তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো - পর্ব ২০ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          বাবার ঘর থেকে ফিরে বিছানায় শুতেই ঘাড়ে লম্বা কিছুর খোঁচা লাগল কলরবের। ওঠে তাকাতেই দেখতে পেল একটা কাজল। হাতে উঠিয়ে ভাবলো নিহিনেরই হবে। ভুলে হয়তো ফেলে গেছে। বালিশ সরিয়ে ভালো করে খুঁজে একটা লিপস্টিক আরও কিছু একটা পেল, যার নামও জানে না ও। ভালোই হলো এই ছুঁতোয় কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে। তৎক্ষণাৎ কল করল নিহিনকে।

“হ্যালো”

“ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”

“নাহ, এত তাড়াতাড়ি ঘুমাই না তো, বলো।”

“তাড়াতাড়ি না ঘুমানোই ভালো।”

“মানে?”

“না কিছু না, শোনো তুমি বোধহয় কিছু কসমেটিকস ফেলে গেছ। কাজল, লিপস্টিক আর কি যেন একটা।”

“ওমা তাই নাকি?”

“হ্যাঁ। তোমার লাগলে আমি কাল দিয়ে যেতে পারি। কাল তো আমার

অফ ডে।”

“না অসুবিধা নেই, পরে দেখা হলে নিয়ে এসো। আমার কাছে এক্সট্রা আছে। তাছাড়া আমার কাল ক্লাস আছে।”

“ও।”

মিইয়ে গেল কলরব, ভেবেছিল এই ছুঁতোয় কালও দেখা করতে পারবে। নিহিন বলল,

“কি হলো চুপ করে আছ যে?”

“না ভাবছিলাম।”

“কী ভাবছিলে?”

“ওই তো তুমি কত বদলে গেছ সেটাই ভাবছিলাম।”

“কী বদল আবার চোখে পড়লো?”

“তুমি যে বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পার আবার এক হাতের ধাক্কায় একটা ছেলের বুকের পাঁজর ভেঙে ফেলতে পার তা সত্যিই জানা ছিল না। ভালো জোর তোমার হাতে।”

“ব্যথা পেয়েছো নাকি?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই। তুমি টাচ করলেই বুকে ব্যথা লাগে, আর ওই কিলার চাহনি দিয়ে তাকালেও লাগে।”

“যাহ, তোমার সাথে ইদানীং কথাই বলা যায় না।”

“কেন?”

না বোঝার ভান করল কলরব। নিহিন বলল,

“জানি না।”

কলরব হাসল। নিহিন কথা এড়াল,

“কল্প কোথায়?”

“পাশেই, ঘুমাচ্ছে।”

“আংকেল?”

“সেও ঘুমিয়ে পড়েছে।”

“তুমি জেগে আছ কেন?”

“ঘুম আসছে না, আজ আর আমার ঘুম আসবে না। আজকের প্রাপ্তি অনেক বেশি হয়ে গিয়েছে।”

মিটিমিটি হাসল নিহিন। পরে বলল,

“ঘোড়ার ডিমের প্রাপ্তি, আমার রান্না তো তোমার ভালোই লাগেনি।”

“প্রাপ্তি বলতে রান্নাকে বোঝাইনি, অন্য প্রাপ্তির কথা বলেছি। কিন্তু কী করে বুঝলে যে রান্না ভালো লাগেনি?”

“সবাই খেয়ে বলেছে রান্না ভালো হয়েছে, কিন্তু তুমি বলেছ সব ভালো হয়েছে, শুধু ইলিশ পোলাওটা ভালো হয়নি। অথচ ওটা তোমার পছন্দ বলে খুব যত্নে রেঁধেছি।”

“তা বলিনি, আজকেও মজা হয়েছে তবে আগের বারের সাথে তুলনা করা বোকামি। অবশ্য কল্প হয়তো আসল মজাটা পেয়েছে।”

“ধ্যাত, তুমি যে কী বলো।”

ইংগিত বুঝতে পেরে লজ্জা পেল নিহিন। কলরব বলল,

“তোমার এই লজ্জা পাওয়া মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে।’ “আজকেই তো দেখলে, আবার?”

“সারাজীবন দেখলেও কি আশ মিটবে?”

নিহিন কিছু বলল না, শুধু হাসল। কলরব আবার বলল,

“ও ভালো কথা, তুমি এখন আর নূপুর পরো না?”

“পরি না তা নয়, আবার খুব একটা পরাও হয় না।”

“ও। না পরার পিছনে কোনো বিশেষ কারণ আছে?”

“না তো, কেন?”

“না এমনি।”

নিহিন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল,

“আচ্ছা শোনো?”

“হুম, বলো। শুনছি তো।”

“এভাবে না, সিরিয়াসলি শুনতে হবে। কারণ কথাটা খুব সিরিয়াস।”

কলরব ঢং করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

“হুম, আমি সিরিয়াস! তুমি বলো।”

তারপর কলরব বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। নিহিন বলল,

“তোমাকে বলেছিলাম আমার বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে কেন? আমি সেদিন বলিনি, সামনাসামনি বলতে পারবো না তাই।”

“ও।”

এখন বলতে চাচ্ছি।”

“তাহলে বলো।”

“আমি তখন কলেজে ভর্তি হয়েছি মাত্র। ১৬ বছর বয়স। তখন একদিন ছেলে পক্ষের আমাকে দেখতে আসার কথা ছিল। আমি পাত্রপক্ষের সামনে যেতে চাইনি। তোমার জন্য অপেক্ষা করছি তা নয়। মোহনা আপুকেও তো অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছিল। তাই একটা ভয় ছিল। তোমার ওপর তো তখন প্রচণ্ড রাগ। যাই হোক মা বলল, দেখতে আসলেই কারো বিয়ে হয়ে যায় না, কিন্তু আমার জীবনে এমনটাই হলো। দেখতে এসেই বিয়ে হয়ে গেল। চিনি না, জানি না একটা লোককে বিয়ে করতে হলো।”

কলরব কোনোরকমে গলা দিয়ে কথা বের করল,

“লোক মানে? অনেক বড় ছিল তোমার থেকে? তুমি তো তখন বাচ্চা ছিলে।”

হাসল নিহিন,

“আমার দ্বিগুণ বয়স ছিল।”

কলরব নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল কিন্তু বোধহয় পারল না।

শুধু বলল,

“আচ্ছা সেদিন বলেছিল সংসার ভেঙে গেছে।”

“কীরকম ভেঙেছে? ডিভোর্স হয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

কলরব স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। অনুমান তাহলে ঠিক।

“তোমার বাবা রাজি হলো ডিভোর্সে?”

“বাবা নিজেই ডিভোর্সের ব্যবস্থা করেছেন। আমার জীবন বাঁচাতে তার সেটা করতে হয়েছে।”

“কী বলছ!”

“আমার জীবনে অনেক বড় ঝড় গিয়েছে যা তুমি ভাবতেই পারছো না। আজ তোমাকে সব বলব।”

“নিহিন শোনো..”

“বলো..”

“তুমি আমাকে সব বলতে চাচ্ছ কেন? আমার সাথে শেয়ার করে মন হালকা করার জন্য, নাকি আমাকে জানানোর জন্য?”

“শেয়ার করার জন্য না, কোনো সুখকর স্মৃতি তো না যে শেয়ার করব। এরকম বিচ্ছিরি ঘটনা শেয়ার করার কোনো মানে হয় না। আমি শুধু চাই তুমি আমার সবকিছু সম্পর্কে অবগত থাকো, সেজন্যই বলতে চাচ্ছি।”

“কোনো দরকার নেই, যদি শেয়ার করার জন্য বলতে তাহলে শুনতাম। কিন্তু যেহেতু জানানোর জন্য বলতে চাচ্ছ তাই আমি শুনতে চাই না। আমি তোমাকে জানি। তোমার অতীতে কী ঘটে গিয়েছে তা জানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ আমার নেই।”

“কিন্তু সব জানা দরকার তোমার।”

“বললাম তো তোমাকে জানি। তাছাড়া অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি আমার পছন্দ না। কারণ অতীত কোনো ফিক্সড ডিপোজিট না যে তোমাকে প্রফিট দেবে। আর তুমি এত লাফাচ্ছ কেন বলার জন্য? আমি কি আমার এক্সদের নিয়ে কিছু বলেছি তোমাকে?”

“এক্সদের? অনেকগুলো ছিল নাকি?”

হেসে জিজ্ঞেস করল নিহিন। কলরব বলল,

“অনেক মজা পাচ্ছ মনে হয়।”

“পাব না? তুমি যেভাবে অকারণে রেগে যাচ্ছ।”

“অকারণে রেগে যাচ্ছি না, করণেই রেগে যাচ্ছি। আমি শুনবো না তাও তুমি বলবে কেন?”

নিহিন মজা করে বলল,

“আরে বুঝতে পারছো না? আমি আমার অতীত বললেই তো তোমার সেই এক্সদের ব্যাপারে অনায়াসে জিজ্ঞেস করতে পারব।”

“জিজ্ঞেস করতে হবে না, আমার দুটো গার্লফ্রেন্ড ছিল, দুইটাই তোমার বাবা ফিরিয়ে দেওয়ার পরে এবং কল্প আসার আগে। একসাথে নয়, একটার পর একটা। দুটোই করেছি তোমাকে ভুলে নতুন করে শুরু করার জন্য। তাই নতুন প্রেম করেছি। প্রথমজন ছিল অফিসে।”

নিহিন কলরবকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“এই দাঁড়াও, আমি আগে বলব, তারপরে তোমারটা শুনবো।”

“চুপ! একটা কথা বলবে না, যা বলছি চুপচাপ শুনবে।”

কলরব এমন একটা ধমক দিয়ে বলল কথাগুলো যে নিহিনের বিশ্বাসই হলো না এটা কলরব। নিহিন কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল,

“আচ্ছা বলো।”

“ওই মেয়েকে শুধু তোমার নাম ধরে ডাকতাম, আর তা নিয়ে প্রতিদিন ঝগড়া করত। তাই মিউচুয়াল ব্রেকাপ করেছি। তার পরেরটা আমার এক কাজিনের ফ্রেন্ড। দুটোর একটাও আমি প্রপোজ করিনি, ওরাই করেছে আর আমি এক্সেপ্ট করেছি। যাই হোক, ওদের মধ্যে আমি শুধু তোমাকে দেখতে পেতাম। আর তোমাকে যেভাবে ফিল করতাম সেভাবে ওদের করতে পারিনি। তোমার মুখে একটু হাসি ফোটাবার জন্য যেমন অনেক কিছু করতাম তার কিছুই আমি ওদের জন্য করতে পারিনি। তোমাকে দেখলেই বুকের মধ্যে যে উথাল-পাথাল একটা ব্যাপার হতো এমনকি এখনো হয় সেটা কখনো হয়নি ওদের জন্য। তোমার কারণে অকারণে লজ্জা পাওয়া, খুব উৎসাহে রান্না করে আমাকে এটা ওটা খাওয়ানো, আগ্রহ নিয়ে আমার বকবকানি শোনার ধৈর্য আর আমার মুখ দেখে সব বুঝে ফেলার ক্ষমতা কিছুই পাইনি ওদের মধ্যে।”

কলরব যাতে টের না পায় তাই নিহিন মুখে ওড়না চেপে কাঁদছে, এত ভালোবাসা পাওয়া থেকে ১০ টা বছর বঞ্চিত হয়েছে ও! কলরব বলেই যাচ্ছে,

“এগুলো আজকাল বিলুপ্ত প্রায়, হ্যাঁ বুঝতে না পারতেই পারে কিন্তু চেষ্টা তো থাকতে হবে। যাই হোক, ওদের দোষ না, দোষ আমারই ভালোবাসা হয়নি ওদের জন্য। সেটা ওরাও বুঝতো, এসব নিয়ে ঝগড়া করত। হাঁপিয়ে উঠেছিলাম আমি, প্রথম প্রেমটা ১ মাস আর পরেরটা ১৫/১৬ দিন টিকেছে। পরে বুঝলাম আমি আর কোনো মেয়ের সাথেই থাকতে পারব না। তার পর থেকে একাই থেকেছি, বিয়ে করব না সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর কল্পকে নিয়ে এসেছি। শেষ আমার এক্সদের কাহিনি, খুশি?”

নিহিন প্রসঙ্গ পালটাতে চাইল, কান্না থামিয়ে গলাটা স্বাভাবিক করে বলল,

“কল্পকে কোথায় পেয়েছ?”

“কিনে এনেছি।”

“সেকি! কোত্থেকে?”

“ঢাকা মেডিকেলে বাচ্চা কিনতে পাওয়া যায়, বৈধভাবে ১০ হাজার আর অবৈধভাবে ১ লাখ টাকা। দুই ক্ষেত্রেই নার্সদের সাথে যোগাযোগ করতে হয় গোপনে।”

আঁতকে উঠল নিহিন।

“ওমা, কী শুনছি আমি? তার মানে পরের বাচ্চা নার্সরা চুরি করে বিক্রি করে?”

“না, যারা অনেক গরিব এবং অলরেডি অনেকগুলো বাচ্চা আছে তারা নিজেরাই বিক্রি করে দিয়ে যায়। তাতে তারা টাকা পায়। অনেক হারামি পুরুষ আছে যারা নিজের বাচ্চাকে অস্বীকার করে, সেসব বাচ্চার মায়েরা বাচ্চা জন্ম দিয়ে রেখে চলে যায়।”

“এটা কীভাবে সম্ভব, একটা মা এটা কখনো পারে না।”

“বাচ্চা পালার মতো টাকা না থাকলে কী করবে তারা? আর সে বাচ্চা নিয়ে গেলে তো তার স্বামী তাকে ঘরেই ঢুকতে দেবে না।”

“সেরকম হলে বাচ্চা না নিলেই হয়।”

“সবাই কি ইচ্ছে করে নেয়? আরও কত ধরনের ঘটনা ঘটে তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।”

“যেমন?”

“অনেক নেশাখোর বাবা আছে যারা মা ঘুমিয়ে থাকলে বাচ্চাকে নিয়ে এসে বিক্রি করে টাকা নিয়ে নেশা করে।”

“উফ, এমন বাবাদের খুন করে ফেলা উচিত।”

“কিন্তু ওইসব মায়েরা তারপরেও সেই স্বামী নিয়ে সংসার করে এবং আবারও ওর বাচ্চার মা হয়। কারণ ওর যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই।”

“আর শুনতে চাই না প্লিজ।”

“এটুকু শুনেই একথা বলছো? এর চেয়েও মর্মান্তিক ও লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে ওখানে।”

“তুমি এসব জানলে কী করে?”

“আমার এক বন্ধু ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার। ওই যে তোমাদের পাশের বাসায় যখন থাকতাম ও আমার পাশের রুমটাতেই থাকত।

“তার মানে এসব কথা ডাক্তাররাও জানে?”

“হুম জানে তো।”

“এটা তো এক ধরনের দুর্নীতি। কেউ প্রতিবাদ করে না?”

“কে প্রতিবাদ করবে? কার কাছে করবে? যারা ব্যাপারটা সহ্য করতে পারে না তারা চোখ বন্ধ করে থাকে কারণ তাদের কথা শোনার কেউ নেই। তাছাড়া সবগুলো তো আর দুর্নীতি না। গরিব বাবা-মা দুজন স্বইচ্ছায় যখন এটা করে তখন তুমি ওদের দোষ দেবে?”

“অবশ্যই দেবো। কারণ ওরা লোভী। টাকার লোভে ওরা নিজের বাচ্চা বিক্রি করে দিচ্ছে। আরে এটা কি ফসল নাকি যে চাষ করব আর বিক্রি করব?”

কলরব হেসে বলল,

“বাহ! ভালো কথা শিখেছো তো।”

“তো কী? ভুলে যাচ্ছ কেন যে আমি একজন টিচার।”

“উহু লেকচারার।”

“ওই হলো।”

“না হলো না, পার্থক্য আছে।”

যাই হোক, সেকথা আমি ভুলিনি। কিন্তু আমার কাছে তুমি আজও সেই বাচ্চা মেয়েটিই আছ। তা না হলে ওভাবে বাচ্চাদের মতো আমার বুকে আছড়ে পরে কাঁদতে না। তাও আবার কী? আমার দুঃখের জন্য!”

“উফ তুমি ট্র্যাক চেঞ্জ করছো। আমরা বাচ্চা বিক্রির প্রতিবাদ নিয়ে কথা বলছিলাম।”

“তুমি বা এত প্রতিবাদের কথা বলছো কেন? এসব বন্ধ হলে আমাদের মত এতিম বাবারা সারাজীবনেও বাবা হতে পারবে না।”

“এতিম বাবা মানে?”

“মানে বউ ছাড়া যারা বাবা হতে চায়।”

“উফ আমি সিরিয়াস, আর তুমি মজা করছো?”

“আচ্ছা সরি বাবা, আর মজা করব না। শোনো বলছি, মন দিয়ে শুনে বোঝার চেষ্টা করবে, কল্পকে আমি কিনতে গেলে ওর বাবা মা বলেছিল, বাচ্চা নিয়ে ওরা বাসায় গেলে ওদের বাসা থেকে নিয়ে আসতে তাতে নার্সরা জড়িত থাকবে না। নার্সরা জড়িত থাকলে ওরা ৫ হাজার পাবে। ওদের প্রস্তাব আমার পছন্দ হয়নি কারণ নার্সরা ছাড়া ব্যাপারটা বৈধ হতো না। অনেক ঝামেলা আছে, ওগুলো ওরা সামলায়। তাই আমি অনায়াসে অন্য কোনো বাচ্চা নিয়ে আসতে পারতাম কিন্তু আমি অন্য বাচ্চা নিতে চাইনি। তাই আমি ওদের বলেছি আলাদাভাবে পুরো ১০ হাজারই দিব ওদের কিন্তু নার্সরা জড়িত থাকবে। যাই হোক, আসল কথায় আসি। তুমি ভাবছো ওরা লোভে পড়ে বাচ্চাকে বিক্রি করছে। এটা কি ভেবেছ ওদের কাছে থাকলে কল্পর এখন কী অবস্থা হতো? হয়তো রাস্তায় রাস্তায় ফুল, পানি না হলে পেপার বিক্রি করত। ওর বড় আরো পাঁচটা ভাই বোন ছিল তারাও এসব কাজই করত তখন। আর এখন কল্প শহরের সেরা একটা স্কুলে পড়ছে, ক্লাসের ফার্স্ট বয়। মা ছাড়া আজ পর্যন্ত যা চেয়েছে তাই পেয়েছে ও। কত আদরে বড় হচ্ছে। এই জীবনটা ভালো না, ওটা? ওর বাবা মাও ওর এই ভালো থাকার কথাটা চিন্তা করেছে।”

“হুম, আচ্ছা ওরা যদি কখনো কল্পকে ফেরত চায়?”

“কীভাবে? না ওরা আমাকে চেনে, না আমি ওদের চিনি। আর পেপারসে স্পষ্ট করে লেখা আছে ওরা সব অধিকার ত্যাগ করে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছে। আর কখনো ফেরত চাওয়া দূরের কথা কখনো যোগাযোগও করতে পারবে না আমার সাথে। আর করবেও না ওরা। ওরা এসবে অভ্যস্ত।”

“আমি ভাবতেও পারছি না।”

“তোমার ভাবা লাগবেও না। জাস্ট ফরগেট ইট। কল্প আমার নিজের ছেলে।”

“হুম, আচ্ছা তুমি তখন এটা কেন বললে যে তুমি অন্য বাচ্চা নিতে চাওনি।”

“কারণ কল্পকে যখন দেখেছি তখন ও হাসছিল। ছোট্ট বাচ্চা তাও ওর গালের টোলটা আমার চোখে পড়েছিল।”

“তোমার গালেও টোল আছে, এই মিলের জন্য?”

“হ্যাঁ। আমার ছেলে যে হবে তার যদি আমার সাথে কোনো মিল থাকে তাহলে ভালো হয় না? যদিও আমি কালো তাই কালো বাচ্চা খুঁজেছিলাম প্রথমে। কিন্তু কল্প ফরসা হয়ে গেল।”

“তুমি অতটাও কালো না।”

“আমি জানি ম্যাডাম।”

“আচ্ছা তুমি কি ওর পাশে শুয়ে এসব বলছো?”

“পাগল? আমি সেই কখন বারান্দায় চলে এসেছি।”

“ভালো করেছ।”

“হুম”

“আচ্ছা তোমার সব কথা তো শুনলাম, এবার আমার কথাগুলোও শোনো প্লিজ।”

“কোন কথা?”

“ডিভোর্স কেন হলো।”

“আমার শোনার দরকার নেই বলেছি তো। ডিভোর্স হয়েছে কি না সেটা জানার দরকার ছিল জেনেছি।”

“আসলে তুমি ভয় পাচ্ছ।”

“হ্যাঁ পাচ্ছি, তোমাকে কেউ কষ্ট দিয়েছে সেকথা সহ্য করার ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দেননি।”

“আমারও তো দোষ থাকতে পারে।”

“দোষ গুণ মিলেই মানুষ, প্রত্যেকে। ক্ষমতাবানরা গুণগুলো বের করে নিতে জানে। আর অক্ষমরা দোষগুলো বের করে নিতে জানে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে বললাম না, কিন্তু অন্য একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

“হুম, বলো।”

“তুমি তখন বললে, অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি তুমি পছন্দ করো না। কিন্তু আমিও তো তোমার অতীত!”

কলরব হাসল। নিহিন বলল,

“হাসির কী আছে? বলো।”

“তুমি বুঝবে না।”

এমন সময় ফজরের আজানের আওয়াজ ভেসে এলো। কলরব অবাক হয়ে বলল,

“আজান দিয়ে দিয়েছে, এখন কী হবে ক্লাসে যাবে কী করে?”

“সমস্যা নাই, এমনিতেও ঘুম হয় না রাতে। অভ্যাস আছে, তাছাড়া ক্লাস ১২ টায়। ১০ টা পর্যন্ত ঘুমাতে পারব অনায়াসে।”

“আচ্ছা তাহলে ঘুমিয়ে পড়।”

“তুমিও ঘুমাও।”

“আচ্ছা”

বলেই হেসে ফেলল কলরব। নিহিন বলল,

“কী হলো? শুধু শুধু আসছ কেন?”

“শুধু শুধু হাসছি না। একটা কথা ভেবে হাসছি।”

“কী?”

“বললে তুমি লজ্জা পাবো কিন্তু সেটা আমার সমস্যা না, মারতেও পার সেটাই আমার সমস্যা।”

নিহিন আর কিছু বলল না, ছেলেটার মাথায় সবসময় দুষ্টুমি ঘুরতে থাকে। কথা না বলাই ভালো।
·
·
·
চলবে...................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp