অমানিশার মধ্যরাত - আতিয়া আদিবা - অনু গল্প

পড়ুন আতিয়া আদিবা রচিত সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত একটি ছোটো সামাজিক ধরনের অনু গল্প অমানিশার মধ্যরাত
অমানিশার মধ্যরাত
১৮+ সতর্কীকরণ... এই গল্পটি সম্পূর্ণ প্রাপ্ত বয়স্ক এবং প্রাপ্ত মনস্থ পাঠকদের জন্য। গল্পের প্রয়োজনে গল্পের মধ্যে কিছু অপভাষার ব্যবহার করা হয়েছে। যদি আপনার এসব পছন্দ না হয়ে থাকে তবে অনুরোধ করবো এই গল্পটি পড়া থেকে বিরত থাকুন। ধন্যবাদ।
          সদ্য ক্লাস নাইনে উত্তীর্ণ একটি মেয়ে প্রেগনেন্সি কীট কিনতে ফার্মেসিতে এসেছে। বিষয়টি অবিশ্বাস্য। কিন্তু এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটি এখন ঘটছে মকবুলের ফার্মেসিতে। মকবুল কটুক্তির চোখে মেয়েটিকে দেখছে। মুখ ফুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে_ ছি:! এই বয়সে এসব? নষ্টা মাগী জানি কোথাকার। 
এই নষ্টা মাগীদের জন্যই সমাজটা দিন দিন নর্দমায় পরিণত হচ্ছে। বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যায় না। চারিদিকে দুর্গন্ধ! ছি:

অমানিশার পুরো শরীর এখনো কাঁপছে। সন্তপর্ণে চতুর্দিকে চোখ বোলাচ্ছে বারবার। গায়ে স্কুলের ইউনিফর্ম। কেউ তাকে দেখছে না তো? কাঁপা গলায় সে পুনরায় প্রশ্ন করল, 
ভাইয়া, প্রেগনেন্সি কীট আছে কি? 
মকবুল বিষদৃষ্টিতে অমানিশার দিকে তাঁকিয়ে উত্তর দিল, আছে। 

ভাইয়া একটু তাড়াতাড়ি দিন। কাগজে মুড়িয়ে দিয়েন ভালো করে। 

মকবুল প্রেগনেন্সি কীট কাগজে মোড়াতে মোড়াতে দাঁতের ফাঁক দিয়ে নিচু স্বরে গালি দিল, বেশ্যার ঘরের বেশ্যা!

কত টাকা ভাইয়া? 

সত্তর টাকা। 

থ্যাংক ইউ। 

অমানিশা আরোও একবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। এরপর যত দ্রুত সম্ভব ব্যাগে কীটটি ঢুকিয়ে ফেলল। ফার্মেসি থেকে বের হয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগল। আজকাল হাঁটতে বড় কষ্ট হয় তার। কয়েক কদম ফেললেই বুকটা ধরফর ধরফর করে। গত কয়েকদিন ধরে একদম খেতে পারছে না সে। শরীর জুড়ে অবসাদ। বড় ক্লান্ত লাগে। হাত পা অবশ হয়ে আসে। 
অমানিশা ভ্রুঁ কুঁচকে আকাশের দিকে তাকানোর চেষ্টা করল। সূর্য একদম মাথার ওপর। সমস্ত তাপ ঢেলে দিচ্ছে প্রকৃতিতে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। নাক ঘেমে উঠেছে। শ্যামবর্ণের মেয়ে বলে গালের লাল টুকটুকে আভা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে নি বরং তার মুখ আরোও কালো দেখাছে। 

হঠাৎ অমানিশার মনে হল, লোকে বলে_ নাক ঘামলে নাকি জামাই আদর করে! তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসির দেখা মিলল। 
কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে সে রিক্সা ডাকল। গন্তব্যস্থল ঠিক করে রিক্সায় জড়োসড়ো হয়ে বসল। ভালোমতো স্কার্ফ দিয়ে মুখ ঢেকে নিল। এক্ষুনি স্কুলের সামনে দিয়ে রিক্সা যাবে। টিফিন পিরিয়ডে কোনোভাবে গার্ডের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাইরে এসেছে। ইউনিফর্ম পরিহিতা কাউকে দেখলে অবশ্যই গার্ড আটকাবে। জিজ্ঞাসাবাদ করবে। 
- তুমি কোন শিফট এর? বাসা কোথায়? ইউনিফর্ম পরে বাইরে কেনো ঘুরছো? ইত্যাদি।
উত্তর মন:পুত না হলে সোজা হেডমাস্টারের ঘরে! অমানিশা এজাতীয় ঝক্কিঝামেলায় জড়াতে চাইছে না। 

