“বাবা আসব?”
শওকত সাহেবের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল কলরব। উনি বিছনায় শুয়ে ছিলেন। না উঠেই বললেন,
“আয়, এত রাতে? কিছু হয়েছে?”
বাবার পাশে বিছানায় বসে বলল,
“না বাবা, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
“নিহিন সম্পর্কিত?”
কলরব হাসল। বলল,
“হ্যাঁ”
শোয়া থেকে ওঠে বালিশে হেলান দিয়ে বসলেন শওকত সাহেব। তারপর জিজ্ঞেসে করলেন,
“কল্প ঘুমিয়েছে?”
“হ্যাঁ, এতক্ষণ ওর ঘুমানোর জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’ “আচ্ছা, বল কী বলবি।”
“ওই একটু আলোচনা। কী করব না করব।”
“তুই যা ভালো মনে করিস কর, আমি আছি তোর পাশে।”
“তা তো আমি জানি বাবা। কিন্তু এই মুহূর্তে ঠিক কী করা উচিত তা বুঝতে পারছি না।”
“প্রপোজ করেছিস?”
“না।”
“মানে? তাহলে কি করলি সারাদিন?”
“কথা বলেছি, তাছাড়া প্রপোজ করার কিছু নাই। ও খুব ভালোভাবে জানে আমি ওকে এখনো ভালোবাসি।”
“তোকে তো রোমান্টিক ভেবেছিলাম রে। এখন তো দেখছি তুই একটা মাকাল। বিয়ে করতে চাস, না বললে কী ও এসে বলবে ওগো আমাকে বিয়ে করো?”
কলরব হেসে বলল,
“তুমি বিয়ের প্রপোজালের কথা বলছো? সেটা তো করবই। আজই করে দিতে পারতাম কিন্তু একটু স্পেশালভাবে করতে চাচ্ছি। যেন সারাজীবন এ দিনটা ও মনে রাখে। ‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই’ বা ‘আমি তোমাকে বিয়ে করব’ সেটা তো সবাই বলে। আমার কি উচিত না একটু আলাদা হওয়া?”
বাবা কলরবের পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,
“এই না হলে আমার ছেলে।”
হাসল কলরব।
এরপর কলরবকে একটু চিন্তিত দেখাল। বলল,
“কিন্তু বাবা, কয়েকটা সমস্যা আছে। সেগুলো নিয়ে কথা বলতেই এসেছি।”
“হ্যাঁ, বলে ফেল।”
“প্রথম সমস্যা নিহিনের বাবা, আমাকে উনি কখনোই পছন্দ করতেন না। যদি উনি রাজি না হয়, নিহিন কখনো ফ্যামিলির বিরুদ্ধে গিয়ে একা একা আমাকে বিয়ে করবে না। ও ওরকম মেয়েই না।”
“মানবে ইনশাআল্লাহ, সে যদি অনুতপ্ত না হতো তাহলে এত বছর বাদে নিহিনকে সব বলে দিতো?”
“কী জানি।”
“আর আমি তো যাবই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, আমাকে নিশ্চই ফেরাবে না, যেখানে তুই এত বছর ধরে অপেক্ষা করে আছিস নিহিনের জন্য। আবার নিহিনও তো তোকে ভালোবাসে। দেখিস মেনে নেবে।”
“শুধু এটুকু পর্যন্ত হলে কি এত ভাবতাম বাবা? কল্প আছে তো। এক ছেলের বাপের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবে কেন?”
“কিন্তু কল্পর ব্যাপারে সত্যিটা বলে দিলেই তো ওরা বুঝবে।”
“সে নাহয় বুঝলো। কিন্তু বাবা যদি ওরা আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয় তাহলে তো জানবে যে কল্প আমার নিজের ছেলে।”
“সেটাতো সবাইকে সেরকম জানানো হয়েছে তাই। কারণ আমরা চাই না কল্প কখনো সত্যিটা জানুক।”
“তাও যদি বিশ্বাস না করে?”
“বেশি ভাবছিস রে বাবা। এত ভাবার দরকার নেই।”
“আরো সমস্যা আছে বাবা। কল্প ওর মায়ের ব্যাপারে কী পরিমাণ পজেসিভ তা তো জানো। আমি এখন বিয়ে করলে তো ও স্বাভাবিকভাবে নাও নিতে পারে।”
“আরে না। নিহিনের সাথে তো কল্পর খুব ভাব হয়ে গেছে। জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল, আবার ওর হাতে ভাত খেল। আদরের নাম দিয়ে দিল ‘মিষ্টি’।”
“কিন্তু বাবা সেটা ও করেছে ওর মায়ের মত দেখতে বলে। আমি বিয়ে করলে একটা অন্য ব্যাপার হবে। আমি তো চিনি কল্পকে।”
“তা অবশ্য হতে পারে। সেক্ষেত্রে ওকে বোঝাতে হবে আগেই, ওর অনুমতি নিয়ে নিতে হবে।”
“আমি অবশ্য একটা প্ল্যান ভেবেছি।”
“কী প্ল্যান?”
“যেহেতু কল্প ওর মায়ের সাথে খুব মিল পেয়েছে নিহিনের। সেক্ষেত্রে ওকে বললেই হয় নিহিনই ওর মা। এক কথায় বিশ্বাস করে নেবে, তখন অবশ্য ও জিজ্ঞেস করবে তাহলে ওর মা আমাদের সাথে থাকে না কেন?”
“তখন বলবি যে ওর নানাভাই তোর ওপর রাগ করে নিয়ে গিয়েছিল।”
“হ্যাঁ, তারপর যখন জিজ্ঞেস করবে কেন রাগ করেছিল তখন কী বলব? তাছাড়া তারপর তো ও নিহিনের বাবাকে অপছন্দ করবে “তাতে তোর সমস্যা কী? ভিলেনদের ওরকম একটু হয়।”
“বাবা, তুমি যে কী বলো!”
হেসে ফেলল কলরব, সঙ্গে শওকত সাহেবও হাসল। এরপর কলরব বলল,
“একটা প্লাস পয়েন্ট কী জানো বাবা? একবার যদি কল্পকে বলি নিহিনই ওর মা, তাহলে ওকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসতে হলে যা করতে হয় কল্প মেনে নেবে। মায়ের প্রতি ওর অনেক দুর্বলতা। রাতে রাতে কাঁদে মায়ের জন্য। তুমি তো জানো না।”
“আর দিনের বেলা যে কতবার, কতভাবে মায়ের কথা মনে করে কাঁদে তাও তুমি জানো না।”
“ওটা তোমার ডিপার্টমেন্ট বাবা।”
“হ্যাঁ তাতো বলবিই।”
একটু থেমে কলরব আবার বলল,
“কিন্তু এগুলোর জন্য নিহিনের মত আছে কি না তাও জানতে হবে। পরের ছেলেকে নিজের ছেলের মতো পালতে হবে, এটা যদি ও না পারে কিংবা পারলেও যদি না চায়, তাহলে বিয়ের চিন্তাটাই মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলবো আমি।”
“কচু ভালোবেসেছিস, আর কচু চিনেছিস। তোদের ১০ টা বাচ্চা হলেও নিহিন সবচেয়ে বেশি আদর করবে কল্পকে।”
“একদিনেই বুঝলে কী করে?”
“তোর মতো মাকাল না আমি, ওকে দেখে ওর সাথে কথা বলেই বুঝেছি ও কেমন মেয়ে।”
“তবু বাবা, কল্পকে অবহেলা করলে তো আমি মানতে পারব না। জানি নিহিন ওরকম না, তারপরেও একদিন আদর করে খাইয়ে দেওয়া আর সারাজীবন ছেলের মতো পালা এক কথা না।”
“তুই এত ভাবছিস কেন?”
“কারণ বাবা দুজনের একজনও কষ্ট পেলে সহ্য করতে পারব না।”
শওকত সাহেব কলরবের পিঠে হাত রেখে বললেন,
“আমার ছেলেকে তো আমি চিনি। সব দিক সামলে নেয়ার ক্ষমতা আল্লাহ তাকে দিয়েছে। তার ওপর আমার বিশ্বাস আছে।”
“হুম কিন্তু বাবা সমস্যা আরো আছে, যা আমি তোমাকে বলতে পারব না বাবা।”
“আমাকে বলতে পারবে না এমন কোনো কথা আমার ছেলের থাকতেই পারে না।”
“না মানে…”
“আরে আমার ছেলে দেখি লজ্জা পাচ্ছে, ঘটনা কী? বল তো, আমি তো তোর বেস্ট ফ্রেন্ড তাই না?”
“আসলে বাবা, কল্প তো আমাকে ছাড়া ঘুমায় না, তো নিহিন আসলে ব্যাপারটা…”
“ও এই কথা!”
হো হো করে হেসে উঠল বাবা। কলরব বলল,
“জানতাম মজা নেবে তুমি। ধুর, এজন্যই বলতে চাইনি।”
“না না মজা নিচ্ছি না। তুই গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছিস। কল্প তোদের প্রাইভেসি নষ্ট করবেই, সেক্ষেত্রে এ ব্যাপারেও কোনো প্ল্যান করতে হবে। এমন হতে পারে আমার কাছে থাকবে কল্প।”
“ঘোড়ার ডিম বুচ্ছো তুমি, প্রাইভেসির কথা বলিনি। বলেছি নিহিনের জন্য আমি যদি কল্পকে দূরে সরিয়ে দেই তখন ওর মনে হতে পারে যে মা না থাকতেই ভালো ছিল, ও ওর বাবাকে পুরোপুরি পেত।”
না, কল্প নিহিনকে পেয়ে তোকে ভুলে যাবে। “না বাবা, কল্প মানতে পারবে না বোধহয়।”
“তাহলে কী করতে চাচ্ছিস?”
“দেখি, আগে নিহিনকে বিয়ের প্রপোজাল তো দেই। তারপর রাজি হলে ওর সাথে ডিরেক্ট কথা বলব ব্যাপারটা নিয়ে। বিয়ের পর ঝামেলায় পড়ার থেকে আগে কথা বলে নেয়া ভালো।”
“হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছিস।”
“বাবা এতকিছুর পরেও আরো একটা সমস্যা থেকে যাচ্ছে।”
“আবার কী?”
“জানোই তো নিহিনকে কতটা ভালোবাসি। যদি নিহিনকে পেয়ে আমি কল্পর ঠিকভাবে যত্ন নিতে না পারি?”
“পারবি, তোর ওপর বিশ্বাস আছে আমার। তাছাড়া তুই কল্পর টেক কেয়ার করার সুযোগই পাবি না। নিহিনই সব করবে দেখিস তুই, কী গোছালো মেয়ে।”
“জানি না বাবা, যেদিন নিহিনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম কল্পর খুব মন খারাপ হয়েছিল, আসার সময় একটা কথাও বলেনি, অথচ নিহিনের কথা ভাবতে ভাবতে আমি ওর এসব খেয়ালই করিনি।”
“এতদিন পর প্রথম দেখা করতে গিয়েছিলি তো, সেজন্য। তুই চিন্তা করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“তাই যেন হয় বাবা।”
·
·
·
চলবে..................................................................................