নিকিতা আজ শাড়ি পরেছে। শাড়িটা আজই শ্বশুর তাকে দিয়েছেন। হালকা সাজগোজ করেছে। নিজের কাছেই নিজেকে সুন্দর লাগছে। কিন্তু লাভ কী? একজন তো ফিরেও তাকাবে না। শুদ্ধ বলল, ‘নিকিতা আন্টি, তুমি কোথাও যাচ্ছ?
‘না তো বাবা। কোথায় যাব?
‘ও। সুন্দর দেখে একটা শাড়ি পরেছ তো, তাই আমি ভ।b বাইরে যাচ্ছ।’
নিকিতা শুদ্ধকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘কেমন লাগছে আমাকে, বলো তো?
‘খুব সুন্দর। তুমি এত সুন্দর যে আমার শুধু দেখতে ইচ্ছা করে।’
নিকিতা শুদ্ধর কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘বাবা আমার! যত ইচ্ছা দেখবে।’
এমন সময় প্রিয় ঘরে ঢুকল। নিকিতাকে দেখে বলল, ‘কোথাও যাচ্ছ নাকি?
নিকিতা বলল, ‘না।”
ততক্ষণে শুদ্ধ দৌড়ে গেছে ওর বাবার কাছে। প্রিয় শুদ্ধকে কোলে নিয়ে আদর করল। শুদ্ধ বলল, ‘বাবা, শুধু তুমিই আছ যে আমাকে এখনো কোলে নিতে পারে, আর কেউ পারে না।’
‘আমি তো তোকে আজীবন কোলে নিতে পারব, বাবা।
‘আর যখন আমি বড় হয়ে যাব, তখন তো তুমি বুড়ো হয়ে যাবে। তখন আমি তোমাকে কোলে নিতে পারব।’
প্রিয় হেসে বলল, আচ্ছা, ঠিকাছে, নিস।
প্রিয় শুদ্ধকে নামিয়ে স্যুট খুলল, টাই খুলল। শার্টের বোতাম খোলার আগেই নিকিতা বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সে দেখতে চায় না প্রিয়র বুকের ওই দুর্বিষহ ট্যাটুটা।
প্রিয় শার্টটা খুলতেই শুদ্ধ প্রিয়র কাছে গিয়ে প্রিয়র বুকের বাঁ পাশে আঁকানো ‘পেট্রা লেখা ট্যাটুটা ছুঁয়ে বলল, আমার মা।
প্রিয় হেসে বলল, ‘আমার বউ।’
‘না, আগে আমার মা।
প্রিয় আরও হেসে বলল, আগে আমার বউ বেক্কল।
‘বউ বেক্কল কী বাবা?
প্রিয় হা হা করে হাসতে লাগল। তারপর বলল, ‘বেক্কল তো তোকে বলেছি।
‘বেক্কল মানে কী, বাবা?
‘বেক্কল মানে বোকা।’
‘বাবা, তুমি আমাকে বোকা বললে? আমি ক্লাসে ফার্স্ট হই।
‘বড় হলে বুঝবি কেন বলেছি।’
‘আচ্ছা বাবা, তুমি বলেছিলে এই ট্যাটুটা পারমানেন্ট। তার মানে কি জীবনে কোনো দিনও এটা মুছে যাবে না?
‘উঁহু।
‘তাহলে আমিও এমন একটা ট্যাটু করব।’
‘গার্লফ্রেন্ড হয়েছে নাকি তোর? শুদ্ধ রাগ করে প্রতিবাদ জানাল, ‘বাবা!
‘আচ্ছা সরি। তো কার নাম লেখাবি? তুইও কি পেট্রার নাম লেখাবি?
‘হ্যাঁ। একদম সেম সেম।
‘অনেক ব্যথা কিন্তু। ট্যাটু একধরনের পেন দিয়ে করে। ওই পেনের মাথায় অসংখ্য সুচ থাকে।
‘সুচ কী, বাবা?
‘আই মিন নিড়ল।
‘আল্লাহ! তাহলে অনেক খোঁচা লাগবে, ইনজেকশনের মতো।
‘সেটাই তো৷ ইনজেকশনকে তো যমের মতো ভয় পাস। আর ট্যাটু করাতে চাস?
‘তুমি ব্যথা পাও নি, বাবা?
‘পেয়েছি, তাতে কী? অনেক ভালোবাসি তো তোর মাকে।
‘আমিও ট্যাটু করাব, বাবা। আমিও মাকে অনেক ভালোবাসি। আমি ব্যথাকে ভয় করি না।’
প্রিয় হেসে বলল, আচ্ছা করিস, কিন্তু এখন না। যখন এইটিন হবি, তখন করিস।
‘আরও ইলেভেন ইয়ারস! তত দিনে তো আমি মরেই যাব।’
প্রিয়র মনে পড়ে গেল পেট্রার কথা। কোনো কিছুর সময় পিছিয়ে দিলেই পেট্রা অধৈর্য হয়ে বলত, তত দিনে তো আমি মরেই যাব। কথা বলতে শেখার সময়টা মায়ের সঙ্গে থেকে ছেলেটা মায়ের মতো কথা শিখেছে। প্রিয় শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে বলল, এইটিনের আগে ট্যাটু করতে পারমিশন দিলে তোর মা আমাকে অনেক বকবে, বাবা। খুব রাগ হয়ে যাবে।
‘সত্যি?
‘হুম, ট্যাটু তো বড়দের জিনিস।
‘আচ্ছা বাবা, তাহলে এইটিন যেদিন হব, সেদিনই এই সেম ট্যাটু করাব।’
প্রিয় শুদ্ধর কপালে চুমু দিয়ে বলল, ‘ওকে, ডান।
প্রিয় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে রইল। আজ কিছুই ভালো লাগছে না। শুদ্ধ পাশেই বসে হোমওয়ার্ক করছে। নিকিতা নাশতা নিয়ে ঘরে ঢুকল। বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়লে? নাশতা এনেছিলাম।
প্রিয় উঠে বলল, ‘না, ঘুমাই নি। এসব খাব না, চা খাওয়াও তো একটু।’
‘আমি এক্ষুনি আনছি।’
কিছুক্ষণ পরই চা নিয়ে এল নিকিতা। প্রিয় চা খেতে শুরু করল, নিকিতা শুদ্ধর হোমওয়ার্ক কত দূর হলো দেখতে বসল। শুদ্ধ হঠাৎ বলল, ‘বাবা, দেখো নিকিতা আন্টিকে আজ কত সুন্দর লাগছে, চলো না আজ আমরা বাইরে খেতে যাই।
প্রিয় অবাক হয়ে তাকাল শুদ্ধ ও নিকিতার দিকে। নিকিতাও বেশ অবাক হলো। প্রিয় বলল, ‘আজ? আজ কি কোনো বিশেষ দিন?
‘হ্যাঁ বাবা, আজ তো তোমার জিম নেই। তাই আমরা এই সুযোগে বাইরে খেতে যাব।’
প্রিয় হাসতে হাসতে বলল, আজ জিম নেই বলে আজ বিশেষ দিন! পাকনা ছেলে কোথাকার!
‘যাবে না, বাবা?
‘আচ্ছা যাব, হোমওয়ার্ক শেষ কর তাড়াতাড়ি।
—————
বাইরে খেতে যাওয়ার সময় প্রিয় ড্রাইভ করছিল। শুদ্ধ যথারীতি প্রিয়র পাশের সিটেই বসল, আর নিকিতা পেছনে একা চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছিল।
নিকিতা পড়াশোনায় খুব একটা ভালো ছিল না। মধ্যবিত্ত পরিবারের চার বোনের মধ্যে সবার বড় সে। তাই মা-বাবা তাড়াতাড়ি ভালো দেখে একটা বিয়ে দিতে চেয়েছিল। এইচএসসি পরীক্ষার পরই বিয়ে দিয়ে দিল। প্রিয়র বাবা ভার্সিটিতে ভর্তি করাতে চেয়েছিলেন কিন্তু নিকিতাই আগ্রহ দেখায় নি। এ জগতের কোনো কিছুর প্রতিই তার আর কোনো আগ্রহ নেই। এর চেয়ে যদি কম পয়সাওয়ালা একজনের সঙ্গে বিয়ে হতো আর সে ভালোবাসত, সে জীবনও সুখের হতো!
বিয়ের পরের দিনও প্রিয় অফিসে গিয়েছিল। নিকিতাও কাউকে কিছু না জানিয়ে বাসায় ফিরে গিয়ে মা-বাবার সঙ্গে চেঁচামেচি করেছিল। কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। মা-বাবা আবার বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মায়ের বক্তব্য ছিল, ‘যা হয়ে গেছে, মেনে নে, মা। জামাইয়ের সাথে থাক, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।’
নিকিতা রেগেমেগে বলেছিল, এমন মানুষের সাথে আমি থাকতে পারব না।’
‘তাহলে কী করবি? এখন যদি তুই চলে আসিস, আমি তোকে আবার বিয়ে দেব কীভাবে? একবার বিয়ে করা মেয়েকে কে বিয়ে করবে?
‘বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে? উনি আমার সাথে কিছু করেন নি।
‘এটা কি কাউকে বোঝাতে পারব? তা ছাড়া কত টাকাপয়সা খরচ করে বিয়ে দিলাম, সব জলে যাবে?
নিকিতা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘টাকা জলে যাবে ভাবছ আর এদিকে তোমার মেয়ের জীবনটা যে জলে গেল, এটা কিছু না?
‘জলে যাবে কেন? মাটি কামড়ে পড়ে থাক। শ্বশুরের মন জয় কর। জামাই বাবার সব কথা শোনে। একদিন জামাইয়ের মনও পাবি।’
‘আমি কি এখন তোমাদের কাছে বোঝা হয়ে গেছি, মা?’
‘বোঝা না রে মা। কিন্তু তোর ছোট বোনদের কথা একবার ভাব। তোর বোনদেরও তো বিয়ে দিতে হবে। তুই এখন এ বাড়িতে এসে উঠে থাকলে ওদের বিয়ে দেব কীভাবে? লোকে বদনাম করবে তোর।
‘আশ্চর্য তো! আমার স্বামীকে জোর করে বিয়ে দিয়েছে, সে আমার সাথে থাকতে চায় না। আমি চলে এসেছি, ব্যস। এখানে আমার কেন বদনাম হবে?’
‘সমাজের লোক এত কিছু বোঝে না, মা।
‘গোল্লায় যাক তোমাদের সমাজ। আই ডোন্ট কেয়ার।
‘মেয়েমানুষের এত রাগ থাকলে হয় না মা। একটু সহ্য করে থাক, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
এ রকমই আরও অনেক কিছু সেদিন নিকিতাকে বুঝিয়েছিলেন তার মা। সেসব কথা বুঝতে পেরে নয়, মা-বাবার ওপর রাগ করেই ফিরে এসেছিল শ্বশুরবাড়িতে ফিরতেই শ্বশুর ডেকে পাঠিয়েছিলেন। নিকিতা যেতেই বাবর খান বললেন, কোথায় গিয়েছিলে, মা?
‘আমি একটু বিউটি পার্লারে গিয়েছিলাম বাবা।
‘ও আচ্ছা। তা বলে যাবে তো, মা। খুব টেনশন করছিলাম।’
নিকিতা উপায় না দেখে মিথ্যা বলল, বলে গিয়েছিলাম তো, বাবা।’
‘কাকে বলে গিয়েছিলে?
‘আন্টিমতোন একজন। এত মানুষজন, আমি তো তেমন কাউকেই চিনি না।’
‘আচ্ছা ঠিকাছে। এরপর থেকে কোথাও গেলে আমাকেই বলে যেয়ো, মা। যখন যেখানে ইচ্ছা যেয়ো কিন্তু বলে যাবে।
‘জি আচ্ছা।’
নিকিতা জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু থেমে বাবর খান জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন লাগছে এখানে তোমার?
‘ভালো।
‘পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখেছ?
না।
‘দেখো, ভালো লাগবে। ছাদেও যেয়ো। ছাদটা খুব সুন্দর। অনেক গাছ আছে, দোলনা আছে, বেশকিছু পাখিও আছে।’
‘জি যাব।’
‘তোমার হয়তো এখানে একটু বোরিং লাগবে। বউভাতের পর তো সবাই চলে যাবে। আমি, শুদ্ধ, প্রিয় আর কাজের লোকেরা ছাড়া এ বাড়িতে আর কেউ থাকে না।
নিকিতা চুপ। বাবর খান জিজ্ঞেস করলেন, ‘পছন্দ হয়েছে তো আমার ছেলেকে?’
নিকিতা সামান্য হাসল, কিছু বলল না। কীই-বা বলার থাকতে পারে ওনাকে? উনিই আবার বললেন, ‘তোমাদের দুজনের তো বিয়ের আগে দেখা হয় নি, আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে তো, মা?’
নিকিতা সাহস করে বলে ফেলল, কী করে হবে? আপনার ছেলের তো এই বিয়েতে মত ছিল না। জোর করে বিয়ে দিয়ে আপনি সর্বনাশ ডেকে এনেছেন। আমার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেল।
বাবর খান ভাবতে পারেন নি নিকিতা এমন করে সরাসরি এসব কথা বলবে। তিনি বললেন, ‘দেখো মা, সন্তানের জন্য যেটা ভালো, আমরা বাবা-মায়েরা তা-ই করি সব সময়। অনেক সময় সন্তানেরা তা বুঝতে পারে না। তুমি ছোট মানুষ, হয়তো বুঝতে পারছ না। কিন্তু মা, আমার ছেলে একদিন তোমাকে খুব ভালোবাসবে দেখো।’
‘আপনার ছেলে এখনো শুদ্ধর মাকে ভালোবাসে। সে আমাকে কখনোই ভালোবাসতে পারবে না।’
‘পারবে মা, পারবে, তুমি শুধু একটু ধৈর্য ধরে থাকবে।
নিকিতা ঠান্ডা মাথায় নিচু গলায় বলল, আপনারা বলেছিলেন শুদ্ধর মা বেঁচে নেই। এই মিথ্যেটা বলা উচিত হয় নি। কোনো এক মেয়েকে আমি সাজিয়ে ওনার সাথে কথা বলিয়েছেন, এটাও ঠিক হয় নি। উনি রাজি না, এ কথা জানলে আমি বিয়ে করতাম না। প্রত্যেকটা মেয়েই চায় তার স্বামী তাকে ভালোবাসবে। আমি প্রেম করে বিয়ে করি নি। মা-বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী বিয়ে করেছি, তাহলে আমাকে কেন ভুগতে হবে? বিয়ের রাতেই কেন স্বামীর দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হবে, বলতে পারেন, বাবা? এখানে আমার কী অপরাধ?
সদ্য বিয়ে হয়ে আসা পুত্রবধূর মুখে এ ধরনের কঠিন কথা বাবর খান আশা করেন নি। তিনি মনে মনে নিজেকে কিছুটা প্রস্তুত করে নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, এর কোনোটাই আমাদের উচিত হয় নি, মা। তোমার সাথে আমরা অন্যায়ই করেছি। কিন্তু আমার ছেলেকে বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যই এই অন্যায় করতে হয়েছে। প্রিয় আমার অমতে ওই মেয়েটাকে বিয়ে করেছিল। যে-কোনো একটা মেয়েকে বিয়ে করত, আমরা মেনে নিতাম। কিন্তু মেয়েটা খ্রিষ্টান। একটা খ্রিষ্টান মেয়ের সাথে কীভাবে সংসার করি, বলো মা?’।
নিকিতা এ কথায় প্রচণ্ড অবাক হয়েছিল! শ্বশুর বললেন, ‘আমরা বলেছিলাম, মেয়ে যদি মুসলমান হয়ে যায়, তাহলে বিয়েতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু মেয়ের বাবার এত বড় সাহস, আমার ছেলেকে বলে খ্রিষ্টান হতে! যদিও প্রিয় রাজি হয় নি খ্রিষ্টান হতে আর ওই মেয়েও রাজি হয় নি মুসলমান হতে। কিন্তু দুই পরিবার রাজি না হওয়ায় ওরা নিজেরাই বিয়ে করে ফেলেছিল। যে যার ধর্ম পালন করত। এমনটা আমরা মেনে নিতে পারছিলাম না, মা। একই ঘরে স্বামী-স্ত্রী দুই ধর্ম পালন করবে! নাউজুবিল্লাহ। ওদের তো বিয়েই বৈধ হয় নি। বছরের পর বছর আমরা ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, আর ওরা আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছে। বহু ঘটনা ও দুর্ঘটনার পরে ওদের ডিভোর্স করাতে সক্ষম হয়েছি। তারপর তো প্রিয়কে কোনোভাবে আবার বিয়েতে রাজি করাতে পারছিলাম না। আমার ছেলেটা এই বয়স থেকে সারা জীবন একা থাকবে, তা কি আমি বাবা হয়ে দেখতে পারি, বলো? তার ওপর ডিভোর্সের পরেও ওই মেয়ের ভূত মাথা থেকে নামছিল না ওর। একসময় অনেক কষ্টে রাজি করাতে পারলাম। কিন্তু এত মেয়ে দেখলাম অথচ সব বিয়ে শেষ পর্যন্ত ভেঙে যেত। পরে বুঝলাম, প্রিয় নিজেই বিয়ে ভাঙছে। তাই এবার আর তোমার সাথে কথা বলতে দিই নি।
নিকিতা চুপ করে ছিল। কী বলবে বুঝতে পারছিল না। বাবার বয়সী একজন মানুষের মুখে এসব কথা শুনে কেন যেন ভীষণ মায়াও লাগছিল। উনি আবার বললেন, ‘আমাকে শ্বশুর ভাববে না। ভাববে আমি তোমার বাবা। তোমার যখন যা লাগবে, আমাকে বলবে। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। আমি তোমাকে বুঝিয়ে দেব কীভাবে কী করলে তুমি প্রিয়র মন পাবে। ওর সব দুর্বলতা আমি তোমাকে বলব। তুমি শুধু আমাদের ছেড়ে চলে যেয়ো না, মা। আমার ছেলে তোমাকে তাড়াতে চাইবে। সে আমাদের এটা বোঝাতে চায় যে সে অন্য কোনো মেয়ের সাথে সুখী হবে না। তার নিজের ধারণাও এটা। তার এই ভুল ধারণাটা ভেঙে দিতে পারবে না, মা?
মায়ায় পড়ে গিয়েছিল নিকিতা। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল সবার ওপর। নিজের ঘরে গিয়ে বসে ছিল। ফ্রেমে রাখা প্রিয়র ছবি দেখছিল। ছেলেটাকে দেখে যতটা লোভ হচ্ছিল, ততটাই বিরক্তি লাগছিল। সে কেন পড়ে থাকবে এই ছেলেটার মনে ভালোবাসা জাগানোর জন্য? সে তো ছেলেটাকে ভালোবাসে না!
রাতে এসে প্রিয় নিকিতাকে বাসায় দেখে বলল, তুমি এখনো যাও নি? গতকাল তো বলেছিলে যে আজ চলে যাবে!
‘গিয়েছিলাম, আমার বাপ-মা আমাকে রাখবে না। রাখলে নাকি আমার ছোট বোনদের বিয়ে দিতে পারবে না।’
প্রিয় আলমারি খুলে বাসায় পরার কাপড় বের করতে করতে বলল, ‘তুমিই তো বাচ্চা মেয়ে। তোমাকে বিয়ে দিয়ে এখন আবার তোমার ছোটগুলোকেও দেবে!
‘হ্যাঁ, আমাদের মতো গরিব ঘরে মেয়েদের খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।’
‘তাহলে কী করবে?
নিকিতা মাথা নিচু করে বলল, ‘কী আর করব, এখানেই থাকব। কপালে যা আছে, তা-ই হবে। গরিবের মেয়ে হয়ে জন্মালে অনেক জ্বালা।
রাইটিং টেবিলের ওপর রাখা পানির বোতলটা খুলে একঠোক পানি খেয়ে প্রিয় বলল, ‘দেখো, আমার সাথে পেট্রার সম্পর্ক আর কখনো জোড়া লাগার সম্ভাবনা নেই। যদিও আমি চাচ্ছিলাম কিন্তু আলটিমেটলি সেটা সম্ভব নয়। তাই, তুমি চাইলে এ বাড়িতে থাকতেই পারে। কারণ, তুমি গেলে আমার বাপ আরেকটা নিয়ে আসবে। আই মিন আমাকে আবার বিয়ে করানো হবে। কিছু বাধ্যবাধকতার কারণে আমি মন্ত্রীসাহেবের কথা মানতে বাধ্য হই। আর এ বাড়িতে থাকলে তোমার এই ঘরেই থাকতে হবে। কারণ, আমাদের মধ্যে যে স্বাভাবিক সম্পর্ক নেই, সেটা মন্ত্রীসাহেবকে জানতে দেওয়া যাবে না।
মনে মনে ভয় পেয়ে গেল নিকিতা। সে তো ইতিমধ্যে শ্বশুরকে বলে দিয়েছে! যা-ই হোক, সেটা প্রিয়কে জানতে দেওয়া যাবে না। চুপ থাকাই ভালো। পরক্ষণেই খুব অবাক হলো নিকিতা। আরে, সে যে প্রিয়কে ভয় পাচ্ছে! প্রিয়র দৃষ্টি, কথা বলার ধরন–সবকিছু ভীষণ তীক্ষ্ণ! প্রিয় বলল, ‘শুদ্ধর সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করবে না এবং তুমি আমার ব্যক্তিগত কোনো ব্যাপারে নাক গলাবে না। বাকি যা ইচ্ছা, করতে পারো। আর হ্যাঁ, আমি কখনো তোমার গায়ে হাত দেব না। তাই নিশ্চিন্তে এ ঘরে থাকতে পারো।’
নিকিতা হাঁ হয়ে গেল। এত সরাসরি কেউ এসব কথা বলে! প্রিয় তার মুখ দেখেই হয়তো বুঝল। পানির বোতলটা আবার টেবিলে রেখে প্রিয় বলল, কিছু মনে কোরো না। আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি।’
প্রিয় ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে গেল। নিকিতা ওখানেই দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে বলল, তোমার গুমর যদি আমি না ভেঙেছি, আমার নাম নিকিতা না। ভালোবাসিয়ে ছাড়ব তোমাকে!
প্রিয়র ডাকে চোখ খুলল নিকিতা, ‘নিকিতা? ঘুমিয়ে গেলে নাকি?
নাহ, এমনি চোখ বন্ধ করে ছিলাম।
আচ্ছা নামো, রেস্টুরেন্টে চলে এসেছি।
·
·
·
চলবে...................................................................................