ফানুস - পর্ব ২২ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


           খবর পাওয়ামাত্রই প্রিয় এসেছিল। কিন্তু লাশ দেখতে পারেনি। শিখা গতকাল রাতে স্ট্রোক করে মারা গেছেন। এর আগেও স্ট্রোক হয়েছিল। সুস্থ মানুষটা হঠাৎ করে চলে গেলেন। পেট্রার বিয়ের খুব চেষ্টা করছিলেন। সম্প্রতি একটা বিয়ে ঠিক হয়েছিল পেট্রার। দিন-তারিখও ঠিক। তারপর হঠাৎ দুদিন আগে বিয়েটা ভেঙে গেল। হয়তো ব্যাপারটায় খুব কষ্ট পেয়ে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি।

তিন ভাইবোন মেঝেতে জড়ো হয়ে বসে খুব কাঁদছে। আত্মীয়স্বজন বেশির ভাগ কবরস্থান থেকেই চলে গেছে। কাছের আত্মীয়রা কেউ কেউ ছিল, তারাই ওদের সামলাচ্ছিল। শুদ্ধ দূর থেকে মাকে কাঁদতে দেখেই দৌড়ে গেল।

‘মা, তুমি কাঁদছ কেন? খালামণি, মামা, তোমরা সবাই কেন কাঁদছ?

শুদ্ধর চোখে পানি এসে গেছে। সে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। পেট্রা কাঁদতে কাঁদতেই শুদ্ধকে কাছে এনে বসাল! শুদ্ধও কিছু না জেনেই মায়ের কান্না দেখে কাঁদতে শুরু করেছে। প্রিয় নিকিতাকে গাড়িতেই থাকতে বলেছে, নামলেও কারও কাছে পরিচয় দিতে নিষেধ করেছে। আসলে নিকিতাকে আনাই উচিত হয় নি। কিন্তু তখন দুশ্চিন্তায় মাথা কাজ করছিল না। এদিকে পেট্রার আত্মীয়স্বজন প্রিয়কে দেখে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন নিকৃষ্ট কোনো জন্তু দেখছে। তাদের সবার দৃষ্টি যেন একটাই কথা বলছে, ‘তোমার জন্যই আজ এই অবস্থা সবার।’ কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, রাগ -অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে থাকা রায়ান প্রিয়কে দেখামাত্র জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। পাশেই বসা পেট্রা ও প্রিয়াঙ্কা, ওরাও কাঁদছে।

রায়ান কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘প্রিয়দা, মা চলে গেল। কী হবে আমাদের?

সান্তনা দেওয়ার ভাষা জানা নেই প্রিয়র। তবু কোনোরকমে বলল, ‘শান্ত হ ভাই। বোনদের তোরই তো দেখতে হবে। কান্নাকাটি করলে মা ফিরে আসবে না। দোয়া কর মায়ের জন্য।

এবার প্রিয় এক হাতে রায়ানকে জড়িয়ে ধরেই অন্য হাতে পেট্রার হাতে হাত রাখল। পেট্রা প্রিয়র দিকে অসহায়ভাবে তাকাল। পেট্রাকে এভাবে কাঁদতে দেখে নি সে কখনো। পেট্রার কান্না দেখে তার নিজেরই কান্না পাচ্ছিল। কী বলবে বুঝতে পারছিল না। শুদ্ধ বলল, ‘বাবা, মাকে কাঁদতে মানা করো প্লিজ, কিছু বলো, বাবা।’

পেট্রা হঠাৎ প্রিয়র গলা জড়িয়ে ধরল। এতক্ষণ সে চুপচাপ কাঁদছিল। এবার চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। তাকে এভাবে কাঁদতে দেখে রায়ানের কান্নাটা একটু কমে এল। সরে গিয়ে শুদ্ধকে কোলে নিল। সে জানে এই সময় প্রিয়দাকেই তার দিদির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। ওদিকে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে। অনেকেই প্রিয়কে চিনত। অনেকে আজ চিনল। প্রত্যেকে প্রিয়কে এখন আসামির চোখে দেখছে। পেট্রার চাচা কিছু বলতে চাচ্ছিল। প্রিয়াঙ্কা ও প্রিয়াঙ্কার স্বামী তাকে থামিয়ে অন্য ঘরে নিয়ে গেছে।

ওদিকে নিকিতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছে। কেউ তাকে জিজ্ঞেস করছে না সে কার সঙ্গে এসেছে বা কেন এসেছে। মরা বাড়ি বোধ হয় এমনই। তার কী করা উচিত, ঠিক বুঝতে পারছে না। সে কি গাড়িতে গিয়ে বসবে, নাকি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?

কিন্তু সবচেয়ে বেশি অবাক হচ্ছে স্মরণ। প্রিয়কে যেভাবে জড়িয়ে ধরে পেট্রা কাঁদছে, তাতেই পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সব। উনিই তাহলে পেট্রার প্রাক্তন স্বামী! কিন্তু তাহলে প্রিয়কে যার সাথে দেখেছিল, সেই মেয়েটা কে? প্রিয় কি আবার বিয়ে করেছে? যে স্বামী তার ভালোবাসাকে ভুলে আবার বিয়ে করতে পারে, তার জন্য পেট্রা মনের মধ্যে এত ভালোবাসা জমিয়ে রেখেছে। শালার এই রকম মানুষগুলার জন্যই মেয়ে জাতির যত ভালোবাসা হঠাৎই নিকিতার দিকে চোখ পড়ল স্মরণের। আরে বউকে নিয়ে এসেছে দেখা যাচ্ছে। কেউ প্রাক্তন শ্বশুরবাড়িতে বর্তমান বউ নিয়ে আসে নাকি? অদ্ভুত ব্যাপার! সব মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে পেট্রাকে একটা সান্ত্বনাবাক্যও দিতে পারল না প্রিয়। বুকের ভেতর শক্ত করে ধরে রেখেছে শুধু। পেট্রা পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদছে। প্রিয় যদিও পেট্রার মতো চিৎকার করছে না, তবে কাঁদছে। শুদ্ধ মামার কোলে বসে অসহায় চোখে মা-বাবার কান্নাকাটি দেখছে।
·
·
·
চলবে....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp