শিকদার সাহেবের দিনলিপি - পর্ব ১০ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          মীরার মানুষকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করা স্বভাব বন্ধ করতে চাইলে সবার আগে আমাকে অন্ধ বিশ্বাস করা বন্ধ করাতে হবে। তখনই কেবল ও বুঝবে যেখানে রাফিকেই বিশ্বাস করা যায় না সেখানে অন্য কাউকে কীভাবে বিশ্বাস করা যাবে? কিন্তু সেটা কিভাবে করা সম্ভব? আমি অনেক ভেবেছি এ ব্যাপারে। ভেবেচিন্তে একটা উপায় পেলাম। এরচেয়ে ভালো উপায় আর হয় না। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মরবে। মীরার মনে বড় রকমের একটা ভয়ও ঢুকানো যাবে। আর ওর সঙ্গে অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটানো যাবে। মা বাসায় নেই, বাবা থাকে সারাদিন অফিসে। রাহি রূপ তো কোনো ব্যাপার না। সুতরাং মীরাকে বাসায় নিয়ে আসি। ওর স্কুলের পিকনিক আছে সামনে। ও নাকি সারাদিনের জন্য বাইরে থাকতে পারবে। এটাই সুযোগ। সারাদিন রেখে বিকেলে বাসায় দিয়ে আসব। আর রাতের বেলায় বলব আমি ওকে ভয়ংকর এক কুমতলবে বাসায় এনেছিলাম কিন্তু পরে কোনো কারণে সিদ্ধান্ত বদলেছি। কী বলিস? অন্যকোনো কিছু দিয়ে কোনো মেয়ের মনে এতটা ভয় ঢোকানো সম্ভব না। যতটা এভাবে সম্ভব। আরে খারাপ ভাবলে ভাবুক। ছেড়ে তো আর যেতে পারবে না, বদ্ধপাগল হয়েছে সে আমার জন্য। ছাড়া সম্ভব না। তা ছাড়া সত্যি তো আর কিছু করছি না। ওকে শক্ত করতে হবে। এভাবে চলতে থাকলে এই মেয়ে ভেসে যাবে।

এই প্ল্যানটা যাতে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে পারি তাই এক্ষুনি মীরাকে বলছি যে ও নির্দোষ সেই প্রমাণ আমি পেয়েছি। কদিন পরে বলব। কী বলিস?

রাফসান শিকদার
০৪ ডিসেম্বর, ২০০৯

আজকে একসঙ্গে এতকিছু ঘটেছে যে কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখব বুঝতে পারছি না। ইচ্ছে করছে সব লিখি। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করব সেটাও বুঝতে পারছি না। আজকের দিনের এত ভালো ভালো মুহূর্তের মধ্যে একটা অঘটনও ঘটে গেছে। মীরাকে সময়মতো বাসায় পৌঁছে দিতে পারিনি। জ্যামের ভয়ে কত আগে বেরোলাম! কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অনেকগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর মীরাকে সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় পৌঁছে দিলাম। ওর বড় ভাই ওকে কৌশলে বাঁচিয়েছেন। শুধু এই একটি কারণে এই মানুষটিকে আমি আজীবন কৃতজ্ঞতা। জানাব।

খুব ভোরে আমি মীরাকে আনতে ঢাকা গিয়েছিলাম। নাখালপাড়া থেকে ব্যাংক টাউন অনেকটা রাস্তা। এতটা রাস্তা আসার পথে পুরোটা সময় ও আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বসে ছিল। একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। আমি একবার বলায় একটা মেয়ে আমার হাত ধরে এতদূর চলে এলো! ভাবা যায়!

প্রথম দিন থেকেই আমার মীরার কণ্ঠের ওপর আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি ছিল। তাই আমি ওর আর আমার সব কনভার্সেশন রেকর্ড করেছিলাম। ওকে বলতাম আমি তোমার কণ্ঠস্বর নিচ্ছি। ও এই নেয়ার মানে বুঝত না। আজ রেকর্ডিং শুনিয়ে সেই মানেটা বুঝিয়ে দিয়েছি। অবশ্য ও কতটা বুঝেছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত নই। সবটা খুলে না বললে তো কিছুই বোঝে না। আর আমার কেন যেন সবটা বলে দিতে ইচ্ছা করে না। কিছু বলে কিছু বাকি রেখে একটা রহস্য তৈরি করতে ভালো লাগে। রহস্য বিনে জীবন পানসে।

আমি ওকে নিয়ে ঘরে ঢুকেই দরজার ছিটকিনি তুলে দিলাম যাতে সন্দেহ করে। জিজ্ঞেস করেছে দরজা কেন লাগালাম। বললাম, খেয়ে ফেলব তাই। কিন্তু হায়! এই খাওয়ার মানে সে বুঝল না। কোনো সন্দেহই করল না। এতই অন্ধ বিশ্বাস তার আমার প্রতি!

মীরা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে নদী দেখছিল। আমি দেখছিলাম সিনেমার মতো সুন্দর একটি দৃশ্যের ফ্রেম। যে ফ্রেমের প্রান্তে একটি জানালা। জানালা দিয়ে দেখা যায় প্রবাহিত নদী। জানালার গ্রিলে চিবুক ছুঁইয়ে দাঁড়িয়ে এক কিশোরী। কিছু আমলকি পাতা সেই কিশোরীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জানালার গ্রিল ছুঁয়ে দিচ্ছে। গাছের ডালে বসা ছোট্ট চড়ই। বাতাস বইছে। কিশোরীর বাধা চুল খোলা হলেই দৃশ্যটি সয়ংসম্পূর্ণ হয়। আমি এগিয়ে গেলাম। ক্লিপ খুলে দিতেই চুলগুলো এলিয়ে পড়ল ওর পিঠজুড়ে। ও সঙ্গে সঙ্গে তাকাল আমার দিকে। সেই দৃষ্টিতে কিছু একটা ছিল, আমার নেশা হয়ে গেল। ইচ্ছে করল এভাবে কেটে যাক অনন্তকাল। মীরা এক পলক দেখে আবার চোখ নামিয়ে নিল। আমি বললাম, আশপাশের সব দেখো শুধু আমাকে ছাড়া। আজ একটু আমাকে দেখো তো। এরপর ও তাকল। এই প্রথম আমরা একইসঙ্গে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম, অনেকক্ষণ। আমি যদি আগেই ওকে ভালো না বেসে ফেলতাম তবে এই মুহূর্তেই ভালোবেসে ফেলতাম। এইভাবে কতক্ষণ কেটে গেল তা বলতে পারব না। কখন যেন আমার এই অবাধ্য চোখ দুটো একবার ওর ঠোঁটেও ঘুরে এলো। সেখানেই সর্বনাশটা হলো। আমার ইচ্ছে করতে লাগল একবার চুমু খাই। শুধু একবার। সমস্ত শরীরে শিহরণ বয়ে যেতে লাগল। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ল আজ ওকে যে উদ্দেশ্যে এখানে নিয়ে এসেছি তাতে আজ চুমু খাওয়া যায় না। নিজের সঙ্গে নিজের অসততা হয়ে যায়! আমি নিজেকে বোঝালাম আজ নয় রাফি, আজ নয়। অন্য কোনোদিন। সঙ্গে সঙ্গে ওকে নিয়ে ছাদে চলে গেলাম।

ছাদে গিয়েও আমি স্বাভাবিক হতে পারছিলাম না। ভীষণ অস্থির লাগছিল। সূর্যের আলোকরশ্মি গাছের ফাঁক দিয়ে তীর্যকভাবে এসে পড়ল ওর মুখে। অসহ্যরকম সৌন্দর্য কাকে বলে জানিস বকুল? যে সৌন্দর্য সহ্য করতে কষ্ট হয়! মীরার সৌন্দর্যকে মুহূর্তেই ওই সূর্যটা অসহ্যকর করে দিয়েছে। ইচ্ছে হচ্ছিল পুরো দুনিয়াকে একপাশে ফেলে রেখে ওকে বুকে টেনে নিই। একটা গাঢ় চুমু খাই। শুধু একবার। আর কিছু চাই না। লোকে দেখলে দেখুক, জানলে জানুক। আমার উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় হোক। কী যায় আসে! কিন্তু আজীবন মনের আগে মস্তিষ্ক চলেছে আমার। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আসলে যায় আসে অনেক কিছুই! বন্ধ ঘরে কিছু করলাম না এখানে করব? অসম্ভব। রাস্তায় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। যেটার ডাল এসে পড়ে আমাদের ছাদে। সেখান থেকে এক গোছা ফুল ছিঁড়ে ওর কানের পাশে গুঁজে দিলাম। ওর হাসি দেখে মনে হলো বিশ্বজয় করে ফেলেছে। মেয়েরা অল্পতেই এত খুশি কী করে হয়? ওকে বলার জন্য কিছু কথা ভেবে করে রেখেছিলাম। সেগুলোই বললাম। ওকে শক্ত করার জন্য এই কথাগুলো ভীষণ প্রয়োজন।

এক পর্যায়ে শুধু বললাম, আমি থাকি বা না থাকি আমার বলা প্রত্যেকটা কথা তুমি মনে রাখবে। এটা শুধু কথার কথা ছিল। আমি থাকব না কেন? এই মেয়েকে ছাড়া কি আমার চলবে? কিন্তু ওই কথা শোনামাত্র মেয়ের কাঁদো কাঁদো ভাব। ও ফোনে কাঁদলেই আমার যেমন অস্থির লাগে, যদি চোখের সামনে কেঁদে ফেলে আমি কি ঠিক থাকতে পারব? ওকে ধমকে বললাম, একদম কাঁদবে না। কান্নাকাটি আমার একদম পছন্দ না। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। সে কেঁদেই ফেলল। দু চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় জল গড়াচ্ছে। আমার বুকের ভেতরটা হঠাৎ ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগল। নিজের অবচেতন মনেই আমি ওকে টেনে সিঁড়িঘরের ভেতরে নিয়ে আসলাম। তারপর জড়িয়ে ধরলাম। মীরাও আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার মনে হতে লাগল দীর্ঘ খড়ার পর ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। বিড়ালছানার মতো গুটিশুটি মেরে ও আমার বুকে লুটিয়ে পড়েছে। আমার সমস্ত শরীর জেগে উঠল। কিন্তু আমি সবকিছুকে উপেক্ষা করে ওকে বোঝাতে লাগলাম, আমি কোথাও যাচ্ছি না। ওর সঙ্গেই আছি। কিন্তু ওকে শক্ত হতে হবে।

আজ আমি ওর নাম দিয়েছি হাওয়াই মিঠাই। জড়িয়ে ধরতেই যেভাবে গলে পড়ল হাওয়াই মিঠাই ছাড়া কিইবা ডাকা যায়?

রাফসান শিকদার
০৭ ডিসেম্বর, ২০০৯
·
·
·
চলবে....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp