শিকদার সাহেবের দিনলিপি - পর্ব ২৪ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          রাহির মাধ্যমে আমি চাইলে মীরার সব খবরই পেতে পারি। তবে চাই না। পারতপক্ষে আমি রাহিকে মীরার কথা কিছুই জিজ্ঞেস করি না। কিন্তু মাঝেমাঝে রাহি নিজ থেকেই আমাকে মীরার খবর দেয়। যেমন মীরার বয়ফ্রেন্ড চেঞ্জ হয়েছে কিংবা দারুণ রেজাল্ট করেছে কিংবা কোনো ছেলেকে মেরে মাথা, গাল, নাক ইত্যাদি ফাটিয়ে দিয়েছে। রাহি নিজ থেকে বলতে শুরু করলে অবশ্য না শুনেও পারি না, বরং খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে শুনি।

মীরা কেমন বড় হয়ে গেছে না? কত কঠিন হয়ে গেছে! সেদিন আমাদের বাসার ছাদে ওকে যা যা বলেছিলাম সম্ভবত তার সবই মনে রেখেছে। না হয় অত তুলোর মতো একটা মেয়ে এমন পাথর হয় কী করে? অবশ্য যে কষ্ট আমি ওকে দিয়েছি তাতে তো ওর পাথরই হবার কথা।

রাফসান শিকদার
৩১ জানুয়ারি, ২০১৭

এতদিন পর পর কথা বলি বলে কি রাগ করিস বকুল? আসলে এখন এত ব্যস্ত থাকি সবসময় ইচ্ছে করলেও লেখা সম্ভব হয় না। তোকে কিছু সুখবর দিই। পাশের দোকান নিয়ে দোকান বাড়াতে বাড়াতে এখন আমার মোট দোকান ৮টা। এর মধ্যে ৬টা কেনা-বাকিগুলো ভাড়া। সম্প্রতি হাতীরপুলে একটা ফ্ল্যাটও কিনেছি। ফ্ল্যাট কেনার সময় অবশ্য রাহিও শেয়ার করেছে। ব্যবসায় এভাবে সফলতা আসবে কখনো কল্পনাও করিনি। এখনো প্রতিমুহূর্তে আমি অবাক হই। জীবনে এখন সবকিছু আছে, কোনোকিছুর অভাব নেই। কিন্তু বুকের ভেতরটা শূন্য। এটাই হয়তো আমার নিয়তি।

রাফসান শিকদার
১৬ আগস্ট, ২০১৭

আজ রাহির অফিস বন্ধ ছিল। এই সুযোগে আজকের জন্য দোকানের দায়িত্ব। ওকে দিয়ে আমি পালালাম। মাঝেমাঝে বড় ক্লান্ত লাগে। কিছুই ভালো লাগে না। এদিক ওদিক ঘুরছিলাম। হঠাৎ কী হলো জানি না আমি জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি চলে গেলাম। গেটের সামনে থেকে একটা মাস্ক কিনে পরলাম। মাথা জড়িয়ে ফেললাম মাফলারে। তারপর একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলাম মীরার হলের সামনে। আমি আসলে জানি না আজ মীরা হলে আছে কি না কিংবা বের হবে কি না। আমি আসার আগেই যদি কোথাও বের হয় তো কখন ফিরবে। তবুও দাঁড়িয়ে রইলাম। আজ তো আমার কোনো কাজ নেই। অপেক্ষা ব্যাপারটা অতটাও খারাপ নয় যদি তা হয় কোনো মহামূল্যবান মানুষের জন্য! দুপুরবেলা ক্ষুধা লাগল। ক্ষুধা পেটেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কিন্তু সন্ধ্যা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন মীরার দেখা মিলল না তখন আমার মনে হলো আজ বোধহয় ভাগ্যটা আমার সুপ্রসন্ন নয়। সন্ধ্যার পর এই জায়গাতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় অসম্ভব। প্রচণ্ড মশা ও পোকামাকড়ে ভরা। তা ছাড়া শীত পড়েছে। প্রচণ্ড রকম। আমার গায়ে কেবল পাতলা একটা জ্যাকেট। এতে এই তীব্র শীত মানছে না। আমি ফিরে আসার জন্য হাঁটা ধরলাম। কিছুদূর আসার পরেই দেখলাম মীরা একটি ছেলের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। মীরার মুখটা থমথমে। এর আগেরবার ওকে যখন দেখেছিলাম তখন ও হাসছিল। দেখে ভালোই লেগেছিল কিন্তু আজ ওর মুখটা দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। ওর মন খারাপের কারণ কী পাশের ছেলেটা?

ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার ইচ্ছে হলো ছেলেটাকে পিটিয়ে আধমরা করে দিয়ে বলি, আর কখনো মীরার হাত ধরবি না।

হা হা হা খুবই হাস্যকর ইচ্ছে। কাপুরুষোচিত হিরো গিরি! নিজের যোগ্যতা নেই ওদিকে অন্যের হতে দেখলে জ্বলে। আমি সম্ভবত আমার ভেতরের এই রাফিকেই সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি।

রাফসান শিকদার
১৯ ডিসেম্বর, ২০১৭

বিয়ে কর বিয়ে কর বলে মা আমার মাথা খেয়ে ফেলছিল। এদিকে রাহির গার্লফ্রেন্ডের বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ। রাহি পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি করছে। ওর বিয়ে করতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়। কিন্তু মা এবং রাহি দুজনেই চায় আমার বিয়ের পর রাহির বিয়ে হোক। এই নিয়ে কত দরবার যে করলাম! অবশেষে অনেক কষ্টে দুজনকে রাজি করিয়ে রাহিকে বিয়ে করিয়েছি।

আমার অবস্থাটা আমি কাউকেই বোঝাতে পারি না। আমি জানি আমি মীরাকে কখনোই পাব না। মীরা অলরেডি অন্য কারো হয়ে গেছে। স্থায়ীভাবে না হলেও আমাকে মন থেকে মুছে ফেলেছে। তবুও এটা জানার পরেও ওর জায়গায় আমি অন্য কাউকে ভাবতে পারি না। কেউ প্রেমের প্রস্তাব দিলে এরপর থেকে তাকে দু চোখে দেখতে পারি না। মনে হয় এই মানুষটা মীরার ক্ষতি করতে চলেছে। কি ছেলেমানুষি চিন্তাভাবনা! অথচ প্রথম ভালোবাসা হওয়া সত্ত্বেও কত সহজেই শান্তনাকে ভুলে গিয়েছিলাম। মীরাকে গ্রহণ করেছিলাম! ভালোবাসা প্রকৃতির মতো, এর এত রূপ এত রং এত বৈচিত্র্য যে বুঝে ওঠা দায়। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেল, মীরা গেল না। আমি নিজেকে যতটা শক্ত মানুষ ভাবি আদৌ কি আমি ততটা শক্ত? তোর কী মনে হয় বকুল?

রাফসান শিকদার
১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

মীরা তুমি মানুষ নাকি এক কষ্ট?
নাহলে বুকের ভেতর জমাট বেঁধে আছো কেন?
মুক্ত করে দিয়েছি, উড়ে যাও…
আমার বুকের মাঝেই কেন ঘুরপাক খাচ্ছ বারংবার?
এক মুহূর্তের জন্যও সরাতে পারি না
ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছি কালো অন্ধকারের অতলে।
চারপাশে টুনটুনি পাখির মতো উড়ে বেড়ায় সুখ,
ধরে বুকপকেটে রাখতে পারি না
তার খুব কাছেই যে আছো তুমি।
অন্য কেউ ঘেঁষতে পারে না এদিকে!
এ কি তোমার অভিশাপ?
নাকি একচ্ছত্র আধিপত্য?
নাকি তীব্র ভালোবাসা?

রাফসান শিকদার
১৮ মার্চ, ২০১৮

বিয়ের যন্ত্রণায় অনেক বেশিই অতিষ্ঠ। মা আমার বিয়ের জন্য এমনভাবে উঠে পড়ে লেগেছেন যা অবর্ণনীয়। তিনি এরই মধ্যে মেয়ে দেখা শুরু করেছেন। একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনে এভাবে কষ্ট দেয়ার কোনো মানে আছে? স্বামী ভালো না বাসলে ব্যাপারটা যেকোনো মেয়ের জন্যে কষ্টের। স্বামী তার এক্স গার্লফ্রেন্ডকে ভালোবাসলে সেটা আরো কষ্টের। মাকে এই জিনিস বলার সাধ্য যে আমার নেই! কীভাবে যে এভয়েড করছি বোঝাতে পারব না।

রাফসান শিকদার
২২ এপ্রিল, ২০১৮

আমি কিছু প্রশ্নের উত্তর অনেক ভেবেছি। প্রশ্নগুলো আচমকাই মাথার মধ্যে গেড়ে বসেছিল। আমি কেন বিয়ে করছি না? আমি কি আজীবন বিয়ে না করে থাকব? থাকলে কেন থাকব? উত্তর অবশ্য নিজেই খুঁজে বের করেছি। মীরা এখনো বিয়ে করেনি বলেই হয়তো আমি বিয়ে করিনি। ও বিয়ে করে ফেলার পরেই আমি বিয়ে করব। না মীরাকে পাওয়ার কোনো প্রত্যাশা আমি করি না। আমি আসলে চাইও না। তবুও ও বিয়ে করার পরে আমি বিয়ে করব। এতে হয়তো আমি মানসিকভাবে শান্তি পাব। কারণ জানা নেই। খুঁজলে হয়তো পাব কিন্তু খুঁজতে চাচ্ছি না।

রাফসান শিকদার
২৯ এপ্রিল, ২০১৮
·
·
·
চলবে....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp