শিকদার সাহেবের দিনলিপি - পর্ব ০২ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প


          মাথা ঘুরতে লাগল মীরার। ফিরে গেল অতীতের সেই দিনগুলোতে। হঠাৎ করেই রং নাম্বারে রাফিকে খুঁজে পাওয়া। নাম এক হওয়ার কারণে প্রথমদিন তাকে এক্স গার্লফ্রেন্ড ভেবে বকে দিয়েছিল রাফি। তারপর আরো কত কি! সবকিছু সেভাবেই ফেলে রেখে ডায়েরিটা উল্টেপাল্টে দেখল। ডায়েরিটা প্রায় ভরা। অনেক কিছু লেখা। কিছু পাতায় হাবিজাবি আঁকিবুকি করা। রাফি কি কাউকে না বলতে পারা কথাগুলো লিখে রাখত? রাফির সঙ্গে ৫ বছরের সংসার তবু অনেক রহস্য ভেদ করতে পারেনি সে। আর তর সইছিল না। মাঝখান থেকে কিছু পড়তে ইচ্ছে করছিল না। সে প্রথম থেকে পড়া শুরু করল।

প্রথম পাতা…

আগের ডায়েরিটা শেষ হওয়াতে নতুন ডায়েরি নিলাম। আমার সব ডায়েরির মতো এই ডায়েরিটারও একটা নাম দেয়া প্রয়োজন। না হলে কথাবার্তা বলা সহজ হয় না। কিন্তু এই মুহূর্তে নাম ঠিক করতে পারছি না। অথচ অনেক কথা জমে গেছে!

রাফসান শিকদার
১৯ জানুয়ারি, ২০০৯

তোর নাম ঠিক করেছি বকুল। কি নাম পছন্দ হয়েছে তো? গেটের ধারের বকুল গাছে আজ প্রথম ফুল ফুটেছে। তা দেখে হঠাৎ মনে হলো তোর নাম বকুল রাখা উচিত। এখন মনে হচ্ছে এরচেয়ে উপযুক্ত আর কোনো নামই হতে পারে না। যাক নাম যখন রাখা হয়ে গেছে এখন থেকে অনেক কথা হবে। এখন সময় নেই। ক্যাম্পাসে যাচ্ছি। মন খারাপ করিস না, তোকেও নিয়ে যাব। তুই পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আমার সঙ্গেই থাকবি ২৪/৭। বোঝা গেল? নে এবার ব্যাগে ঢোক।

রাফসান শিকদার
২৪ জানুয়ারি, ২০০৯

পরের পাতা…

বকুল শোন, ডায়েরি শেষ হলে মনটাই খারাপ হয়ে যায়। তাই ইচ্ছাকৃতভাবে বেশ বড়সড় দেখে নিলাম তোকে। যাতে দীর্ঘদিন সঙ্গে রাখতে পারি। তুই আমার জীবনে নতুন। অনেক কিছুই জানিস না আমার সম্পর্কে। কিছু কি আগেই জেনে নিতে চাস নাকি আমার সঙ্গে থাকতে থাকতে জানতে চাস? আচ্ছা আস্তেধীরেই না হয় জানলি। এত তাড়া কিসের। তুই আমার জীবনে এমন একটা সময়ে এসেছিস যখন আমি মানসিকভাবে প্রচণ্ড এলোমেলো হয়ে আছি। কেন? মীরার জন্য। সে ফিরতে চায় আমার কাছে আবার, কিন্তু আমি চাই না। মীরাকে তো চিনিস না। ছোট করে পরিচয় দিয়ে নিই। ও আমার কাজিন। বয়সে আমরা সমান। আমি কয়েকদিনের বড়। কাজিনের সঙ্গে প্রেম? জঘন্য ব্যাপার না? কিন্তু কেমন করে যেন হয়ে গেল। মনে হতে লাগল ওকে না পেলে এই জীবনের কোনো মূল্য থাকবে না। কিন্তু বলতে পারতাম না। মেয়েরা ছেলেদের থেকে একটু অ্যাডভান্স থাকে। মীরা আবার সেই অ্যাডভান্স মেয়েদের থেকে কয়েক ডিগ্রি অ্যাডভান্স। সে নিজেই বুঝে নিল। কয়েকদিন আমাকে খুব নাচাল এরপর ধরা দিল। আমার অন্তরে তখন এই গানটা বাজত, আমার কি সুখে যায় দিন রজনী কেউ জানে না। একদম রূপকথার মতো মীরা হাসলেই আমার বুকে জোছনা ঝরত, কাঁদলেই সেই বুক ভেঙে যেত, রাগ করলে নিশ্বাস থেমে যেত। মীরা চেয়েছে আমি দিইনি এমন কিছু দুনিয়াতে নেই। চল তোকে একটা উদাহরণ দিই, তখন সবে কলেজে উঠেছি। মীরা একবার আমার ওপর ভীষণ রাগ করল। কিছুতেই রাগ ভাঙে না। আমি বললাম,

