প্রিয় বকুল,
ঈদ মোবারক। ভালো আছিস তো? অনেক বছর পর লিখছি তোকে। তোর কথা প্রায়ই মনে পড়ে। তোকে বলার মতো ঘটনাও কম ঘটে না। কিন্তু ব্যস্ততায় তোকে নিয়ে বসাই হয় না। ছুটির দিনগুলোতে মন ভরে ঘুমাই। লিখতে বড় আলসেমি লাগে আজকাল। কিন্তু আজ হঠাৎ করেই ইচ্ছে করল তোর সঙ্গে কথা বলতে।
বিগত বছরগুলোতে আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিস দুটি এসেছে তা হলো ব্যস্ততা আর টাকা। টাকা আমার সুখ আর আরাম কেনে। ব্যস্ততা আমার ভেতরকার একমাত্র শূন্যতাকে ঢেকে রাখে। রাতে একা হলে এখনো মীরাকে আগের মতোই মিস করি। কিন্তু শরীর এত ক্লান্ত থাকে যে নিমিষেই ঘুমিয়ে পড়ি। তোকে তো বলাই হয়নি, আমরা এখন ঢাকায় থাকি। বছরখানেক আগে সাভারের বিজনেসটা আমি ঢাকায় মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে ট্রান্সফার করেছি। শুরুটা ছিল ছোট একটা দোকান নিয়ে। কয়েকমাস আগে পাশের দোকানটাও নিয়েছি। ব্যবসাটা এত সুন্দর দাঁড় করাতে পারব ভাবিনি। তবে দিনরাত সমানে খেটেছি এ কথাও সত্যি। বেশকিছু কর্মচারী আছে এখন। তবু আমি নিজে ১১-১২ ঘণ্টা সময় দিই এখনো। ব্যবসায় নেমে বুঝেছি প্রথমদিকে নিজে সময় না দিলে ব্যবসায় সফল হওয়া কঠিন।
জানিস ঢাকায় আসার পর থেকে প্রায়ই আমি একটা অদ্ভুত কাজ করি। হঠাৎ হঠাৎ নাখালপাড়া চলে যাই। মীরার বাড়ির আশপাশ দিয়ে ঘুরেফিরে চলে আসি। অন্যরকম একটা প্রশান্তি কাজ করে। মনে হয় এই রাস্তা দিয়েই তো ও হেঁটে বেড়ায়। এই বাতাসেই তো ও নিঃশ্বাস নেয়। ওর বারান্দায় শুকোতে দেয়া কাপড়গুলোর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করি কোন কাপড়টা ওর?
একটা কথা যা আমি নিজের কাছেও স্বীকার করতে চাই না, আজ তোর কাছে স্বীকার করছি… যখন আমি নাখালপাড়া যাই তখন আমার খুব ইচ্ছে করে একদিন মীরার সঙ্গে দেখা হয়ে যাক। কিন্তু দেখা আর হয় না। ভাগ্য সম্ভবত আমার অনুকূলে নেই। হয়তো প্রতিশোধ নিচ্ছে। মীরাকে কষ্ট দেয়ার প্রতিশোধ। কিন্তু তুই তো জানিস, মীরাকে অনেক বেশি কষ্ট দিতে চাইনি বলেই সেই কষ্টটা দিয়েছিলাম?
রাফসান শিকদার
০৭ জুলাই, ২০১৬
আজ অনেকদিন পর মীরাকে দেখলাম। ভালো আছে। ওর ভালো থাকাটাই চেয়েছিলাম। এত প্রশ্ন করিস না বকুল। এত কথা লিখতে ইচ্ছে করছে না। বেশি প্রশ্ন করলে আর কোনোদিন তোর মুখও দেখব না।
রাফসান শিকদার
০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
সামনে কোরবানির ঈদ। ঘরদোর পরিষ্কার করা হচ্ছে। আমার দায়িত্ব পড়েছে। জানালার গ্রিল পরিষ্কার করার। তাই করছি। কিন্তু কাজে মন নেই আমার। কী করছি নিজেও জানি না। আমার মাথায় কেবল মীরার চিন্তা ঘুরছে। ভাগ্যিস রাহি আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। চোখ খুলে দিয়েছে ও আমার। নিজ চোখে না দেখলে কি আমি কখনো বিশ্বাস করতে পারতাম? আমার মীরা এখন প্লে গার্ল! ধুর কী যে ভাবি! মীরা তো আর আমার নেই। আমিই তো পর করে দিয়েছিলাম তাকে।
রাহি গান ছেড়ে ওর ভাগের কাজ করছিল। এতক্ষণ খেয়াল করিনি হঠাই খেয়াল করলাম গানের কথাগুলো ছিল এমন,
তুমি এতো সহজে ভুলতে পারো
অন্য কাউকে জড়িয়ে ধরো
আমি কেন শুধু ভুলে যেতে পারি না…
আজ অবাক লাগে তোমায় দেখে
আমায় আজ তোমার অচেনা লাগে…
বাকিটা আর শুনতে পারলাম না। নিজেকে সামলাতেও পারলাম না। ছুটে গেলাম রাহির ঘরে। গান চলছিল ওর ল্যাপটপে। ও বিছানার ওপর চেয়ার তুলে তার ওপর দাঁড়িয়ে ফ্যান পরিষ্কার করছিল। আমার কী হলো জানি না! যে ধরনের কাজ আমি কখনো করিনি তাই করলাম। ওর ল্যাপটপটা তুলে একটা আছাড় মারলাম। রাহি অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। আমি বললাম, তুই কি ইন্টেনশনালি এই গান শোনাচ্ছিস আমাকে? মীরা একের পর এক প্রেম করে বেড়াচ্ছে আর আমি এখনো ওকে ভাবি বলে?
নিচে নেমে এসে বলল, কি বলছিস ভাইয়া! আমি কেন তোকে শোনাতে যাব? লিরিকগুলো আমি খেয়ালই করিনি। প্লে লিস্টে ছিল, জাস্ট বেজে উঠল। তবু সরি। আমি তোকে কষ্ট দিতে চাইনি।
ততক্ষণে মা ছুটে এসেছে। মা এই অবস্থা দেখেই বলল, কী সর্বনাশ! তোরা দুই ভাই কি ঝগড়া করছিস?
আমি কিছু বলার আগেই রাহি বলল, না মা। দোষটা আমার। আমি মাফ চেয়ে নিচ্ছি। তুমি প্লিজ যাও। তুমি থাকলে আমরা কথা বলতে পারব না।
মা চলে গেলেন। তবে যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ভালোয় ভালোয় দুজনে মিটমাট করে নে। আমার যেন এরমধ্যে জড়ানো না লাগে।
মা চলে যেতেই রাহি দরজা আটকে দিয়ে আমাকে বলল, তোর কষ্টটা বুঝতে পারছি ভাইয়া। প্লিজ মাফ করে দে। আমার হয়তো তোকে এসব বলাই ভুল হয়েছে। আমি আসলে ভেবেছিলাম একরকম, হয়ে গেল আরেকরকম।
আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মীরাকে দেখে ফিরে আসার পর, এমনকি একটু আগপর্যন্তও নিজের রাগ, আবেগ, আক্ষেপ, পেয়ে হারানোর ব্যথা সবকিছু সংবরণ করেই রাখছিলাম। যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু ওই মুহূর্তে সব নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। আচমকা রাহিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি। জীবনে কদাচিৎ কেঁদেছি আমি। কিন্তু কারো সামনে এই প্রথম! রাহি নিজেও বোধহয় খুব অবাক, অপ্রস্তুত এবং অসহায়বোধ করছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে হঠাৎ আমার বড় ভাই হয়ে উঠল যেন। আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, একবার মীরার সামনে গিয়ে দাঁড়া ভাইয়া। একবার বল আজও ভালোবাসিস। কী ক্ষতি? নিজেও তো বুঝিস তোকে হারিয়েই ও এমন হয়েছে!
সত্যি বলতে বুঝি, এটুকু আমাকে বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। কিন্তু মীরাকে কোনো ছেলের সঙ্গে দেখলে এত খারাপ লাগবে এটা কখনো বুঝিনি। যদিও এটাই স্বাভাবিক। একদিন প্রেম না হয় বিয়ে কিছু একটা হবেই। কেউ আসবেই ওর জীবনে। আমি তো সব অধিকার ছেড়েই দিয়েছি। আর তো কথা থাকে না!
রাফসান শিকদার
১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
·
·
·
চলবে....................................................................................