কয়েক মাস পর…
ছুটির দিন। বিকেলবেলা প্রিয় ঘুম থেকে উঠতেই নিকিতা বলল, ‘আমার একটা কথা রাখবে?
প্রিয় আড়মোড়া ভেঙে বলল, ‘একদম না।
‘প্লিজ প্লিজ প্লিজ। তোমার পায়ে পড়ি।
‘উফ, এত জ্বালাও কেন? পায়ে পড়ার মতো আবার কী হলো?’
‘আজ রিদিমার বিয়ে। তুমি চলো না আমাদের সাথে।
‘রিদিমা কে আবার? নিকিতা অভিমান করে বলল, আমার ছোট বোন।
‘ও আচ্ছা। কিন্তু আমি তোমাকে আগেই বলেছি, আমার সাথে একদম বউ টাইপ ব্যবহার করবে না। তোমার বাপের বাড়ি আমি কেন যাব?
‘আমার বাপের বাড়ি না তো। বিয়ে তো কমিউনিটি সেন্টারে ‘
‘থাপ্পড় মেরে চেহারা বদলে দেব। তারপর মেকআপ করেও ঠিক করতে পারবে না। যাও, ভাগো।
‘আমার স্বামী হিসেবে না, আমার বন্ধু হিসেবে চলো।’
‘আমি তোমার ১১ বছরের বড়। আমি কীভাবে তোমার বন্ধু?
১১ না, ১০ বছর।
‘১০ বছর না, ১০ বছর ৯ মাসের বড়। খুচরো মাস যেহেতু ৬ মাসের বেশি, তাই ১১ বছরই কাউন্ট করতে হবে।’
‘আচ্ছা, যা-ই হোক, প্লিজ চলো। বেশিক্ষণ থাকা লাগবে না।
‘আচ্ছা, তোমার বোনের বিয়ে, তুমি এক মাস আগে না গিয়ে বিয়ের দিন যাচ্ছ কেন?
‘প্রতিদিনই তো গেছি। বিয়ের কত কাজ করেছি আমি। আজ ভালো করে সাজগোজ করার জন্য এখান থেকে যাচ্ছি।’
‘আসলে আমাকে নেওয়ার ধান্দায় এসেছ।
প্লিজ প্লিজ, চলো। তোমার কাছে জীবনে আর কিছু চাইব না। শুধু এই কথাটা রাখো।
‘প্রতিবার আবদার করার সময়ই তুমি এই কথাটা বলল।
‘আচ্ছা, এই কান ধরছি। আর এমন বলব না, তুমি শুধু আজকে চলো।
‘স্বামী ছাড়া বাপের বাড়ির প্রোগ্রামে গেলে অনেক কথা শুনতে হয়, তাই না, নিকিতা?
‘তা তো হয়ই। বিয়ের পর একবারও তো যাও নি। তবু তো কখনো বলি না।’
‘আর যাওয়ার পর যে জামাই জামাই করে মানুষজন এসে হামলে পড়বে, শালা-শালিরা এসে দুষ্টুমি করবে, তখন প্রচণ্ড বিরক্ত হওয়া সত্ত্বেও আমাকে প্রাস্টিক হাসি ঝুলিয়ে তাদের সাথে খাতির জমাতে হবে। অসহ্য! যাও তো, ভাগো। আমি যাব না।’
এমন সময় শুদ্ধ রুমে ঢুকল। ও আজ খুব সুন্দর একটা শেরওয়ানি পরেছে। দেখতে বেশ লাগছে। প্রিয়কে দেখেই বলল, ‘বাবা, তুমি রেডি হও নি যে! রিদিমা আন্টির বিয়েতে যাবে না?
‘না, তোরা যা বাপ।
‘না, প্লিজ, চলো বাবা, প্লিজ প্লিজ। নানুবাড়িতে অনেক মজা হয়।’
হঠাৎ শুদ্ধর চোখ পড়ল নিকিতার দিকে। বলল, ওয়াও, নিকিতা আন্টি, তোমাকে তো এঞ্জেলের মতো লাগছে। বাবা দেখো, আন্টি কী সুন্দর!
প্রিয় এবার খেয়াল করে তাকাল। নিকিতা একটা সোনালি রঙের শাড়ি পরেছে। খুব সুন্দর করে সেজেছে। হালকা গয়না পরেছে। যে কোনো ছেলের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো। প্রিয় হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, বাহ, খুব সুন্দর লাগছে তো! দেখিস, আজকে রিদিমা আন্টির বিয়েতে কত ছেলে তোর নিকিতা আন্টির ওপর ক্রাশ খায়।’
এ কথা শুনে শুদ্ধ হাসতে লাগল। নিকিতা বলল, ‘ছি ছি, ছেলের সামনে কী বলছ এসব?
প্রিয় বলল, ‘তাতে কী হয়েছে, ছেলে তো বড় হয়ে গেছে।’
শুদ্ধকে তার দাদা ডাক দিতেই সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। নিকিতা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গয়নাগাটি সব খুলতে লাগল। প্রিয় বলল, ‘একী! খুলছ কেন? ছেলেরা ক্রাশ খাওয়া ভালো তো।
নিকিতা মুখ বেজার করে বলল, ‘আমি যাবই না।’
এ কথা বলে নিকিতা যখন নেকলেসটা খুলছিল, প্রিয় বাধা দিল। নিকিতাকে নিজের সামনে দাঁড় করাল। তারপর গাল টিপে দিয়ে বলল, ‘আরে যাও, এত কষ্ট করে এত সুন্দর করে সেজেছ। কয়েকটা ছেলের মাথা ঘুরিয়ে এসো।’
‘আবার! আমি যাব না, যাব না, যাব না।’
‘তোমার ইচ্ছা। কিন্তু তোমার ছোট বোনটার বিয়ে, না গেলে কষ্ট পাবে না?
‘তোমার কী তাতে?
প্রিয় হাসছে। নিকিতা হঠাৎ কান্না শুরু করে দিল। প্রিয় বলল, ‘আরে আরে, মেকআপ নষ্ট হয়ে যাবে তো। আচ্ছা, ঠিকাছে, যাও, আমি যাব। কিন্তু একটা শর্ত আছে।
নিকিতার মুখে হাসি ফুটল। বলল, ‘একশটা শর্ত মানতে রাজি আমি।’
‘আমি যাব আর আসব। বেশিক্ষণ থাকব না।’
‘ঠিকাছে, তা-ই হবে।’
‘ওকে ডান। এখন বের হও, আমি রেডি হব।
নিকিতা খুশিতে লাফিয়ে উঠে প্রিয়র গালে একটা চুমু খেল। প্রিয় বিরক্ত হয়ে বলল, ‘যাব না, যাহ।’
নিকিতা শাড়ির আঁচল দিয়ে প্রিয়র গালটা মুছে দিয়ে বলল, ‘সরি, আর হবে না।
‘রাখ তোর সরি। বেশি লাই দিয়ে ফেলেছি, না?
নিকিতা নিজের গাল পেতে দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা ভুল হয়ে গেছে, আমার চুমুটা আমাকে ফিরিয়ে দাও তাহলে শোধবোধ হয়ে যাবে।’
‘থাপ্পড় মারব আমি তোমাকে!’
নিকিতা সরি বলতে বলতে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। প্রিয় বিরক্ত হয়ে গালটা বারবার মুছতে মুছতে বিড়বিড় করল, ‘পাগল-ছাগল কোথাকার!
—————
পেট্রা ময়ূরকণ্ঠী রঙের একটা জামদানি শাড়ি পরেছে। কানে সোনালি ঝুমকা। গলা খালি, হাতে দুটো চুড়ি, হালকা সাজগোজ। আজ আনিসার বড় বোনের বিয়ে। আনিসা নিজে এসে দাওয়াত দিয়ে গেছে। পেট্রা যেতে চাইছিল না, আনিসা ও রায়ানের জোরাজুরিতে যাচ্ছে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। আনিসার পরিবার সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। কিন্তু কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকেই পেট্রার চোখ কপালে উঠে গেল। নিকিতা এখানে! আশপাশে প্রিয় বা শুদ্ধকে তো দেখছে না। নিকিতা একা এসেছে? ও কি ছেলেপক্ষ, না মেয়েপক্ষ? এসব ভাবতে ভাবতেই নিকিতা ওকে দেখে দৌড়ে এল? হেসে বলল, ‘আরে পেট্রা আপু, তুমি এখানে!
পেট্রাও হেসে রায়ানকে দেখিয়ে বলল, ‘আমার ভাই রায়ান। কনের ছোট বোন ওর বন্ধু।
‘তাই? আনিসার বন্ধু, নাকি আনিকার?
পাশ থেকে রায়ান বলল, ‘আনিসা।
পেট্রা জিজ্ঞেস করল, তুমিও মেয়েপক্ষ?
নিকি হেসে বলল, ‘ওরা আমার ছোট বোন আপু। আমি সবার বড়, তারপর রিদিমা, তারপর আনিসা, আর সবার ছোট আনিকা।’
পেট্রার পিলে চমকে গেল। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। নিকিতা অবশ্য কিছুই খেয়াল করতে পারল না। পেট্রার হাত ধরে টেনে অন্যদিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘আপু, ভাই ওর বন্ধুদের সাথে থাকুক। তুমি এসো আমার সাথে। শুদ্ধ তোমাকে দেখলে খুব খুশি হবে।
রিদিমা, আনিসা, আনিকা–সবাই শুদ্ধকে খুব আদর করে। তাই শুদ্ধও তাদের খুব পছন্দ করে। আনিসা ও আনিকা আন্টির মাঝখানে বসে যখন গল্প করছিল শুদ্ধ, দূর থেকে দেখতে পেল নিকিতা আন্টি ওর মাকে হাত ধরে নিয়ে আসছে। কয়েক সেকেন্ড ও কিছু বুঝতে পারছিল না। তারপর এক দৌড়ে মায়ের কাছে চলে গেল। পেট্রা ওকে কোলে তুলে নিল। শুদ্ধর বয়স প্রায় ৯। হাতে-পায়েও বড় হয়েছে, তবু পেট্রা ওকে কোলে নেয়। তা ছাড়া সে শান্তি পায় না। শুদ্ধ যথারীতি মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। পেট্রার চোখেও জল এল। কিন্তু মুখে হাসি। শুদ্ধ ও পেট্রা যে দেখা হলেই কান্নাকাটি করে, তা আসলে এত দিন না পাওয়ার কষ্ট থেকে নয়, হুট করে পেয়ে খুশিতে কাঁদে। পেট্রা বলল, ‘ইশ, আমার ছেলেটা এত বড় হয়েও কাঁদছে দেখো। লোকে দেখলে কী বলবে!”
পাশে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে মা-ছেলের মিলনদৃশ্য দেখছিল নিকিতা। ওর কাছে দারুণ লাগছিল। যেন তারই বহুদিন পর দেখা হয়েছে তার ছেলের সঙ্গে। শুদ্ধর কান্নাটা কমে এলেই ও নিকিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নিকিতা আন্টি, তুমি আমার মাকে নিয়ে এসেছ আমার কাছে। তুমি খুব ভালো, খুব খুব খুব।
নিকিতা হাসল। পেট্রা বলল, ‘একী বাবু! তুমি ওকে আন্টি বলছ কেন? মা হয় তো তোমার।
নিকিতা অবাক হলো পেট্রার কথা শুনে। আর নিজের গালেই নিজের চড় মারতে ইচ্ছা হচ্ছিল এমন মানুষকে বারবার ভুল বোঝার জন্য। পেট্রার জায়গায় থাকলে ও এমনটা কখনোই পারত না। শুদ্ধ বলল, ‘সরি। নিকিতা মা, তুমি অনেক ভালো। আর তুমি আমার আন্টি না, তুমি আমার মা।’
নিকিতা এক ভুলে মা ডাক শোনা থেকে বঞ্চিত থেকেছে অনেক দিন। এখন আবার মা ডাক শুনতে পেয়ে খুশিতে মনটা নেচে উঠল। শুদ্ধর মতো ছেলের মা হতে যে-কেউ চাইবে। ওর মুখের মা ডাক পৃথিবীর যে-কোনো মিষ্টির থেকে বেশি মিষ্টি। নিকিতা কিছু বলতে পারল না, শুধু হাসল।
দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছিল প্রিয়। ট্রেী এখানে কীভাবে এল, তা সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু নিকিতাকে ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না। নিকিতা এত সহজ-সাবলীল আছে কীভাবে? যে মেয়ে পেট্রার নাম শুনলে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠত, তার এখন পেট্রার সঙ্গে এত খাতির! এর পেছনের রহস্য কী? এর আগেও কি ওদের দুজনের কোথাও দেখা হয়েছিল? কিন্তু সেটা হওয়া সম্ভব না। আর হলে তো সে জানত।
বছরখানেক বাদে তাদের আজ সরাসরি দেখা। ঠিক প্রথম প্রেমের মতোই হৃৎস্পন্দন চক্রবৃদ্ধিহারে বাড়ছে। দূর থেকে প্রিয় পেট্রাকে লুকিয়ে দেখছে। চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। পেট্রা অবশ্য তাকাচ্ছে না। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে নি। পেট্রা ইচ্ছা করেই দূরে দূরে আছে। যত যা-ই হোক, এটা প্রিয়র শ্বশুরবাড়ির অনুষ্ঠান।
পেট্রা ও রায়ান রিদিমাকে গিফট দিয়ে, শুভেচ্ছা জানিয়ে যত দ্রুত সম্ভব চলে যেতে চাইছিল। কিন্তু নিকিতা ডিনার না করে কিছুতেই যেতে দেবে না ওদের। বাধ্য হয়েই থাকতে হলো। পেট্রা খাওয়ার সময় শুদ্ধকে পাশে বসিয়ে খাইয়ে দিল। ওদিকে রায়ান বা পেট্রা কারও গলা দিয়ে খাবার নামছে না। আনিসা নিকিতার বোন, এটা জানার পর থেকে দুজন দুরকম ভয়ে চুপসে আছে।
নিকিতা পেট্রাকে এগিয়ে দিতে এল। শুদ্ধ তখনো পেট্রার কোলে। পেট্রা শুদ্ধকে নামিয়ে নিচু হয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল, ‘ঠিকভাবে পড়াশোনা করবে, মা-বাবার সব কথা শুনবে। লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকবে, আচ্ছা মা?’
শুদ্ধ পেট্রার গালে চুমু দিয়ে হেসে বলল, ‘আচ্ছা মা।
নিকিতা একটু আস্তেই বলল যাতে রায়ান বা শুদ্ধ না শোনে, ‘আপু, তোমাকে ভুল বুঝে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি। সেসবের জন্য এখন খুব লজ্জা লাগে।’
পেট্রাও আস্তে করেই বলল, ওহ গড! তুমি এখনো সেসব মনে রেখেছ? আমি তো কবেই ভুলে গিয়েছি। তুমিও ভুলে যাও। জীবনে খারাপ-ভালো অনেক রকম ঘটনা ঘটে। খারাপগুলো ভুলে ভাললাগুলো নিয়ে বাঁচতে হয়, এটাই সুখী হওয়ার মূলমন্ত্র।
‘এখন বুঝতে পারছি প্রিয় তোমাকে কেন এত ভালোবাসে!’
পেট্রা বিব্রত বোধ করল। তড়িঘড়ি করে বলল, ‘নিকিতা, আমরা এখন আসি।’
‘আচ্ছা আপু। আর একটা কথা, তোমার যখন শুদ্ধকে দেখতে ইচ্ছা করবে, তুমি আমাকে ফোন করবে। আমি প্রিয়কে না জানিয়েই তোমাদের দেখা করিয়ে দেব। তাতে শুদ্ধও ভালো থাকবে।
পেট্রা হেসে বলল, তোমার শ্বশুর ব্যাপারটা ভালোভাবে নেবে না। উনি আমাকে সব সময় মনিটরিং করেন।’
নিকিতার মুখ থেকে হাসিটা মিলিয়ে গেল। পেট্রা একটু থেমে শুদ্ধর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘তবে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কারণে একবারই দেখা করতে চাইব, তুমি নিয়ে যেয়ো।’
‘আচ্ছা আপু।
‘ওদের দেখে রেখো।
নিকিতা হাসিমুখে মাথা সামান্য কাত করে সম্মতি জানাল।
—————
প্রিয় বেশিক্ষণ থাকবে না বলে গেলেও অনেকক্ষণই রইল। তারপর যখন বাসায় ফিরে এল, নিকিতাও তার সঙ্গেই ফিরল। শুদ্ধ গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। প্রিয় ওকে কোলে করে এনে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর পাঞ্জাবি খুলে ট্রাউজার নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। ফ্রেশ হয়ে যখন বের হলো, তখন নিকিতা গয়নাগাটি খুলে মেকআপ তুলছে। প্রিয় কোনো কথা না বলে শুয়ে পড়ল। নিকিতা ফ্রেশ হয়ে আসতেই প্রিয় জিজ্ঞেস করল, ‘রিদিমার বিয়েতে পেট্রা কীভাবে ইনভাইটেড ছিল?
‘আপুর ভাই আছে না রায়ান? ও আনিসার বন্ধু।
প্রিয় অবাক হলো। রায়ান ভার্সিটিতে ভর্তি হবে, আর আনিসা মাত্র ইন্টার ফার্স্ট ইয়ার। ওরা কীভাবে বন্ধু হয়? বন্ধু নাকি অন্য কিছু নিকিতা বলল, কী ভাবছ?’
‘তুমি আগে থেকে জানতে পেট্রা আসবে?
‘আরে না। আমি তো আপুকে ওখানে দেখে অবাক। আমি জানতামও ওর ভাই আনিসার বন্ধু।
‘আচ্ছা। কিন্তু তোমাদের এত খাতির হলো কবে?
‘মানে!
‘তুমি তো পেট্রাকে দেখতেই পারতে না। আর আজ তো দেখলাম ভালোই মাখামাখি।’
‘তখন তো আমি আপুকে ভুল বুঝে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম।
‘ঠিকাছে, কিন্তু এই ভুল-বোঝাবুঝিটা মিটল কীভাবে?
‘আপুই তো ফোনে বোঝাল।
‘হুম, কিন্তু প্রথম দেখায় দুজন মানুষ এভাবে মিশতে পারে না। এর আগে তোমাদের কোথায় দেখা হয়েছে?
নিকিতার ভয় করতে লাগল। পেট্রার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা তো ও জানায় নি প্রিয়কে জানানো ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারছিল না। পেট্রা আপু এ ব্যাপারে কিছু বলে নি। প্রিয় কী-না-কী রিঅ্যাক্ট করে, সেই ভয়ে ও এত দিন চুপ ছিল। কিন্তু এখন তো প্রিয় ধরেই ফেলেছে। ভয়ে ভয়ে বলল, তুমি যখন রাগ করে চলে গিয়েছিলে, তখন দেখা হয়েছিল একদিন। অনেক কথাও হয়েছিল। সেদিনই আরও ভালো করে বুঝলাম আমি আপুকে শুধু শুধু ভুল বুঝেছি। পরে মাফ চেয়ে নিয়েছি।’
প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ওহ।’
আর ঘটাল না। নিকিতা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। বকা খাওয়ার মতো কিছু করে নি, বুঝে গেল। সাহস করে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি পেট্রা আপুর সাথে কথা বললে না যে?’
প্রিয় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোমার শ্বশুর গ্যাঞ্জাম করত।
‘কেন? তোমরা যে আগে মাঝেমধ্যে দেখা করতে, সেটা তো সে জানত। তখন তো কিছু বলে নি।
‘হুম, কিন্তু এটা তোমার বাপের বাড়ির প্রোগ্রাম তো। অলরেডি শুদ্ধ ওর কাছেই ছিল পুরোটা সময়। আমিও কথা বলতে গেলে ওনার মান সম্মানে লাগত। এমনিতেও আমি কথা বলতাম না। কারণ, পেট্রা সেটা পছন্দ করত না। তাও উনি এসে আমাকে সাবধান করে গেছেন, যাতে আমি পেট্রার কাছে না যাই।’
নিকিতা অবাক হয়ে প্রিয়র পাশে বসে বলল, ‘বলো কী, এত ঘটনা কখন ঘটল?
‘তোমার শ্বশুর কখন কী করে, তা কাউকে টের পাইয়ে করে না।
‘আমি ওনাকে ঠিক বুঝতে পারি না। কখন যে কী চায়, বোঝ মুশকিল।
প্রিয় নিকিতার গাল টিপে হেসে বলল, ‘এসব মানুষ সম্পর্কে সবটা বুঝতে নেই। বুঝলে দেখবে তার ছায়াও বিষাক্ত, প্রচণ্ড ভয়ংকর!
—————
পুরো রাস্তা রিকশায় দুই ভাইবোন কোনো কথা বলল না। বাসায় ঢুকে পেট্রা রুমে ঢুকতে যাবে, তখন রায়ান বলল, ‘দি সরি। আমি জানতাম না আনিসা প্রিয়দার শালিকা।
‘সেটা আমি জানি।
‘কী করব আমি, দি?
‘কী করবি বলতে? তুই কি ভয় পাচ্ছিস?
রায়ান মাথা নিচু করে বলল, আমি চাই না আমার জন্য তোকে কারও কাছে অপমানিত হতে থোক। আর আনিসাকেও ছাড়তে পারব না। অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি।’
‘ভয় পাস না। আনিসাকে কাল বাসায় নিয়ে আসিস। আমি একটু কথা বলব।’
‘আচ্ছা দি।
‘এখন যা, ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়।
রায়ানকে ভয় পেতে নিষেধ করলেও পেট্রার নিজেরই ভয় করছিল। নিকিতার প্রচণ্ড মাথাগরম। এমনিতেই ওর জন্য নিকিতার সংসারে অশান্তি। আবার ওর ভাইয়ের জন্য যদি বাপের বাড়িতেও অশান্তির সৃষ্টি হয়, তাহলে নিকিতা কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে, সে বুঝতে পারছে না। এই ভালো সম্পর্ক হয়তো থাকবেই না, উল্টো…আর কিছু ভাবতে পারছে না পেট্রা। তার জন্য মা-বাবা কষ্ট পেতে পেতে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। শেষ পর্যন্ত তার পুত্রতুল্য ছোটভাইটাও তারই জন্য কষ্ট পাবে? বুক ফেটে কান্না আসছিল, কিন্তু ভাইটা ঘাবড়ে যাবে বলে শক্ত ছিল। ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল পেট্রা।
·
·
·
চলবে....................................................................................