-“এই নাম্বারে আর কল দেবেন না, আরাধ্যা। আমি রিমি, আশিকের স্ত্রী।”
আর কিছু শুনতে পেলাম না, শোনার ইচ্ছা দেখালাম না। আলগোছে কেটে দিলাম কলটা। একরাতের ব্যবধানে আমি দুইবার মরে গেলাম। প্রথম মৃত্যু দিলো আমার বাবা, দ্বিতীয় মৃত্যু দিলো আমার শখের পুরুষ। আমার কান্না থেমে গেল আজীবনের তরে। আমি কেবল শ্বাস নিতে লাগলাম বেঁচে থাকার তাগিদে।
অকস্মাৎ পাশে কে যেন এসে বসল। এগিয়ে দিলো পানির বোতলটা। আমি কান্নাভেজা চোখে তাকালাম। জলে ভাসা চোখে অস্পষ্ট পুরুষ অবয়ব দেখে স্মিত হেসে বললাম,
-“থ্যাংক ইউ।”
আমার কৃতজ্ঞতাসূচক বাক্যে তিনি কেমন প্রতিক্রিয়া দেখালেন, ঝাপসা চোখে তা দেখতে পারিনি। তবে শুনতে পেরেছি একটা দীর্ঘশ্বাস। সেই দীর্ঘশ্বাসের সাথে তিনি বললেন,
-“আজ একটা মলিন দিন, কান্না করার দিন। আপনার যদি কান্না করতে ইচ্ছে হয়, আমি পাশে থেকে সহানুভূতি দেখাতে পারি।”
আমি পানিটুকু খেয়ে মৃদুস্বরে বললাম,
-“আমার কান্না করা উচিত নয়। ঠকে যাওয়া মানুষ আমি, ঠকবাজদের সফলতায় কান্না বেমানান।”
আমি যখন চট্টগ্রামে এসে পা ফেলেছিলাম, তখন খাঁ খাঁ রোদ্দুর ছিল। আর সেই স্থানটিই এখন ভীষণ গুমোট। আকাশে মেঘও ডাকতে শুরু করল হঠাৎ। ভদ্রলোক কিছু সময় থেমে ফের বললেন,
-“তাহলে আমি আপনার শ্রোতা হতে পারি। হাহাকারদের বুকে না লুকিয়ে শব্দের উৎস বানান। আমি পাশে থেকে আপনাকে শুনতে পারি।”
আমি থেমে গেলাম। নতদৃষ্টি তুলে সম্মুখে তাকাতে দেখতে পেলাম, প্রচণ্ড গতিতে গাড়িগুলো ছুটে যাচ্ছে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে ভারি হচ্ছে আমার মন খারাপের মেঘেরা। দৃষ্টি স্থির রেখে পাশের ব্যক্তিটির কাছে জানতে চাইলাম,
-“আপনার মন ভালো আছে?”
-“না।”
-“কেন?”
-“আমার বাবা মারা গেছেন। আপনার কেন মন ভালো নেই?”
-“গতকাল আমার বাবা মারা গেছেন, আর আজ প্রেমিক। এজন্য।”
-“সত্যিই?”
অবিশ্বাস্য কণ্ঠ তার, উত্তর দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজনবোধ করলাম না। বুকের ভেতর জমাট বাঁধতে থাকা মেঘেরা কালো রঙে আচ্ছাদিত হয়ে গেছে। কান্নারা জমে গেছে চোখের কোটরেই। কী আশ্চর্য! এরা না শোকাচ্ছে আর না গড়িয়ে পড়ছে! স্থির হয়ে যাওয়ার কারণ খুঁজে পেলাম না। আমার নিশ্চুপতায় ভদ্রলোক টের পেলেন, আমি উত্তর দেবো না এই প্রশ্নে। তিনি প্রসঙ্গক্রমে জিজ্ঞেস করলেন,
-“আপনি কী করে বুঝলেন আমার মন খারাপ?”
আমি মলিন হাসলাম,
-“একজন ভেঙে পড়া ব্যক্তিই অন্যের ভাঙন দেখতে পারে, এগিয়ে আসে, কাঁধে হাত রেখে ভরসা জোগায়। আপনি আমার ক্ষেত্রে তেমনটাই করলেন। বাবার জন্য মন খারাপ ভীষণ?”
-“তা ঠিক। একটু মন খারাপ।”
-“মন খারাপ করবেন না। নিয়তি এড়ানো অসম্ভব। এখন আমার নিয়তিতে যদি মৃত্যু থাকে, এই মুহূর্তে একটা গাড়ি আচমকা এক্সিডেন্ট করে আমার ওপর এসে পড়বে।”
ভদ্রলোক চমকে গিয়ে বললেন,
-“পাশে তো আমিও আছি। আমার মৃত্যুও আপনার সাথে হওয়ার সম্ভাবনা আছে? আমি এত দ্রুত মরতে চাই না। আমার কাঁধে অনেক দায়িত্ব।”
আমি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে উঠছি। হেসে উঠলাম মৃদুস্বরে,
-“আপনার কিছু হবে না। আমার মনে হচ্ছে আপনার নিয়তি অনেক সুন্দর।”
আমি তাকালাম লোকটার দিকে। লোক বললে ভুল হবে, কণ্ঠের গাম্ভীর্যের সাথে মুখটা ঠিক মিলছে না। বয়সের আন্দাজে এক দৃঢ় প্রত্যয়ী যুবক, গায়ের রঙ ঈষৎ তামাটে, চোখ দুটো বেশ সুচারু ও আইব্রো-আইল্যাশ ঘন। দেখতে কী আকর্ষণীয়! একদম হা করে তাকিয়ে থাকার মতো সুদর্শন সে। আমি হা হয়ে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। আমার বর্ণনামতো একটা মালবাহী ট্রাক ঠিক আমার সামনেই এক্সিডেন্ট করল।
তার ওপর থাকা ভারি ভারি বক্সগুলো ছিটকে আমার গায়ের ওপর পড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে এগোতেই পাশের লোকটা আমার মুখোমুখি হয়ে ঝুঁকে গেল। ফলস্বরূপ বোঝাগুলো তার পিঠে, গায়ে লাগল। একটা আঃ শব্দও সে করল না। অনিমেষ তাকিয়ে রইল আমার দিকে৷ বিগত চব্বিশ ঘন্টার মধ্যকার তৃতীয় বিস্ময়ে আমি বিস্মিত হলাম না, ট্রাককে না দেখার মতো ছেড়ে আমি এই মুহূর্তে তাকিয়ে রইলাম এই সম্পূর্ণ অচেনা অজেনা ছেলেটার দিকে, যার চোখ দেখে মনে হচ্ছে—সে আমার কতই না চেনা!
ছেলেটা কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-“আপনার নিয়তিতে এত জলদি মৃত্যু নেই, হাত ধরুন!”
আমি হাত ধরলাম না। সে নিজেই আমার হাত ধরে আমাকে উঠে দাঁড় করাল। আর তারপর আমার ব্যাগটা নিজের অন্যহাতে নিয়ে এক্সিডেন্টাল প্লেস থেকে সরে একটা ছাউনির নিচে নিয়ে এলো। আমার অন্যমনস্ক চাহনির দিকে তাকিয়ে তার উদ্বিগ্ন দৃষ্টির সাথে গম্ভীর স্বর,
-“ঠিক আছেন আপনি?”
তার চোখে চোখ আমার, আশেপাশে জমাট বাঁধা ভীড়, আকাশে মেঘের গর্জন, তীব্র ভ্যাপসা গরম। গুমোট এই দৃশ্যপটে আমি নির্জীব গলায় বলে উঠলাম,
-“জীবনের খাতা ঠিকই চলছে, কেবল পৃষ্ঠায় কালি লেগে আছে।”
ছেলেটার চোখ দুটোয় ঝড়, শব্দে নির্মলতা,
-“কালি মাখানো পৃষ্ঠা শূণ্য খাতার চেয়ে সহস্রগুণে ভালো। গল্পহীন জীবনের চেয়ে দূর্ঘটনা শ্রেয়।”
তারপর আচমকা ভীড়ের অগোচরে কোথায় যে সে মিশে গেল, আমার জানা নেই। যাওয়ার আগে তার ঠোঁট দুটো বিড়বিড় করে কী যে বলল, বুঝতে পারলাম না। চারপাশে মানুষের কোলাহল, গাড়ির যান্ত্রিক শব্দ! সব মিলিয়ে আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সদ্য আসা ঘূর্ণিঝড়কে তার মতোই যেতে দিলাম, মাঝখানে যে সে তার কতটা এলোমেলো করে গেল.. আমি নিজেও জানলাম না।
·
·
·
চলবে…………………………………………………………………