ফানুস - পর্ব ২৩ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          সেদিনের কথা খুব মনে পড়ছে আজ প্রিয়র। যেদিন ডজনখানেক প্রতিজ্ঞা করে পেট্রাকে প্রপোজ করেছিল। তার জন্য মেয়েটার জীবন থেকে সব চলে গেল। মানসম্মান, বাবা-মা, সন্তান–সব হারিয়ে আজ পেট্রা নিঃস্ব। ছোট-ভাইয়ের দায়িত্ব ছাড়া আর কিছুই রইল না মেয়েটার জীবনে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই হোক, এসবের জন্য দায়ী তো প্রিয়ই। কীভাবে সে পেট্রাকে এই ক্ষতিপূরণ দেবে? যদি নিজের বাবাকে খুন করে, তাহলে কি ক্ষতিপূরণ হবে কিছুটা? মানুষ খুন করা মহাপাপ। কিন্তু একজন খুনিকে খুন করা নিশ্চয়ই মহাপাপ হবে না?

নিকিতার ঘুম আসছে না। কারণ, প্রিয় বারান্দায় বসে নীরবে কাঁদছে। প্রথমে সে বুঝতে পারে নি। গিয়ে শুতে ডেকেছিল, প্রিয় ধমক দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে তাকে। তখনই খেয়াল করেছে, প্রিয়র চোখে পানি। প্রিয় ও পেট্রার জড়িয়ে ধরে কান্নার দৃশ্য এখনো নিকিতার চোখে ভাসছে। সমস্ত শরীরে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। পেট্রার না হয় মা মারা গেছে, তাই মাথা ঠিক নেই। আর তা ছাড়া পেট্রা নিকিতাকে দেখেও নি। কিন্তু প্রিয় তো জানে যে নিকিতা আছে এখানে। তার সামনেই এই সিনটা না করলে কি হতো না? অবশ্য প্রিয় তো তাকে স্ত্রী বলে মানেই না। সে সামনে থাকলেও প্রিয়র কোনো কিছু আটকে থাকার কথা নয়। জানালা দিয়ে প্রিয়র দিকে তাকাল নিকিতা। প্রিয় এখনো চুপচাপ বসে আছে, হয়তো কাঁদছে। প্রিয়র এই কান্না নিকিতার মনে একবার মায়া সৃষ্টি করছে, পরক্ষণেই প্রচণ্ড ক্ষোভ। অসহ্য লাগছে সবকিছু। এত দিন হয়ে গেল পেট্রা নেই প্রিয়র জীবনে, তবু প্রিয় এখনো পেট্রার ঘোর থেকে বের হতে পারে নি। তাহলে নিকিতা এত কিছু কার জন্য করছে? কিসের আশায় করছে? ভালো হয়ে থেকে যখন কোনো লাভ নেই, তখন সে কেন ভালো হয়ে থাকবে? ভালোবাসা পাওয়ার চেষ্টা করেছে এত দিন, এখন থেকে স্ত্রীর অধিকার আদায় করার চেষ্টা করবে। নিজের জীবনের তিনটা বছর নষ্ট করে এখন হাল ছেড়ে দেবে? কক্ষনো না। হয় মরবে, নাহয় প্রিয়র সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে সংসার করবে। কিছু তো একটা করতেই হবে। অনেক শক্তিশালী একটা অস্ত্র আছে তার কাছে, সেটাতে তো এখনো হাতই দেওয়া হয় নি।

—————

অফিস থেকে ফিরে প্রিয়র শরীরটা খারাপ লাগছিল। তাই জিমে গেল না। শরীরের থেকে আসলে মনটাই বেশি খারাপ। কদিন ধরে ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতেই হালকা ঘুম এল এবং প্রিয় কখন ঘুমিয়ে পড়ল, টেরও পেল না। তারপর যখন ঘুম ভাঙল, তখন রাত গভীর। নিজেকে আবিষ্কার করল নিকিতার বুকে। প্রিয় লাফিয়ে উঠে সরে গেল। ছি ছি, সে নিকিতাকে জড়িয়ে ধরল কখন? নাকি নিকিতাই তাকে ধরেছে? উফ, কী করবে এই মেয়েকে নিয়ে। তারপর খেয়াল হলো, শুদ্ধ বিছানায় নেই। আরে, শুদ্ধ কোথায় গেল? ঘর থেকে বের হয়ে খুঁজতে লাগল। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখল কাজের মেয়ে এত রাতে বসে বসে টিভি দেখছে। প্রিয় জিজ্ঞেস করল, ‘শুদ্ধকে দেখেছ?

‘জি ভাইজান, বাবু আজকে খালুজানের লগে ঘুম দিছে। খালুজান কিসসা হুনাইতাছিল, হুনতে হুনতে বাবু ঘুমাই গ্যাছেগা।’

প্রিয় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল, ‘এত রাতে টিভি দেখছ যে? ঘুম নাই?

‘ভাইজান, খুব ভালা একটা ছবি দেহাইতাছে। শ্যাষ হইলেই ঘুম দিমু।

প্রিয় নিজের ঘরে ফিরে এল। নিকিতা ঘুমাচ্ছে। শাড়ি হাঁটু পর্যন্ত উঠে আছে। যে শাড়ি সামলাতে পারবে না, সে শাড়ি পরবে কেন? এইসব দৃশ্য শুদ্ধ দেখলে কী হবে? যত্তসব!

রাত বাড়ছে। ঘুমটা কেটে গেছে প্রিয়র, আর বোধ হয় আসবে না। বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরাল। পরপর দুটো সিগারেট শেষ করে ঘরে ঢুকল সে। ওয়ার্ডরোবের ড্রয়ারে চাবি ঘোরাল। ওপরের ড্রয়ারটা খুলেই হতভম্ব হয়ে গেল। ড্রয়ার ফাঁকা। পেট্রার দেওয়া ব্যক্তিগত সব জিনিসপত্র এবং তাদের দুজনের স্মৃতিবিজড়িত কত কিছু ছিল এখানে। দ্বিতীয় ড্রয়ার খুলে দেখল সেটাও ফাঁকা। এরপর প্রতিটা ড্রয়ার খুলল। সব ফাঁকা, কিছু নেই। কিন্তু চাবি তত আর কারও কাছেই নেই! প্রিয়র সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। সে নিকিতার চুল খামচে ধরতে যাবে, তখনই মনে পড়ল, এর আগে সে নিকিতার ওপর অত্যাচার করেছিল, পরে বুঝেছিল ভুল হয়েছে। তাই এবার স্বাভাবিকভাবে ডেকে তুলল।

নিকিতা ঘুম থেকে উঠে বলল, ‘কী হয়েছে?

প্রিয় খুব স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার ঘরে কে এসেছিল? ওয়ার্ডরোবের জিনিসপত্র কে সরিয়েছে?

নিকিতা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। ভয় করছে তার, কিন্তু ভয়টা সে প্রকাশ করতে চায় না। চুপি চুপি বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ‘আমি সরিয়েছি। আমার ঘরে আমি অন্য মেয়ের জিনিসপত্র সহ্য করব না আর। অনেক হয়েছে।

প্রিয় স্তব্ধ হয়ে গেল। কী বলছে নিকিতা! রাগে ইচ্ছা করল এই মুহূর্তে নিকিতাকে খুন করবে সে। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল। কারণ, চিঠি

ও জিনিসগুলো আগে উদ্ধার করতে হবে। স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘কোথায় রেখেছ?

‘চিঠিগুলো বাগানে নিয়ে আগাছার সাথে পুড়িয়ে ফেলেছি। বাকি জিনিসগুলো ফেলে দিয়েছি। ওগুলো এখন কোনো ডাস্টবিনে।

এবার প্রিয় তার ভয়ংকর রূপে চলে গেল। নিকিতাকে বিছানার ওপর ফেলে গলা টিপে ধরল। তারপর বলল, ‘এত সাহস হয় কী করে তোমার? জানের মায়া নেই?

নিকিতার মনে হচ্ছিল এক্ষুনি সে মরে যাবে। সে জানত এমন হবে। এমন কিছুর জন্য মনে মনে প্রস্তুত ছিল। সে মরার জন্য এসব করে নি। সব পরিকল্পনা করেই মাঠে নেমেছে। পরিকল্পনামাফিক প্রিয়র হাতে শরীরের সব শক্তি দিয়ে খামচি দিল। হাত একটু আলগা হতেই কামড় দেওয়ার চিন্তাও আছে। কিন্তু প্রিয় একটুও হাত আলগা করল না। বরং আরও জোরে গলা টিপে ধরল। নিকিতা এবার লজ্জা-সংকোচ বিসর্জন দিয়ে নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য প্রিয়র ট্রাউজার ধরে টান দিয়ে খুলে ফেলতে চাইল। অর্ধেকটা খুলতেই প্রিয় ভ্যাবাচেকা খেয়ে নিকিতাকে ছেড়ে দিল। নিকিতা উঠে কাশতে কাশতে দৌড়ে গিয়ে পানি খেলো। ততক্ষণে প্রিয় নিজের ট্রাউজার ঠিক করে বলল, ‘তোমার মতো নির্লজ্জ মেয়ের দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা হয়, ছি!’

নিকিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি তোমার মোবাইল-ল্যাপটপ থেকেও পেট্রার এবং তোমাদের সব কাপল ছবি ডিলিট করে দিয়েছি। এগুলার জন্যই তুমি পেট্রার ভালোবাসা থেকে বের হতে পারো না।

প্রিয় সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল-ল্যাপটপ চেক করল। নেই, কিছু নেই। এমনকি পেট্রার পাঠানো অনেক আগের মেসেজগুলোও নেই!

—————

প্রিয় মোবাইল-ল্যাপটপে কিছু না পেয়ে রাগে ফেটে পড়ছিল। ওদিকে নিকিতাও রাগে ফোঁস ফোঁস করছিল। নিকিতার ড্যামকেয়ার ভাব দেখে প্রিয় নিকিতাকে ধরে ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলল, ‘যাও, জাহান্নামে যাও। জীবন ভিক্ষা দিলাম। এই জীবনে আর কখনো আমার চোখের সামনে আসবা না। যদি আর কখনো আমার চোখের ত্রিসীমানায় দেখি, তোমার বুকটা ফেঁড়ে কলিজাটা বের করে টুকরো টুকরো করব আমি।’

নিকিতাকে বের করে দিয়ে যখন প্রিয় ফিরছিল, তখন নিকিতা বলল, ‘যদি তুমি আমাকে বের করে দাও, আমি সবাইকে বলে দেব যে শুদ্ধ তোমাদের ছেলে না। ও তোমাদের পালক ছেলে। সবার আগে বলব শুদ্ধকে। আমার কাছে প্রমাণস্বরূপ পেট্রার চিঠি আছে।

প্রিয় এ কথা শুনে অবাক হয়ে পেছনে তাকাল। কোথা থেকে নিকিতা এত সাহস পাচ্ছিল, এবার বুঝতে পারল প্রিয়! কিছু বলতে পারল না, চুপ করে রইল।

প্রিয়র মুখ দেখে নিকিতাই অবাক হয়ে গেল। প্রিয় এতটা ভয় পাবে, তা সে ভাবতেও পারে নি। একদম জেঁকের মুখে নুন পড়েছে। নিকিতার সাহস এবার আরও বেড়ে গেল। বলল, আমি তোমার চোখের সামনেই থাকব, তোমার ঘরে, তোমারই বিছানায়! তুমি শুদ্ধকে আলাদা ঘরে পাঠাবে। আমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে। নাহলে সব ফাঁস করে দেব।

প্রিয়র চোখের সামনে দিয়ে নিকিতা ঘরে ঢুকে গেল। প্রিয় ঘরে না ঢুকে উল্টো ঘুরে বাবর খানের ঘরে গেল। শুদ্ধ দাদার সঙ্গে ঘুমালে দরজা ভেতর থেকে লাগানো হয় না। সাবধানে ছেলেকে কোলে তুলে নিল প্রিয়। সে ঘুমে বেহুঁশ। তারপর প্রিয় নিজের ঘরে ঢুকল। শুদ্ধকে কোলে নিয়েই গাড়ির চাবি, মোবাইল, মানিব্যাগ ও ল্যাপটপের ব্যাগটা নিল। নিকিতা অবাক হয়ে গেল। বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ তুমি?

প্রিয় নিকিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘পুরোটা জানো না নিকিতা। শুদ্ধ ভাইজানের ছেলে। যদিও সে এই বাড়ির ভবিষ্যৎ মালিক, এই বংশের একমাত্র বংশধর। তবু এই বাড়িতে সে নিরাপদ নয়, আজ বুঝতে পারছি। তাই তাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি। থাকো তুমি আমার ঘরে, আমার বিছানায়।

প্রিয় দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। শুদ্ধ ভাইজানের ছেলে জেনে নিকিতা অবাক হওয়ারও সুযোগ পেল না। কারণ, এখন অবাক হওয়ার সময় নেই। প্রিয়কে আটকাতে হবে। নিকিতা দৌড়ে প্রিয়কে ধরার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। কারণ, প্রিয় বাইরে দিয়ে দরজা আটকে রেখে গেল। নিকিতা বের হতে না পেরে বাবর খানকে ফোন করল। রাত বাজে আড়াইটা। তিনি ফোন ধরলেন না। সম্ভবত তিনি ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমান। নিকিতা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।
·
·
·
চলবে....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp