ভোর হয়ে যাওয়ায় আর বিভিন্ন রকম চিন্তায় ঠিকমতো ঘুম আর হলো না কলরবের, ঘুম ভাঙল বেলা ১১ টায়। ঘুম থেকে ওঠে ও সাব্বিরকে কল করল,
“সাব্বির, আজ ফ্রি আছিস?”
“ক্যান ভাই? কোনো কাজ আছে?”
“আছে, সেজন্যই জিজ্ঞেস করছি।”
“কালকে যদি বলতে, আজকে রাতে আম্মুর সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।”
“মেয়ে দেখতে যাবি নাকি?”
“ইউ আর গ্রেট ভাই, না বলতেই সব বুঝে যাও।”
“সবার ক্ষেত্রে বুঝি না। কিন্তু মেয়ে দেখতে যাচ্ছিস কোথায়?”
“আমি নিজেও জানি না, কোনো ইন্টারেস্ট নাই, শুধু আম্মুকে খুশি করার জন্য সাথে যাওয়া। আর কইয়ো না ভাই, গার্লফ্রেন্ডটা ভাইজ্ঞা যাওয়ার পর থেকে আম্মু জ্বালাইয়া মারতাছে, আগে ওর পড়াশুনার ছুতা দিয়া পিছাইয়া রাখছি, এখন কই যামু!”
“আগে ভাষা ঠিক কর, নাহলে অফিসেও ভুলে বলে ফেলবি।”
“আচ্ছা সরি। কিন্তু ভাই আম্মুর সাথে আমি রাত ৮ টার দিকে যাব। তার আগে তোমাকে টাইম দিতে পারি।”
“না এত তাড়াহুড়ার কিছু নেই, হাতে অনেক সময় আছে।”
“আসলে ভাই এলাকায়ই আছি, রাতের আগে কোনো কাজও নাই তাই তোমার বাসায় আসতে চাচ্ছি। নিহিনের কালকের রান্নার কিছু অবশিষ্টাংশ যদি পাওয়া যায় সে লোভে।”
কলরব হেসে বলল,
“চলে আয়। সবই আছে তবে ফ্রিজে রাখা বাসি, গরম করার কষ্টটা আমিই করতে পারব।”
“আসতেছি ভাই।”
কলরব ওর কাপড় ইস্ত্রি করছে। আর কল্প বিছানায় বসে চিপস খাচ্ছে আর ওর সাথে গল্প করছে। হঠাৎ বলে উঠল,
“আচ্ছা পাপ্পা, মিষ্টি যে স্কুলে পড়েছে ওটাতে আমাকে এডমিট করে দেবে?”
চমকে উঠল কলরব। হঠাৎ ওর কথা!
“কেন তোর স্কুল কী দোষ করল?”
“না আমার স্কুলটাও ভালো। কিন্তু কোনো রান্না শিখায় না, মিষ্টির স্কুলে পড়লে তো ওর মতো মজার রান্না শিখতে পারব।”
কলরব শব্দ করে হেসে ফেলল,
“রান্না কোনো স্কুলেই শেখায় না, বোকা। ও রান্না শিখেছে ওর মায়ের কাছ থেকে।”
“ও।”
সাব্বির ঘরে ঢুকতেই লাফ দিয়ে কোলে চড়ল কল্প,
“চাচ্চু!”
সাব্বির ওকে কোলে নিয়ে আদর করল। কলরব বলল,
“কল্প এখন দাদাভাইয়ের সাথে গিয়ে খেল। আমারা এখানে কাজ করব এখন।”
“ওকে পাপ্পা।”
কল্প ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতেই সাব্বির বলল,
“নিজে ইস্ত্রি করছো?”
“বুয়া আসেনি, আর আমিও বসেই ছিলাম তাই।”
“ও।”
সাব্বিরের চোখ পড়ল দেয়ালে নিহিনের ছবিটার দিকে।
“এই ছবিটা যে কতবার দেখেছি, অথচ একবারও বুঝিনি এটা নিহিনের ছবি।”
“অথচ কল্প নিহিনকে দেখেই বলেছে ওর মায়ের সাথে অনেক মিল। তাহলে বোঝ তুই কত আহাম্মক।”
“ভাই ও তো ছবিটা ডেইলি দেখে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, তাই নিহিনকে দেখেই মিল পেয়েছে। আমি তো এত ভালো করে দেখিনি। কখনো ভাবিওনি এরকম হতে পারে। তাছাড়া নিহিন তো ছবির মত নেই, অনেক পরিবর্তন এসেছে।”
“হুম, বুঝেছি। এখন কাজের কথায় আসি। ও তুই আগে খেয়ে নে।”
“না, দুপুরে খাবো। তুমি কাজের কথাটা বলো।”
“আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।
“কোথায় যেতে হবে?”
“মার্কেটে।”
“মার্কেটে! আমাকে নিয়ে? কী জন্য?”
“আসলে তোকে নিয়ে না, তিথিকে নিয়ে যাব। যেহেতু তিথির সাথে আমার পরিচয় নেই তাই তুই ওকে নিয়ে আসবি এবং পরিচয় করিয়ে দিবি। এই হলো তোর কাজ।”
“কিন্তু তিথি কেন?”
“নিহিনের জন্য একটা জিনিস কিনব, তাই তিথিকে লাগবে।”
“নিহিনকে কি সারপ্রাইজ দিতে চাও?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে ভুলেও তিথিকে নিয়ো না।”
“কেন?”
“তাহলে তোমার সারপ্রাইজ আর সারপ্রাইজ থাকবে না। ও নগদে বলে দেবে নিহিনকে।”
“নিষেধ করলে বলবে কেন?”
“ইচ্ছে করে বলবে না তো। যেমন ধরো আমি বা নিহিন যদি ওকে কিছু বলে কাউকে বলতে নিষেধ করি, ওর পেটে বোমা মারলেও কথা বের হবে না। কিন্তু কেউ যদি আমাকে বা নিহিনকে কিছু বলতে নিষেধ করে ওইটা ও আগে বলে দেবে। এসব ব্যাপার ও গোপন রাখতে পারে না।’ “বললে তো সারপ্রাইজ নষ্ট হবে, সেটা জেনেও কেন বলবে?”
“এই কেনর কোনো উত্তর নাই ভাই।”
“তাহলে তো সমস্যা।”
“এজন্যই বলছি ওকে ইনভলভ করারই দরকার নাই। কী জিনিস কিনতে চাও?”
“নূপুর।”
“নূপুর! এটার জন্য ওকে লাগে! কত নূপুর কিনছি! তুমি যাইয়ো আমাকে নিয়ে, আমি পছন্দ করে দেবো। নিহিনের পছন্দ হবে।”
“বেশি বুঝিস তুই, আমি কি একটা নূপুর নিজে পছন্দ করে কিনতে পারি না? তিথিকে লাগবে অন্য কারণে।”
“কী কারণ?”
“নিহিনকে আমি একটা নূপুর দিয়েছিলাম।”
“ওর জন্মদিনে, ওটা দিয়ে প্রপোজ করেছিলে।”
“বলেছে তোকে?”
“হুম, দেখিয়েছেও।”
“বাহ, তাহলে তো আর তিথিকে দরকার নেই। তোর ওই নূপুরটা ডিজাইন মনে আছে?”
“না। অনেকবছর আগে দেখেছিলাম।”
অসহায় মুখে বলল সাব্বির। কলরব বলল,
“তাহলে তো তিথিকেই লাগবে।”
“কী করতে চাচ্ছ বলো তো। ওইটার ডিজাইন কেন লাগবে?”
“ওই ডিজাইনেই বানাব।”
“কেন? অন্য একটা সুন্দর দেখে দিলেই হয়।”
“তুই বুঝবি না।”
“আচ্ছা, কিন্তু তিথির কি ওই ডিজাইন মনে আছে?”
“থাকতে পারে। মেয়েদের এসব মনে থাকে, না থাকলে কোনো ছুঁতোয় দেখে আসবে বা একটা ছবি তুলে নিয়ে আসবে। তারপর বানাতে দেবো। আর ওকে ভালোভাবে পটাতে হবে যাতে ও নিহিনকে কিছু না বলে।”
“সামনের সপ্তাহে যেতে হবে তাহলে। ওর শুক্র শনি বন্ধ আছে, তবে শনিবার হলেই ভালো। শুক্রবার প্রায়ই নিহিন তোমার সাথে বা তিথির সাথে দেখা করতে চাইতে পারে। শনিবার তো নিহিনের ভার্সিটি থাকে তাই ওইদিন যাওয়াই ভালো।”
“আচ্ছা তাহলে আগামি শনিবারে যাচ্ছি।”
“পারও তুমি ভাই। লাভ কী এসব করে? ও তো এমনিতেই তোমাকে ভালবাসে।”
“শোন এসব করতে হয়। আমি যেমন ওর মধ্যেকার অতুলনীয় কিছু কাজের জন্য ভুলতে পারিনি ওকে, এখনো ভালোবাসি। তেমনি ও আমার এ ধরনের কিছু মূল্যহীন কাজের জন্যই আমাকে এতটা ভালোবাসে। আমাদের ভালোবাসার মানুষেরা তো আমাদের ভালোবাসবেই, কিন্তু তার গভীরতা আমাদেরকেই নির্ধারণ করতে হবে। মনের মধ্যে যতটুকু খুঁড়বি ভালোবাসা ততটুকু গভীরই হবে। বেশি খুঁড়লে বেশি, কম খুঁড়লে কম।”
“খোঁড়াখুঁড়ির ব্যাপারটা বেশি কমপ্লিকেটেড হয়ে গেল ভাই, মনে হচ্ছে বুঝেছি আবার বুঝি নাই।”
“না বোঝার কী আছে? পুকুর যত খোঁড়ে তত গভীর হয় না? ওই রকম মন যত খোঁড়ে ভালোবাসা তত গভীর হয়।”
“ভাই মন কি মাটি যে খোঁড়া যাবে? বুঝিনাই ঠিক। যদি একটা উদাহরণ দিতা?”