কী করলে তোর রাগ ভাঙবে?

ও বলল,

পৌষের রাতে আমাদের পুকুরে বুক পর্যন্ত নেমে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকবি। আমি জানালা থেকে একটু পর পর চেক করব।

আমি সত্যিই কাজটা করলাম। এবং মীরাও সারারাত চেক করল। ভোরবেলা আমাকে চলে যেতে বললে আমি চলে গেলাম। পরদিন শরীর কাঁপিয়ে জ্বর! খবর পেয়ে মীরা আমাকে দেখতে এলো। এসে সে কি কান্না! বারবার বলছিল,

কেন তুই সত্যি সত্যি সারারাত পুকুরে ডুবে থাকলি? আমি তো রাগ করে বলেছিলাম। তাই বলে সত্যিই করতে হবে? তুই কি পাগল?

এসব আবোলতাবোল বকুনির সঙ্গে একটা বিশেষ উপহার পেয়েছিলাম। ছোট একটা চুমু। কিন্তু অনুভূতিটা বড়! আমি এসব ব্যাপারে নাদান বাচ্চা হলেও ও ছিল প্রচণ্ড লেভেলের অ্যাডাল্ট!

কী ভাবছিস বকুল? সবকিছু অতীতকালে কেন বলছি? কারণ মীরা এখন আমার জন্য অতীত। বছর চারেক আগে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছে। ছাড়াছাড়ি আমি নিজেই করেছি। অবাক হচ্ছিস? যে মেয়ের জন্য আমি এত পাগল তার সঙ্গে কেন ছাড়াছাড়ি করলাম? কারণটা আজ অবধি কাউকে বলিনি। তোকেই প্রথম বলছি, মন হালকা করতে হবে। না হয় শ্বাস নিতে পারি না। ও ডাবল টাইমিং করেছে। ওর এক্সের কথা আমি আগে থেকেই জানতাম। তা নিয়ে আমার মাথাব্যথাও নেই। কিন্তু আমি থাকা অবস্থায় আরো একজনের সঙ্গে প্রেম করছে-এটা মানতে পারছিলাম না। আর সেই একজন আমারই বন্ধু শিবলি। শিবলি অবশ্য জানত না মীরার সঙ্গে আমার কিছু আছে। মীরাও জানত

শিবলি আমার বন্ধু। একই এলাকায় থাকলে যা হয়, সবারই সবার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে চেনাজানা থাকে। শিবলির মুখে ওদের রসায়নের গল্প শুনলাম। মীরা আমার কাছে মাফ চেয়েছিল। সে নাকি আমাকেই ভালোবাসত। শিবলির জন্য ওর ভালোবাসা নেই। তাহলে কেন এই সম্পর্ক সেই প্রশ্ন করায় মীরা আমাকে একটা যুক্তি ছিল, দে গট ইমোশনাল। আমার মন চাইছিল মীরাকে ওখানেই খুন করে ফেলি। কিন্তু পারলাম না। শুধু সম্পর্ক ছিন্ন করে আসলাম। জানি ভালোবাসা জীবনের সবকিছু নয়। কিন্তু এই ভালোবাসাই যে আমার জীবনের সবকিছু উল্টোপাল্টা করে দিয়েছিল? আমার সব সুখ কেড়ে নিয়েছিল এই ভালোবাসা। না না একে তো আর ভালোবাসা বলা চলে না। এটা ছিল মন্দবাসা।

রাফসান শিকদার
০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯

পরের পাতা…

বাবা-মায়ের ভালোবাসার গল্পটা কী সুন্দর! বাবা অফিস ট্যুরে তুরস্ক গেল। এক মাসের ট্যুর। সেখানে মায়ের সঙ্গে পরিচয় এবং ভালোবাসা। মায়ের পরিবার খুশি ছিলেন না এই বিয়েতে। কিন্তু তুর্কি মা আমার বাংলাদেশি বাবার মায়া ছাড়তে পারলেন না। বিয়ে করে নিলেন। ভিসাজনিত কারণে মা বাবার সঙ্গে তখনই বাংলাদেশে আসতে পারলেন না। পরবর্তীতে একা এলেন। এরপর টোনাটুনি সংসার বাঁধলেন। আমি এই জীবনে এদের মধ্যে যে ভালোবাসা দেখেছি তা আর কারো মধ্যে দেখিনি। কিংবা কে জানে সব বাবা-মায়ের ভালো বাসাই হয়তো এমনই মিষ্টি। দূর থেকে বোঝা যায় না। কাছ থেকে দেখলেই কেবল বোঝা যায়। অথচ তাদেরই ছেলে হয়ে আমার ভাগ্যে কী জুটল! মীরা ফিরে আসতে চায়। অনেক অনুনয়-বিনয় করছে। ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের মিষ্টি ভালোবাসা দেখে বড় হওয়া আমি এমন ফাটল ধরা ভালোবাসা কেন যেন মেনে নিতে পারছি না। মীরার জন্য কষ্ট হয়, খুব কষ্ট হয় কিন্তু ওর প্রতি সেই শ্রদ্ধাটা আর বেঁচে নেই। ওকে গ্রহণ করলেও শ্রদ্ধাবোধ ছাড়া একটা সম্পর্ক নড়বড় করবে না? একটা সুযোগ কি দেয়া উচিত? এতবার যখন মাফ চাইছে? তুই কি বলিস বকুল?

রাফসান শিকদার
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০০৯

আজ ক্লাস শেষে তপনদের বাসায় গিয়েছিলাম একটা প্রজেক্ট ওয়ার্কের জন্য। তখন দেখি তপনের বোন ত্রিশা চোখ দিয়ে ইশারা করে। চায়ের কাপ দেয়ার ছুঁতোয় হাতে হাত লাগায়। কেমন কেমন করে হাসে। কী ভয়াবহ অবস্থা! এখন মনে হচ্ছে এই মেয়ে আগেও এমন করেছে কিন্তু সেভাবে খেয়াল করিনি। পিচ্চি একটা মেয়ে সবে ক্লাস টেনে পড়ে এখনই অশ্লীল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এ ধরনের মেয়েরা ভয়ংকর। এরপর থেকে আর তপনের বাসায় যাওয়া যাবে না।

রাফসান শিকদার
২২ মার্চ, ২০০৯

মীরাকে আরেকটা সুযোগ দিলাম। ভুল করলাম কি না জানি না। তবে সে যখন শোধরাতে চাইছে তাকে শোধরানোর সুযোগ দেয়া উচিত। তা না হলে হয়তো সে আরো খারাপ দিকে যাবে। তার প্রতি আমার রাগ ছাড়া আর কোনো অনুভূতি ছিল না। সময় গেলে নিশ্চয়ই সব ঠিক হয়ে যাবে ভেবে মাফ করে দিলাম। কিন্তু যখনই ও আমার হাতটা ধরল, মনে হলো, আজও ভালোবাসি।

রাফসান শিকদার
০৩ এপ্রিল, ২০০৯
·
·
·
চলবে....................................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp