নিকিতার পড়াশোনা করতে একদম ভালো লাগে না। প্রিয়র জোরাজুরিতে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। যদিও অনেক বন্ধু পেয়েছে, তবু ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে খাল কেটে কুমির এনেছে সে। দুদিন পরপরই পরীক্ষা। আর ভালো লাগে না। ধুর, ফেল করলে করবে, এই ভেবে পড়াশোনা বন্ধ করে টেবিল থেকে উঠে গেল। প্রিয় একটু পরই অফিস থেকে ফিরবে, তাই সামান্য সাজগোজ করল। গোছানো ঘরটা আবারও গোছাল। এর মধ্যেই শুদ্ধ ঘরে ঢুকে বলল, ‘মা, খুব খিদে পেয়েছে। কিছু খাব।
‘দিচ্ছি দাঁড়াও।
হঠাৎ নিকিতা খেয়াল করল শুদ্ধ ওকে মা বলে ডাকল। চমকে গেল, বুকের ভেতর কেমন জানি করে উঠল। নিকিতা বলল, ‘কী বললে? কী বলে ডাকলে আমাকে?
শুদ্ধ একগাল হাসি দিয়ে বলল, ‘মা বলেছি।
‘ভুল করে মা বলেছ?
‘না তো। তুমি তো আমার মা-ই হও। তাই ইচ্ছা করেই মা বলে ডেকেছি। এখন থেকে আমি তোমাকে মা বলে ডাকব।’
অজানা একটা খুশির অনুভূতি নিকিতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরল। শুদ্ধর সামনে বসে বলল, আবার বলো।’
শুদ্ধ আবার হাসল।
‘মা, আমি তোমাকে এখন থেকে মা বলে ডাকব।’
নিকিতা শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরল। শুদ্ধও ধরল। শুধু একটা মা ডাক যে এমন অনুভূতি এনে দিতে পারে, তা জানা ছিল না ওর। তারপর নিকিতা শুদ্ধর হাত ধরে ডাইনিং রুমে গেল। বলল, ‘কী খাবা বলো?
‘উম, কী যে খাব! আচ্ছা স্যান্ডউইচ খাব।
‘এক্ষুনি বানিয়ে দিচ্ছি।
নিকিতা স্যান্ডউইচ এনে দিল। শুদ্ধ খাওয়া শুরু করল। নিকিতা বলল, ‘আচ্ছা বাবা, তুমি হঠাৎ আমাকে মা ডাকার সিদ্ধান্ত কেন নিলে?
‘কেন আবার? বাবার ওয়াইফকে তো মা-ই বলতে হয়।
কে বলেছে তোমাকে এই কথা?
‘আমার মা বলেছে। মা সব সময় সত্যি কথা বলে।
‘তোমার মা!’
‘হ্যাঁ, আমার পেট্রা মা।
‘মায়ের সাথে তোমার দেখা হয়? কথা হয়?
‘না তো।’
‘তাহলে কীভাবে বলেছে এই কথা?
‘অনেক আগে বলেছিল।
শুদ্ধ সাধারণত মিথ্যা বলে না। কিন্তু যেহেতু মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা নিষেধ, তবু ও লুকিয়ে যোগাযোগ করে, তাই এই ব্যাপারটা ও সব সময় গোপন রাখে। মুখ ফসকেও কখনো কাউকে বলে না।
নিকিতা আজ বুঝতে পারছে পেট্রা কতটা বড় মনের মানুষ। ও শুধু শুধুই পেট্রাকে ভুল বুঝেছিল। ইশ, কত গালাগালি করেছিল। আজ ওর নিজেরই খারাপ লাগছে।
ওদিকে প্রিয় খেয়াল করছে, শুদ্ধ নিকিতাকে মা বলে ডাকছে। খুব অবাক লাগছে। শুদ্ধ মায়ের ব্যাপারে অনেক পজেসিভ। সে অন্য কাউকে মা ডাকবে, এটা অসম্ভব। তবু কেন ডাকছে? অনেকবার জিজ্ঞেস করার পরও তেমন কিছুই বলল না। শুধু বলল, ‘নিকিতা মাকে মা বলতে ভাল্লাগে, বাবা।’ কিন্তু এই শুদ্ধই একসময় বলত, একটা মানুষের কী করে দুইটা মা হয়, বাবা? শুদ্ধর এই আমূল পরিবর্তনের পেছনের রহস্য জানে না প্রিয়। তাবে রহস্য যা-ই হোক, ব্যাপারটাতে একটা লাভ হয়েছে। নিকিতা শুদ্ধকে এখন আরও বেশি আদর-যত্ন করে। মনেপ্রাণে শুদ্ধকে নিজের ছেলে বলে ভাবে। শুদ্ধর কোনো কাজে তার এখন আর ভুল হয় না।
—————
এক পায়ে প্লাস্টার করা নিয়ে একা একাই মুভ করে পেট্রা। দেয়াল ধরে ধরে বাথরুমে যায়। বারবার মাকে ডাকতে ইচ্ছা করে না। যদিও একা একা বাথরুম পর্যন্ত যেতে একটু কষ্টই হয়। কষ্ট করে বাথরুমে গিয়ে ঢুকতেই হঠাৎ মনে পড়ল, ও একবার পায়ে ব্যথা পেয়েছিল। মচকায়ও নি, সামান্যই ব্যথা পেয়েছিল। দু-তিন দিন পর্যন্ত প্রিয় ওকে কোলে করে বাথরুমে নিয়ে যেত, আবার কোলে করে নিয়ে আসত। আর আজ পা ভেঙে দুই সপ্তাহ ধরে বাসায় বসে আছে। প্রিয় তা জানতেও পারল না। মনে পড়তেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে একটা কান্না উঠে এল। বন্ধ দরজার ভেতর নিজেকে সামলানোর কোনো প্রয়োজন মনে করল না পেট্রা, কাঁদল। ইচ্ছা করেই কাদল। কান্নাকাটির পর সে কিছুটা ভারমুক্ত হলো। পেট্রা মানুষকে বলে বেড়ায় ওদের বিচ্ছেদটা ও মেনে নিয়েছে। হেসেখেলে দিন পার করছে। মায়ের পছন্দ করা অনির্দিষ্ট কোনো ছেলেকে বিয়ে করার জন্য সে প্রস্তুত। প্রিয়র জন্য কোনো কিছুই আটকে থাকছে না ওর। সবাই ওকে দেখে অবাক হয়। কারও সামনে দুফোঁটা চোখের জল ফেলতে ওর আত্মসম্মান বাধা দেয়। তাই সারা পৃথিবীর কাছে ও এক কঠিন হৃদয়ের মানবী। কিন্তু আজও আয়নার সামনে দাঁড়ালে সে দেখতে পায় পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে প্রিয়। হয়তো এক্ষুনি কোমরটা জড়িয়ে ধরবে। কিংবা মুখ ডোবাবে চুলে। আজও রিকশায় বসলে মনে হয় পাশে আছে প্রিয়, শক্ত করে ধরে রেখেছে ওকে। আজও বৃষ্টি নামলে মনে হয় প্রিয় আছে, ছাতাটা হয়তো ও-ই ধরবে। আজও অন্ধকারে বিছানায় শুয়ে মনে হয় প্রিয় আছে। পাশ ফিরে এক্ষুনি হয়তো বুকে টেনে নেবে। কিন্তু এসবের কোনোটাই হয় না। এখন প্রিয় আছে শুধুই স্মৃতিতে, কল্পনাতে। কেউ জানে না, তবে একলা রাতে ওরও বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে ও কাটিয়ে দেয় অজস্র গভীর কালো রাত। কেউ না জানলেও ওর চোখেও জল গড়ায়।
—————
কয়েক মাস পর একদিন বিকেলবেলা প্রিয়কে বাসায় ফিরতে দেখে নিকিতা অবাক হলো। কারণ, এই সময় প্রিয় কখনো বাসায় ফেরে না। শুদ্ধকে নিয়ে শুয়ে ছিল নিকিতা। প্রিয় ঘরে ঢুকেই বলল, তোমার ফোন কোথায়? ১০০টা কল দিয়েছি।
নিকিতা বলল, ‘কী জানি, রান্নাঘরে বা ডাইনিংয়ে বোধ হয়। আসলে তুমি তো কখনো ফোন করো না। তাই…কিন্তু কী হয়েছে, এতবার কল করেছ কেন?
ততক্ষণে প্রিয় শুদ্ধকে ঘুম থেকে উঠাল। অতি দ্রুত বলল, ‘শুদ্ধ, তাড়াতাড়ি একটা টি-শার্ট পরে নে।’
‘কেন বাবা, আমরা কি কোথাও যাচ্ছি?
‘হ্যাঁ।
‘কোথায়?
ততক্ষণে প্রিয় তাড়াহুড়া করে একটা টি-শার্ট নিয়ে এল। পরাতে পরাতে বলল, ‘উফ শুদ্ধ, সব সময় এত প্রশ্ন করতে হয় না। চল টি-শার্ট পর।
‘কোথায় যাচ্ছি, বললে কী হয়, বাবা? আমি তো বেশি কথা বলছি। শুধু একটা কথাই জানতে চাইছি।
‘আমরা নানুবাড়ি যাচ্ছি।’
‘সত্যি?
চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক বয়ে যাচ্ছে শুদ্ধর। কিন্তু প্রিয়কে দেখে কেন যেন নিকিতার মনে হচ্ছিল খারাপ কিছু। তাই কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। প্রিয় ও শুদ্ধ গাড়িতে উঠতেই নিকিতা বলল, আমিও যাব।’
প্রিয় বলল, ‘দরকার নেই। শুনলে তো পেট্রার বাসায় যাচ্ছি।’
শুদ্ধ বলল, ‘চলো না বাবা-মাকেও নিয়ে যাই।
কথা বাড়ানোর মতো সময় নেই, তাই প্রিয় বলল, ‘আচ্ছা চলো।’
নিকিতাও গাড়িতে উঠে বসল। প্রিয় যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি চালাচ্ছে, কিন্তু পথ যেন শেষ হচ্ছে না।
·
·
·
চলবে....................................................................................