“মন মাটির চেয়েও নরম। মন খোঁড়া মাটি খোঁড়ার চেয়েও সহজ। এই ধর, আমি একটা নূপুর গিফট করব ওকে। সেক্ষেত্রে আমি চেষ্টা করছি আগেরটার মতো একটা দিতে। কেন? কারণ একই রকম দেখে ও খুশি হবে, সেই মিষ্টি স্মৃতিগুলো মনে পড়বে। আর আমি যে ওর ভালোলাগার কথা ভেবে ইচ্ছে করে এটা করেছি সেটা ভেবে ওর আরো ভালো লাগবে, কারণ তখনই ও বুঝবে ওকে আমি কতটা গুরুত্ব দিচ্ছি। এটাই খোঁড়াখুঁড়ি, যত এরকম করব ততই ওর মনে আমার জন্য ভালোবাসার গভীরতা খোঁড়া হবে। আবার ধর ওর দিক থেকে যদি বলি, তাহলে ওই বাচ্চা মেয়েটা যে রাতদুপুরে আমার সাথে দেখা করতে ছাদে আসত। সেটা খুব রিস্কের কাজ আমি ছিল, তাও আসত। মাঝে মাঝেই আমার জন্য এটা ওটা রান্না করত, খেতে ভালোবাসি বলে। আমার এখনো মনে আছে, শুধু বলতাম যে অমুক জিনিসটা খেতে ইচ্ছে করছে, মা কাছে থাকলে বললেই বানিয়ে দিত। ও সেদিন না পারলেও দুদিনের মধ্যে সেটা রেঁধে খাওয়াতো আমাকে। প্ৰথমে কিন্তু রাঁধতে জানত না, আমাকে রান্না করে খাওয়ানোর জন্যই রান্না শিখল। এগুলো করে করে আমার মনে এত বেশি খুঁড়ে ফেলেছিল যে আমার ভালোবাসার গভীরতা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছে। তাই অন্য কারো কথা ভাবতে পারিনি আমি, আজও একা।”
“আজও একা কোথায়? পেয়েই তো গেছ তোমার পরিকে।”
“নারে অনেক সমস্যা, অনেক বাধা। যদি সব অতিক্রম করতে পারি তবেই পাব।”
“তুমি পারবা, ভাই। তোমাদের মতো কাপল খুব কম আছে ভাই যে দুজন দুজনের জন্য এসব করে আর তা অপরজন বুঝতে পারে। তোমরা ভাগ্যবান।”
“এতই ভাগ্যবান যে আজ ১০ টা বছর ধরে দূরে।”
“ইনশাআল্লাহ এবার দূরত্ব ঘুচবে সারাজীবনের জন্য। কিন্তু ভাই তুমি তো চিন্তায় ফেলে দিলে। তোমার মতো করে কখনো ভাবিনি। তাছাড়া এরকম তো অনেক কিছু আমার গার্লফ্রেন্ডও করেছিল আমার জন্য। কিন্তু খেয়াল করিনি। আমি সবসময় ভাবতাম এত ঝামেলা করার কী আছে। আমার গার্লফ্রেন্ড তো আমাকে ভালোবাসেই!”
“খেয়াল করতে হয়, ভালোবাসার মানুষের প্রত্যেকটা কাজে, প্রত্যেকটা অনুভূতি, প্রত্যেকটা কথা, প্রত্যেকটা ইংগিত খেয়াল করতে হয়। না করলে তার কাছ থেকেও আশা করবি কীভাবে? তোর কাছ থেকে একটা মেয়ে যখন প্রচণ্ড ভালোবাসা পাবে তখনই সে তোকে পাগলের মত ভালোবাসতে শুরু করবে। অবহেলা করলে ওই খোঁড়াখুঁড়িটা সে একদিন বন্ধ করে দেবে। যদি সে খুঁড়তেই থাকে আর তুই ভরতেই থাকিস তাহলে গভীর হবে কী করে?”
“চিন্তায় ফেলে দিলা ভাই। কিন্তু এখন আর চিন্তা করে কী হবে? ওতো চলেই গেছে, বিয়েও হয়ে গেছে এখন।”
“তাতে কী? বউ হয়ে যে আসবে তার খোঁড়াখুঁড়িতে নজর দিস। আর ভালো হয় সে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করার আগে যদি তুই শুরু করিস, যত যাই হোক তুই একটা পুরুষ মানুষ।”
“হ ভাই, ভালো কথা কইছো। তোমার মতো বিয়া না কইরা তো থাকতে পারমু না, বিয়া যখন করতেই হইব, তখন বউয়ের লগে ভালোবাসা জমানোই ভালো।”
“আগে ভাষা ঠিক কর তো। বিরক্ত লাগে এসব শুনলে।”
“সরি ভাই, আবেগে চলে আসছে।”
·
·
·
চলবে.................................................................................