ঘুম আসছিল না, তাই পেট্রা একটা মুভি দেখছিল। মুভি শেষ হওয়ার পর ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত ২টা ২৭ মিনিট। এখনো ঘুম আসছে না। রাত তিনটা-চারটার আগে একদিনও ঘুম আসে না। অফিসের জন্য আবার সকাল আটটায় উঠতে হয়। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরে মায়ের কাছে কথা শুনতে হয়। শুনতে হবে নাই-বা কেন, যা করে এসেছে অতীতে, তারই ফল ভোগ করছে এখন। এ জীবনের শেষ কোথায়?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল! তারপর ল্যাপটপ বন্ধ করতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ ফেসবুকে স্মরণের একটা মেসেজ এল। স্মরণ আর পেট্রা এত দিনে খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। মেসেজটা ওপেন করল পেট্রা। স্মরণ লিখেছে, এত রাত জাগো কেন তুমি?
পেট্রা লিখল, ‘ঘুম আসে না, তাই। তুমি কেন জাগো?
‘আমি তো জাগি না! আজ খেলা ছিল, খেলা দেখার জন্য জেগেছি।’
‘বুঝলাম।
‘আচ্ছা, তোমার কেন ঘুম আসে না, সেটা জিজ্ঞেস করা কি আমার অনধিকার চর্চা হবে?
‘না। এমনিই ঘুম আসে না!’
‘ঘুম পাড়িয়ে দেব? পাগলাটে ছেলেটার কথা শুনে হাসল পেট্রা। লিখল, কীভাবে?
‘অনুমতি দিয়ে দেখো কীভাবে?
‘আচ্ছা দিলাম।
‘ফোন করছি তাহলে।
ফোন কেন?
উত্তর না দিয়েই স্মরণ ফোন করল। পেট্রা ফোন ধরতেই স্মরণ বলল, ‘চ্যাটে কি ঘুম পাড়ানো যায় নাকি? ঘুম পাড়াতে হয় সামনাসামনি। যেহেতু সেটা সম্ভব নয়, ফোনে ট্রাই করছি। ফ্রেন্ড হিসেবে আমি এটা করতেই পারি, তাই না?
পেট্রা হেসে বলল, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে, করো।
এই গভীর রাতে পেট্রার জাদুমাখা কণ্ঠস্বর শুনে আধপাগল হয়ে গেল স্মরণ। কথা বলতে ভুলে গেল। পেট্রা বলল, ‘কী ব্যাপার, চুপ কেন?
‘নাহ, এমনি। তুমি কী করছ?
‘এতক্ষণ মুভি দেখছিলাম। এখন কিছু করছি না।’
‘আচ্ছা, ঘরের সব লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ো!’
পেট্রা কথা বলতে বলতেই লাইট বন্ধ করল। তারপর কম্বল টেনে শুয়ে পড়ল। স্মরণ বলল, ‘মশা আছে? থাকলে তো ঘুমাতে পারবে না।
‘অ্যারোসল দিয়েছিলাম। এখন মশা নেই।
‘আচ্ছা। এবার চোখ বন্ধ করো।’
চোখ বন্ধ করল পেট্রা। স্মরণ ল্যাপটপ থেকে ইউটিউবে ঢুকে শিব কুমার শর্মার বাজানো সানতুর ছেড়ে দিল। তারপর বলল, ‘ভাবো যে খুব নরম তুলতুলে একটা বিছানায় শুয়ে আছ তুমি। তোমার প্রিয় কম্বলটা তোমার গায়ে। আর তোমার মাথাটা সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার কোলে। যাকে তুমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো। মানুষটা তোমার মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, আবেশে তোমার ঘুম এসে যাচ্ছে।’
সঙ্গে পেট্রার চোখে ভেসে উঠল প্রিয়র মুখটা। মনে হলো বালিশে নয়, সে প্রিয়র কোলেই শুয়ে আছে। প্রিয় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। এমনটাই তো করত মানুষটা। স্মরণ নিজে কথা বলা বন্ধ করে সানতুরের ভলিউম বাড়িয়ে দিল। পেট্রা প্রিয়র কথা ভাবতে ভাবতে সানতুরের সুরে হারিয়ে গেল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল, নিজেও টের পেল না। ওদিকে অনেকক্ষণ পর স্মরণের মনে হলো, পেট্রা যখন কথা বলছে না, তখন নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। পরীক্ষা করার জন্য ডাকল, ‘পেট্রা?
স্মরণ সানতুর বন্ধ করল। তারপর ফোনে কান পাততেই পেট্রার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল। যাক, মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। স্মরণও ফোন। রেখে শুয়ে পড়ল।
—————
পেট্রা মাথায় একটা ছোট্ট নরম তুলতুলে হাতের স্পর্শ পেল। চোখ খুলতেই শুদ্ধকে দেখতে পেল। শুদ্ধ বলল, ‘মা! বাবা তোমার জন্য মাঝেমধ্যে কাঁদে। আর আমিও প্রায়ই কাঁদি তোমার জন্য। আমরা তোমাকে খুব ভালোবাসি, মা। তুমি কি আমাকে একটু আদর করবে?
ঠিক তখনই আরও একটা হাতের স্পর্শ পেল পেট্রা। লাফিয়ে উঠল। শিখা বললেন, কী হয়েছে, পেট্রা? দুঃস্বপ্ন দেখছিলি নাকি?
পেট্রা আশপাশে তাকিয়ে কোথাও শুদ্ধকে দেখতে পেল না। এটা স্বপ্ন ছিল তাহলে? স্বপ্নে এসেছিল শুদ্ধ? তা-ই হবে, বাস্তবে তো আর সম্ভব নয়।
মা বলল, ‘অফিসে যাবি না? ওঠ ওঠ।’
পেট্রা উঠে ফ্রেশ হতে গেল। ফ্রেশ হয়ে তড়িঘড়ি করে দুই পিস ব্রেড খেয়ে বেরিয়ে পড়ল। রিকশা নিলে দেরি হয়ে যাবে, তাই সিএনজি নিল।
পেট্রা দাঁড়িয়ে আছে একটা স্কুলবাসের পেছনে। এমন জায়গায় দাঁড়াল, যাতে রাস্তা দিয়ে যারা আসবে, তাদের সে দেখতে পারে। অপেক্ষা করতে লাগল কখন শুদ্ধ আসে! ছেলেটাকে কত দিন দেখে না। আজ স্বপ্নে দেখার পর মনকে আর আটকে রাখতে পারে নি।
বাচ্চারা আসতে শুরু করেছে। প্রত্যেকেই একে একে স্কুলে ঢুকে যাচ্ছে, শুদ্ধ কেন আসছে না? নাকি শুদ্ধ আগেই এসে পড়েছে? সে দেরি করে ফেলল! আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল, ঠিক তার পরপরই প্রিয়র গাড়ি দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গেই ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢেকে দাঁড়াল পেট্রা। শুদ্ধ গাড়ি থেকে নামল। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, প্রিয়ও নামল। প্রিয়র পরনে কালো স্যুট। শুদ্ধকে কিছু একটা বলে স্কুলের দিকে পাঠিয়ে দিল। শুদ্ধ হেঁটে হেঁটে স্কুলের গেটে গিয়ে বাবাকে হাত তুলে টা টা দিল, প্রিয়ও হেসে বিদায় জানাল। তারপর ভেতরে ঢুকল শুদ্ধ। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইল প্রিয়। তারপর গাড়িতে উঠে চলে গেল। পেট্রা অদূরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখল। প্রিয়কে দেখতে পেয়ে কখন যেন চোখদুটো ভিজে উঠল তার। সব সময় তো নিকিতাই শুদ্ধকে স্কুলে নিয়ে আসে, আজ হঠাৎ প্রিয়? এটা কি তবে ওর ভাগ্য? এ কেমন ভাগ্য? সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য?
—————
প্রিয়র সঙ্গে পেট্রার শেষ দেখা হয়েছিল তার গত বছরের জন্মদিনে। প্রিয় এসেছিল। তখন অফিশিয়ালি তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না ঠিকই কিন্তু কেউই যেন কারও ভেতর থেকে বের হতে পারছিল না। বারো বছরের একটা সম্পর্ক ছিন্ন করা কোনো মামুলি কাজ নয়।
সেদিন পেট্রা অফিসের জন্য বের হতেই দেখতে পেয়েছিল প্রিয় একটা গোলাপের বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে একে অন্যকে দেখে হেসেছিল। সেদিনও তাদের ছয়-সাত মাস পর দেখা হয়েছিল। পেট্রা সামনে যেতেই প্রিয় বুকেটা দিয়ে বলেছিল, ‘হ্যাপি বার্থডে, শুদ্ধর মা।’
বুকেটা নিয়ে পেট্রা একগাল হাসি দিয়ে বলেছিল, ‘থ্যাংক ইউ, শুদ্ধর বাবা।
প্রিয় বলেছিল, ‘এত সেজেছিস কেন? আবার শাড়িও পরেছিস দেখছি! জানতি আমি আসব। ঠিক বলেছি না?
‘কখনো না! অফিসে যাব বলে বেরিয়েছি। আজকাল প্রায়ই শাড়ি পরে যাই।
‘শোন, পার্ট কম নে, তোকে আমি চিনি।
‘কচু চিনিস, শুদ্ধকে এনেছিস?
‘নাহ, ও তো স্কুলে।
‘একদিন স্কুলে না গেলে কী হতো? আমার ছেলেটা তো অনেক ব্রিলিয়ান্ট। কোনো ক্ষতি হতো না।
পেট্রা মন খারাপ করেছিল। প্রিয় বলেছিল, ‘আচ্ছা সরি, ভুল হয়েছে আমার, এখন চল, গাড়িতে ওঠ।
‘কোথায় যাব?’
‘যেদিকে দুচোখ যায়।
‘না, আমার অফিস আছে।
‘শালি আজ তোর অফিস নেই আমি তোকে বলেছি না!
‘নেই মানে? আমি ছুটি নিই নি।
‘এখন নিয়ে নে।’
‘কতক্ষণ থাকৰি তুই?
‘জানি না, প্রয়োজনে সারা দিন থাকব।
পেট্রা ফোন করে ছুটি নিয়ে চলে গিয়েছিল প্রিয়র সঙ্গে। প্রিয় সত্যি উদ্দেশ্যহীনভাবে যেদিকে দুচোখ যায়, গাড়ি চালাচ্ছিল। পেট্রা বলছিল, ‘প্রিয়, এখন আমাদের এভাবে দেখা করাটা পাপ।
প্রিয় পেট্রার দিকে না তাকিয়েই ড্রাইভ করতে করতে বলছিল, ‘হুম, জগতের সবকিছুই পাপ। অন্তত, আমি যা যা করতে চাইব, তা তো পাপ হবেই।’
পেট্রা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল প্রিয়র দিকে। তারপর বলেছিল, ‘কেমন আছিস?
‘যেমন থাকা যায়। তুই কেমন আছিস?
‘তুই যেমন আছিস, তেমনই।’
‘কাজটাজ কেমন চলছে?
‘ভালো।
‘অনেক দিন পর তোক দেখছি, পেট্রা।
‘শুদ্ধকে দেখতে ইচ্ছা করছে খুব। কেন আনলি না?
প্রিয় চুপ। পেট্রা বলেছিল, ‘চল ওকে স্কুল থেকে নিয়ে আসি। আজ সারা দিন নাহয় আমরা একসাথে কাটালাম। একটা দিনই তো। কাটুক না একটু স্বপ্নের মতো।’
প্রিয় একটু সিরিয়াস হয়ে বলেছিল, ‘শুদ্ধকে আমি ইচ্ছা করেই আনি নি। আসতে চাইছিল খুব। বলছিল, আজকে মায়ের বার্থডে, আমি আজকে স্কুলে যাব না; মাকে দেখতে যাব। আমি আনি নি। কারণ, জানিসই তো–যতই তোর কাছে আসবে, ততই ও দুর্বল হয়ে পড়বে। তোকে ছাড়া থাকতে পারবে না আর। কিন্তু ও যে অভিশপ্ত পরিবারে জন্মেছে, ওকে তো শক্ত হতে হবে।
‘আমার ছেলেকে আমার থেকে দূরে রাখার কোনো অধিকার কিন্তু তোর নাই।’
এখানে অধিকারের কথা আসছে কোত্থেকে? যতটা অধিকার আমার, ততটা তো তোরও। তুই ওর মা। কিন্তু তুই ভেবে দেখ পরিস্থিতিটাই তো এমন।’
পেট্রা চুপ করে ছিল। একে তো ছেলেকে আনে নি, তার ওপর আবার বলছে ছেলে আসতে চেয়েছিল। এটা তাকে বলার কি খুব দরকার ছিল? প্রিয় বলেছিল, ‘রাগ করিস না, পেট্রা। এত দিন পর কোনোরকম ঝুঁকির পরোয়া না করে তোর হাসিমুখটা দেখতে এসেছি। তোর পেঁচি মুখটা না।
প্রিয়র এমন রসিকতায় আরও মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল পেট্রার। বলল, ‘তোর আমাকে দেখতে ইচ্ছা করে, আমার ছেলের করে না?
‘আমি তো আবার নিজেকে সামলে নিতে পারব। তোর ছেলে তো পারবে না। এখানে তোর সামনে খুব হাসিখুশি থাকবে, তারপর বাসায় গিয়েই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদবে। তখন কে সামলাবে?
‘তুই সামলাবি, ওর নতুন মা সামলাবে।
‘ওকে শুদ্ধ মা ডাকে না। আন্টি ডাকে।
পেট্রার আর কোনো কথাই বলতে ইচ্ছা করছিল না। প্রিয় একটা বক্স বের করে বলল, ‘তোর জন্য কেক বানিয়ে এনেছি। তুই আমাকে কতবার নিজ হাতে বানানো ক্রিসমাসের কেক খাইয়েছিস, আমি তো জীবনেও বানাই নি।
পেট্রার রাগ কমছিল না। সে শুধু ভাবছিল শুদ্ধর কথা। প্রিয় এবার বক্সের ঢাকনা খুলে দিয়ে বলল, ‘চামচ আনতে ভুলে গেছি, হাত দিয়েই খা।
‘আমি খাব না।’
‘শুদ্ধ বড় হোক, ম্যাচিওরিটি আসুক। তারপর যত ইচ্ছা দেখা করিস, কখনো বাধা দেব না। কেকটা খা প্লিজ, নিজে বানিয়েছি।’
‘আমি খাব না।’
প্রিয় দুষ্টুমি করে বলল, ঠিকাছে, তাহলে নিকিতাকেই নাহয় খাওয়াব। ভাগ্যিস, কেকের ওপর হ্যাপি বার্থডে বা তোর নামটাম লিখি নি।
যদিও পেট্রা জানে এটা দুষ্টুমি তবু রাগ হলো। যাও খাবে ভেবেছিল, এবার বলল, ‘হুম, বউ থাকতে অন্য মেয়ের জন্য এসব করতে নেই প্রিয়। তোর বানানো কেক তোর বউই ডিজার্ভ করে।
‘বাদ দে। এই নে, তোর জন্য অনেক খুঁজে এনেছি এটা।
এ কথা বলে প্রিয় একটা গিফট বক্স এগিয়ে দিল। কালো রঙের বক্স লাল রিবন দিয়ে বাঁধা। পেট্রা বলল, ‘এটাও নিকিতাকে দিয়ে দিস, খুশি হবে।
‘আচ্ছা বাবা, সরি। ওর কথা বলাটা আমার ভুল হয়েছে। আমি দুষ্টুমি করছিলাম, তুই যে বুঝবি না, আমি সেটা বুঝি নি।
পেট্রার কান্না পাচ্ছিল। বারবার শুদ্ধর মুখটা চোখের সামনে ভাসছিল। প্রিয়র কোনো কথাকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো মনের অবস্থা তার তখন ছিল না। কান্নাটা প্রিয়কে দেখাতে চায় নি সে, তাই বলেছিল, ‘প্রিয়, আমি বাসায় ফিরে যাব, আমার কিছু ভালো লাগছে না।
এ কথা বলে গাড়ি থেকে নামছিল পেট্রা। প্রিয় হাত ধরে ফেলল। বলল, ‘পেট্রা, থাম থাম। সরি ফর এভিরিথিং, শুধু আজকের দিনটা আমাকে দে। অনেক প্ল্যান ছিল আমার।’
পেট্রা কেঁদেই ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমি আজকে তোর সাথে আমার ছেলেকেও এক্সপেক্ট করেছিলাম, প্রিয়।
প্রিয় অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। পেট্রা অপেক্ষা করছিল প্রিয় হয়তো বলবে চল শুদ্ধকে স্কুল থেকে নিয়ে আসি। কিন্তু প্রিয় বলে নি। পেট্রার হাতটা ধরে চুপ করে বসে ছিল। পেট্রা হাত ছাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমেই বাসায় ফিরে গিয়েছিল। একবারও পিছনে ফিরে তাকায় নি।
—————
সেই ছিল শেষ দেখা, তারপর কথা হলেও দেখা আর হয় নি। আজ এভাবে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দেখতে পেয়ে বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। প্রিয় আগের চেয়ে আরও হ্যান্ডসাম হয়েছে। পেট্রা দিনকে দিন অযত্নে বুড়ি হচ্ছে, আর সে দিনকে দিন হ্যান্ডসাম হচ্ছে!
হোক, তাতে তার কী? কাউকে দরকার নেই তার এ জীবনের পথচলায়। চোখে জমে থাকা জলটুকু এবার গড়িয়ে পড়ল।
পেট্রা চোখ মুছতে মুছতে ফুটপাত ধরে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে শুরু করল। সিক্স প্যাক বুঝি এত দিনে প্রিয়র হয়েই গেছে। হলেই-বা কী! ওর তো আর দেখার সৌভাগ্য হবে না! সমস্যা কি এই ছেলেটার? সে কি দুনিয়ার সব মেয়েদের হার্টথ্রব হতে চায়?
হঠাৎ কোত্থেকে স্মরণ দৌড়ে এল।
‘আরে পেট্রা, তুমি এখানে!
পেট্রা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, এই তো, অফিসে যাচ্ছি।’
স্মরণ অবাক হয়ে বলল, ‘কাঁদছ কেন তুমি?
‘কই, না তো।
‘তোমার চোখ দেখেই তো বুঝতে পারছি। কী হয়েছে, বলো না আমাকে?’
‘কিছু হয় নি। তুমি এখানে কী করছ?
‘আমি এই রোড দিয়েই তো অফিসে যাই। গাড়ি থেকে দেখলাম তুমি কাঁদতে কাঁদতে হাঁটছ। তাই নেমে এলাম।’
ও।
‘চলো একসাথে যাই।’
গাড়িতে বসে স্মরণ জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি তো এদিকে থাকো না। তো এখানে কেন?
পেট্রা চুপ করে রইল। স্মরণ বলল, আচ্ছা, বলতে না চাইলে ঠিকাছে।
পেট্রা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমি এই স্কুলটাতে এসেছিলাম।
‘ও। তোমার কেউ পড়ে এখানে? নাকি অন্য কোনো কাজে এসেছিলে?
‘আমার ছেলে পড়ে এখানে। ওকে দেখতে এসেছিলাম।’
স্মরণ অবাক! কোনো রকমে বলল, তোমার ছেলে মানে? কেমন ছেলে?
‘আমার নিজের ছেলে।
‘আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। তুমি না সিঙ্গেল? তোমার না বিয়ের জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে?
‘হ্যাঁ, সিঙ্গেলদের কি বাচ্চা থাকতে পারে না?
‘তা পারে। কিন্তু কাঁদছ কেন?
‘ছেলেকে অনেক দিন পর দেখলাম। একটু আদর করতে পারি নি, কোলেও নিতে পারি নি। তাই কান্না পাচ্ছে।
মানে তোমার ছেলে তোমার কাছে থাকে না?
‘নাহ, বাবার কাছে থাকে।
‘ও। আদর করতে পারো নি কেন?
‘ওর বাবা নিয়ে এসেছিল।
‘তো?’
পেট্রা স্মরণের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি বুঝবে না।’
‘কান্নার দ্বৈত কারণের একটি ছেলের বাবা নয়তো?
পেট্রা তাকাল স্মরণের দিকে। স্মরণ মিটিমিটি হাসছে। পেট্রা কিছু বলল না।
—————
একই সময়ে প্রিয় অফিসের উদ্দেশে গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবছিল, আজ এত অস্থির লাগছে কেন? পেট্রাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। আজই কেন এমন বেপরোয়াভাবে ইচ্ছাটা হচ্ছে? আজ তো কোনো বিশেষ দিনও না। পেট্রাও কি তবে আজ তার কথাই ভাবছে? পাশাপাশি টেলিপ্যাথিক্যালি ওকেও ভাবাচ্ছে?
—————
স্মরণ টিস্যু এগিয়ে দিল। পেট্রা টিস্যুতে চোখ মুছল। স্মরণ বলল, ‘তোমার সম্পর্কে কি আর কিছু জানা বাকি আছে আমার? দুদিন পরপর একেকটা জানছি আর ধাক্কা খাচ্ছি।’
‘অনেক কিছু জানা বাকি আছে। কিন্তু এখনো ধাক্কা কেন খাচ্ছ? আমার সাথে তো আর তোমার কিছু হবে না।’
‘হবে না জানি, কিন্তু তাই বলে কি ফিলিংসটা চলে যাবে? মনের ভেতর তো আর ডিলিট বাটন নেই যে ফিলিংসটা ডিলিট করে দেব।
‘যত তাড়াতাড়ি পারো এই ফিলিংস থেকে বের হয়ে এসো।
‘চেষ্টা করছি।’
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ রইল। স্মরণই আবার কথা বলা শুরু করল, ‘তোমার ছেলের বয়স কত?
‘সাত বছর।
‘বাপ রে! তোমার বয়স কত?
‘ত্রিশ।’
স্মরণ মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, আমার আটাশ।
পেট্রা হেসে দিল। কিন্তু তখনো তার জলটলমল চোখ। পেট্রার মুখে হাসি দেখে স্মরণের ভালো লাগল। তারপর নিজেও হেসে বলল, ‘আমি সব সময় আমার থেকে বড়দের প্রেমে পড়ি। জানি না কেন।
পেট্রা কিছু বলল না। স্মরণ বলল, ‘আচ্ছা, তোমার ছেলে তোমার কাছে থাকে না কেন?
কিছু সত্য দুনিয়ার কাউকে বলা যায় না, তাই পেট্রা বলল, ‘আগে আমার কাছেই ছিল। এখন আমি ইচ্ছা করেই ওর বাবার কাছে রেখেছি। বাবার কাছে আছে বলেই এমন স্কুলে পড়তে পারছে। ভালো একটা লাইফ লিড করতে পারছে। আমার কাছে থাকলে তো সাধারণ কোনো বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়াতে হতো। আসলে আমার ফ্যামিলিতে একমাত্র আর্নিং মেম্বার আমি। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সংসার, মা ও ছোট ভাইবোনদের দায়িত্ব আমার ওপরেই।
‘কিন্তু তাতে কী, বাংলা মিডিয়াম খারাপ কিসে?
‘আমি বলি নি বাংলা মিডিয়াম খারাপ। ভালো স্কুলের কথা বলেছি। আমার ছেলে ক্লাস টুতে পড়ে। সাধারণ একটা বাংলা মিডিয়ামের ক্লাস ফাইভের স্টুডেন্ট থেকেও বেশি জানে, সব বিষয়েই। সম্ভবত তুমি বুঝবে পার্থক্যটা।’
‘তা ঠিক।
‘আমি সব সময় চাই আমার বাচ্চা ভালো থাকুক, ভবিষ্যতটা খুব সুন্দর হোক ওর।
‘মায়েরা সন্তানের সুখের কথা ভেবে কত স্যাক্রিফাইসিং হয়!’ স্মরণ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘তোমাদের ছাড়াছাড়ি হলো কেন?
পেট্রা হেসে বলল, ‘এত কিছু জেনে কী করবে?
‘না, মানে…যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে জানতে চাই। তোমার চোখে আমি আজ গভীর এক ভালোবাসার কান্না দেখলাম। এত ভালোবাসো যে মানুষটাকে, কেন তুমি তার থেকে দূরে, সেটা জানতে খুব ইচ্ছা করছে।’
‘কারণ ও মুসলিম।
স্মরণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মানে? তাহলে বাচ্চা হলো কীভাবে?’
বাচ্চা যেভাবে হয়, সেভাবেই হয়েছে। স্মরণ লজ্জা পেয়ে বলল, ‘না মানে, আমি জানতে চাচ্ছিলাম ধৰ্মই যদি বাধা হয়, তাহলে তোমরা এক হয়েছিলে কী করে? আর এক হয়েছিলেই যখন, তখন আলাদা হলে কী করে?
‘অফিসে নতুন প্রজেক্টের অনেক জরুরি কাজ আছে, তুমি তো জানো। তাড়াতাড়ি চালাও, অফিস টাইম হয়ে এসেছে।’
·
·
·
চলবে....................................................................................