলেছ না তুমি? "
নোহারা বললো,
"তা করেছি। কিন্তু তোমাকে দেখে এ অপেক্ষা স্বার্থক হয়ে গেছে।"
নিক সোজা হয়ে বসে বললো,
"এখন বলো কে তোমাকে জ্বালিয়েছে? ওই পিছনে থাকা লোকটি? নাকি অন্য কেউ? কে?"
"সন্ধ্যা ভাইয়া! পেছনে থাকা লোকটা আসাতেই আমি বেঁচেছি। নাহলে আজ কি হাল হতো আমার!"
নিক নোহারার দিকে তাকিয়ে রইল কিছু সময়। অতঃপর আচমকাই নোহারার মাথা নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরলো নিক। নোহারার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
"স্যরি বেইবি! আই অ্যাম সো স্যরি। বাট তোমার ও দোষ আছে ওকে! আর না বলে যাবে কোথাও?"
নোহারা দুদিকে মাথা নাড়লো। নিকের পেশিবহুল দেহে নিজের মাথা রেখে দিলো। কানে বাজলো জোরে জোরে উপরনিচ হতে থাকা হৃৎপিণ্ডের অলিন্দ - নিলয়।নোহারা মুখ তুলে আরো একবার দেখে নিলো নিককে। নিক নোহারার তাকিয়ে থাকা বুঝতে পেরে মেয়েটির কপালে সজোরে ঠোঁট চেপে ধরলো। নোহারা নিকের শার্ট টেনে ধরলো। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো মৃদু হাসি। কিন্তু দুজনে এখনো বুঝতে পারছে না ওদের পিছনে অপেক্ষা করছে মহা দুর্ভোগ।
·
·
·
চলবে..................................................................................