অবশ্য, এজাতীয় ঝক্কিঝামেলা তাকে পোহাতেও হল না।

স্কুলের সীমানা অতিক্রম করার সাথে সাথেই অমানিশা ব্যাগ থেকে একটি ছোট্ট বাটন ফোন বের করল। এই ফোনটি সে লুকিয়ে ব্যবহার করে শুধুমাত্র আহনাফের সাথে কথা বলার জন্য। অমানিশা আহনাফের নাম্বার ডায়াল করল। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে ভরাট কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। 

হ্যালো। 

অমানিশার পুরো শরীরে যেন দ্রুতবেগে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হল। এই অনুভূতি তার কাছে নতুন নয়। যতবার সে আহনাফের কণ্ঠস্বর শুনে ঠিক ততবার তাকে এই অনুভূতি কাবু করে ফেলে। তার মুখের সমস্ত শব্দ কেড়ে নেয়। তাকে বোবা করে দেয়।  

আহনাফ চিন্তিত স্বরে আবারও বলল, 
হ্যালো নিশা, শুনতে পাচ্ছো? 

তুমি বাসায় আছো? 

হুঁ। আজ সকালে এসেছি।

আমি তোমার বাসায় আসছি। 

আহনাফ ফিঁক করে হেসে ফেলল।
আবার স্কুল পালিয়েছো? 

অমানিশা প্রত্যুত্তরে হাসল। বলল, 
তোমার সাথে দেখা করার জন্য - একবার নয়, দুবার নয়, তিনবার নয়, সহস্রবার স্কুল পালাতে রাজী আছি!

আহনাফ জিজ্ঞেস করল, শুধু দেখা করার জন্য? - তার কণ্ঠস্বরে ভরপুর দুষ্টুমি। 

অমানিশা এপ্রশ্নের উত্তর দিল না। বলল, 
আমার আসতে আর পাঁচ মিনিট লাগবে। 

সাবধানে এসো। 

অমানিশা ফোন কেটে দিল। 

আহনাফদের পাঁচ তলা বাসাটি তার বাবা, চাচা ও ফুফুরা মিলে করেছে। প্রতি ফ্লোরে দুটো করে ইউনিট। দোতলার একটি ইউনিটে আহনাফ তার মা এবং প্যারালাইজড বাবাকে নিয়ে থাকে। অন্য ইউনিটে ভাড়াটিয়া ছিল তবে গতমাসেই তারা ছেড়ে দিয়েছে। নতুন করে ভাড়া দেওয়া হয় নি। এ সুযোগে আহনাফ গাট্টি বোচকা নিয়ে খালি ইউনিটে গিয়ে উঠেছে। 

বলিউডের 'আশিকী টু' মুভি মাত্র রিলিজ পেয়েছে। কি চমৎকার এই মুভির গানগুলো! সাউন্ডবক্সে উচ্চশব্দে 'তুম হি হো' গানটি শুনছিল আহনাফ। ঘরের জানালা বন্ধ। ভারী পর্দা টেনে রাখা। এদিকে একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকছে সে। অতিরিক্ত ধোঁয়ায় ঘরটাকে ভুতুড়ে দেখাচ্ছে। 

ঠক ঠক। দরজায় দুইবার টোকা পড়ল। আহনাফ নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল, কে?
ওপাশ থেকে অমানিশার মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া গেল। 
আমি, আহনাফ। দরজা খোলো। 

আহনাফ সিগারেটে লম্বা করে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে দরজা খুলে দিল। অমানিশা ঘরে ঢুকতেই তাড়াহুড়ো করে দরজা লাগিয়ে দিল। 

আহনাফের লাল টুকটুকে চোখ দেখে অমানিশা কিছু একটা বলতে চাইছিল। তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হল না। দেয়ালে হাত দুটো চেপে ধরে গভীরভাবে চুমু খেতে লাগল তার ঠোঁটে। নিশ্বাস ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হতে লাগল অমানিশার। আহনাফের ঠোঁটের ঢেউয়ের কারুকাজের কাছে নিজের প্রচেষ্টা বরাবরই তুচ্ছ মনে হয় তার। তবুও ভালোবাসা প্রকাশ করার এই মাধ্যমে অমানিশা কখনো ছাড়তে চায় না। নিজের সবটুকু দিয়ে ঠোঁটের এই খেলায় অংশগ্রহণ করে। আজও করল। 

কতক্ষণ দুজন এভাবে মিশে ছিল সময়ও হয়তো হিসেব রাখে নি। এক পর্যায়ে দুজন শান্ত হয়ে পাশাপাশি বসল। অমানিশা হাঁপাচ্ছে। আহনাফ হেসে জিজ্ঞেস করল, 
পানি খাবে? 

অমানিশা মাথা ঝাঁকাল। আহনাফ তার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিল। এক নিশ্বাসে প্রায় আধা বোতল পানি শেষ করল অমানিশা। আহনাফ ফ্লোর বেডে শুয়ে হাসিমুখে আরেকটি সিগারেট ধরালো। বিছানার একপাশে সাদা কাগজে গোলাপি রঙের তিনটি ট্যাবলেট রাখা। সেদিকে ঘৃণ্য চোখে ক্ষণিককাল তাকিয়ে রইল অমানিশা। এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, 
আবার নেশা করেছো? তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে আর নেশা করবে না। 

আহনাফ কোনো উত্তর দিল না। সিগারেট ফুঁকায় মন দিল। 

অমানিশা অশ্রুসিক্ত চোখে বলল,
তুমি না বলেছিলে ডাক্তার দেখিয়েছো? নেশা ছাড়ার জন্য তোমাকে অনেক দামী দামী ওষুধ দিয়েছে? কোথায় সেগুলো? আমি কত কষ্ট করে অতগুলো টাকা এরেঞ্জ করেছি জানো? সোনার আংটিটা বিক্রি করতে হয়েছে!

আহা ওষুধগুলো আছে তো! মার ঘরে। 

তোমার ওষুধ মার ঘরে কেনো? 

মার ঘরে একটা বড় ঝুড়ি আছে। ওখানেই সব ওষুধগুলো রেখে দিয়েছি। 

ওষুধও খাচ্ছো আবার নেশাও করছো? 

একবারে কি ছাড়া যায়? আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি, নিশা। তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না? 

অবশ্যই, বিশ্বাস করি। 

আহনাফ হেসে অমানিশাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলল। বলল, 
তাহলে এত প্রশ্ন করছো কেন? 

অমানিশা ছলছল চোখে বলল,
আমার অনেক ভয় করছে, আহনাফ।

কিসের ভয়? 

অমানিশা ফুঁপিয়ে উঠল। 

আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, 
বলো, কিসের ভয়? 

আমার পিরিয়ড হচ্ছে না। অলরেডি পনেরো দিন লেট। 

আহনাফ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। 
এরপর জিজ্ঞেস করল, তোমার কি মনে হচ্ছে তুমি প্রেগন্যান্ট? 

অমানিশা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। 

আহনাফ উল্লাসিত কণ্ঠে বলল, 
আমি বাবা হব? তুমি মা হবে? 

অমানিশা কঠিন গলায় বলল,
তোমার কি মনে হয় আমি মজা করছি? 

আহনাফ অবাক হয়ে বলল, 
আমিও তো মজা করছি না। প্রেগন্যান্সি কীট কিনেছো? 

হুঁ। 

তুমি কিনতে গেলে কেনো? আমাকে বললেই আমি কিনে দিতাম। 

তোমাকে কল করলে তুমি ফোন ধরো? গত তিনদিন ধরে চেষ্টা করছি। রিং হয় অথচ তুমি ধরো না। আজকেও তুমি ফোন ধরবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ ছিল। আচ্ছা, তুমি ফোন কেনো ধরো না? 

আহনাফ সহজ গলায় উত্তর দিল, 
তুমি তো জানো আমি উদাস প্রকৃতির। আমি বাসায় ফোন ফেলেই আবিরদের গ্রামে চলে গিয়েছিলাম। 

অমানিশা চোখ মুখ শক্ত করে বলল, 
আবির ভাইয়ার কাছে তো আমার নাম্বার আছে। উনাকেও আমি অনেকবার ফোন করেছি তোমার খোঁজ নিতে। উনিও ফোন ধরে নি। একটা ম্যাসেজ তো করতে পারো তুমি!

আহনাফ প্রসঙ্গ পালটে বলল, 
আচ্ছা বাদ দাও না। এখন বলো তুমি প্রেগন্যান্ট হলে আমাদের কি করা উচিত? 

অমানিশা লজ্জা পেয়ে বলল,
কি করা উচিত? 

অবশ্যই বিয়ে করা উচিত। - একথা বলে অমানিশার কপাল থেকে চুল সরিয়ে ছোট্ট একটি চুমু খেলো আহনাফ। এরপর অমানিশার ঠোঁটের ওপর ঠোঁট চেপে ধরে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তুই কি আমায় শাসন করার ব্যক্তিগত রাণী হবি? আমার অগোছালো জীবন টা গুছিয়ে দিবি? আমার লক্ষ্মী বউ হবি, অমানিশা? 

অমানিশা ছলছল চোখে আহনাফকে জিজ্ঞেস করল, 
তুমি আমাকে সত্যিই বিয়ে করবে? 

সত্যি, সত্যি, সত্যি! এইতো তিন সত্যি বলে দিলাম। টেস্ট করে রেজাল্ট কি আসে দেখো। এরপর আমরা যত দ্রুত সম্ভব সিদ্ধান্ত নেই। কেমন? আবির আর আমি একটা ব্যবসার পরিকল্পনা করছি। দোয়া করো আমাদের পরিকল্পনা যেন সফল হয়!

অমানিশা আহনাফের লোমশ বুকে মুখ ঘষে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। 
          অমানিশার জীবনে আহনাফের অপর নাম বিশ্বাস। মা-বাবার পরেই আস্থার জায়গাটা বেশ পাকাপোক্ত করে নিয়েছে তেইশ বছর বয়সী টগবগে যুবক। মায়ের রূপের আদল খুঁজে পাওয়া যায় তার নিখুঁত চেহারায়। 

ফর্সা, সুঠাম দেহ। গালভর্তি দাড়ি। এলোমেলো চুল। আহনাফ যেনো উপন্যাসের কোনো নায়কের বাস্তব শিলারূপ। যে অষ্টপ্রহর নিশ্বাস ফেলছে অমানিশার হৃদয়ে। ভুলিয়ে দিচ্ছে জগৎ-সংসার। জমিয়ে দিচ্ছে মস্তিষ্ক। কেড়ে নিচ্ছে ঠিক বেঠিক অনুধাবনের নিপুণতা। এ বয়সে আবেগের সাথে লড়াই করে বিবেকের হার - সে তো সর্বজনীন সত্য! এই সর্বজনীন সত্য হতে অমানিশা কিভাবে ছুটে পালাবে? 

আহনাফ অমানিশার হাতজোড়া ধরে তার ঠোঁটে ঘষতে ঘষতে বলল, 

হাতে মেহেদী দিও। 

কেন?

আহনাফ ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে বলল,
সেকি! মেহেদী ছাড়া বিয়ে হয় নাকি? 

অমানিশা লজ্জা পেয়ে পুনরায় আহনাফের লোমশ বুকে মুখ লুকালো। আহনাফ দুষ্টুমির ছলে বলল, 
এখনো এত লজ্জা? 

অমানিশা কোনো উত্তর দিল না। আহনাফ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, 
আবারো লজ্জা ভাঙ্গিয়ে দেই? 

এই মোটেও না। আজ না, প্লিজ! শরীরটা ভালো লাগছে না। 

অমানিশার এই তুচ্ছ আপত্তি আহনাফের উদ্দেশ্যে 
কোনো প্রভাব ফেলল না। বরং সে উন্মাদের মত আচরণ করতে লাগল। অমানিশার মুখ চেপে ধরল। এই উন্মাদ আহনাফকে সে ভয় পায়। তার শরীরের পুরাতন ক্ষতগুলো আজও শুকায় নি। আহনাফের ঠোঁটে ভালোবাসার চিহ্ন আঁকা তার কাছে যতটা সুখকর, ঠিক ততটাই যন্ত্রণার শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে তাকে অনুভব করা। অমানিশার মনে প্রশ্ন জাগে - এভাবেই বুঝি সকল পুরুষ তার প্রেমিকাকে আদর করে? তবে এই আদরে আনন্দ কোথায়? সুখ কোথায়?  

অমানিশার শরীরে নতুন ক্ষত সৃষ্টি হল। গালে আহনাফের পাঁচ আঙ্গুলের দাগ। গলায় পুরাতন কালসিটে দাগের পাশে নতুন দাগ সুস্পষ্ট!

অমানিশা জানে না, আদরের নাম করে এই বিকৃত মস্তিষ্কের খেলায় তার দেহখানি মুখ্য। এলোমেলো চুলগুলো মুঠোয় ভরে আঘাত করা অসভ্য ফিল্ম গুলোতেই মানায়। সভ্য সমাজে, প্রেমিকার চুলগুলো আলগোছে সরিয়ে সেখানে চুমু খাওয়ার নাম ভালোবাসা। প্রেমিকার দেহ পবিত্র মন্দিরের সমতূল্য। তাকে ছুঁতে শত বছরের সাধনাও যেন অনর্থক। 
সে শরীরে আঘাত করা কোন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ?

অমানিশা গায়ে চাদর টেনে শুয়ে আছে। তার চোখের কোণায় পানি জমে আছে। আহনাফের দৃষ্টি এড়িয়ে চোখের পানি মুছে ফেলল সে। 
 
আহনাফ ঢকঢক করে বোতলের অবশিষ্ট পানি শেষ করে ফেলল। এরপর অমানিশাকে জিজ্ঞেস করল, 
তোমার স্কুল যেন কয়টায় ছুটি হয়? 

পাঁচ টায়। 

সাড়ে চাড়টা অলরেডি বেজে গেছে। জামা কাপড় পরে নাও তাহলে। নাকি? 

অমানিশা ফ্লোর বেডে উঠে বসল। অলস ভঙ্গিতে স্কুল ইউনিফর্ম পরে নিল। আহনাফ ইতোমধ্যে আরো একটি সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে। 
অমানিশা বিরক্তির সুরে বলল, 
এত সিগারেট খেলে চলবে? 

আহনাফ বিরস মুখে বলল,
এখন তো আগের মত খাই না। আগে সারাদিনে তিন প্যাকেট সিগারেট শেষ করে ফেলতাম। আর এখন দিনে এক প্যাকেট শেষ করি। কার জন্য এতকিছু মেনে চলছি? শুধুমাত্র তোমার জন্য। এরপরেও তোমার যত সন্দেহ! 

আমি মোটেও তোমাকে সন্দেহ করছি না। - অমানিশা এগিয়ে গিয়ে আহনাফের গাল ধরল। বলল, আমার তোমাকে নিয়ে অনেক বেশি চিন্তা হয়। এত সিগারেট খেলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। তোমার কিছু হলে আমার কি হবে? 

কি আর হবে? আরেকটা বিয়ে করবে! 

অমানিশার চোখদুটো মুহুর্তেই ভিজে উঠল। আহনাফকে ছাড়া তার জীবন দুঃস্বপ্নের মত। এই যে মাঝেমধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে যায় ছেলেটা! ফোন ধরে না, ম্যাসেজ করে না। প্রথম দিকে দুশ্চিন্তা হত। এখন অমানিশা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আহনাফ উদাস প্রকৃতির। হয়তো একটু দায়িত্বহীনও বটে! তবে অমানিশার বিশ্বাস, তার প্রতি আহনাফের ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র ত্রুটি নেই। 

অমানিশা আহনাফের গালে আদুরে চড় মারল। বলল,
ভুলেও আর কখনো এমন কথা বলবে না। আমি হয় তোমার বউ হব, নয়তো লাশ হব। 

তার কথা শুনে আহনাফ হো হো করে হেসে ফেলল। বলল,
আজকাল প্রচুর বাংলা সিনেমা দেখা হচ্ছে মনে হয়? 

অমানিশা গাল ফুলিয়ে উত্তর দিল, মোটেও না। আচ্ছা শোনো, আমি উঠি এখন। স্কুল ছুটি হওয়ার সাথে সাথে বাসায় উপস্তিত হতে হবে। তোমার হবু শাশুড়ীর কড়া হুকুম। 

ঠিকাছে। - অমানিশার ঠোঁটে আবারো ছোট্ট করে চুমু খেলো আহনাফ। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে অমানিশা আহনাফের কাছ থেকে বিদায় নিল। সদর দরজা লাগানোর আগে আরোও একবার আহনাফকে শক্ত করে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করতে ভুলল না। 

অমানিশা চলে যেতেই আহনাফ ফ্লোর বেডে আয়েশ করে বসল। ম্যাসেঞ্জারে ঢুকে দিশা নামের একটি মেয়েকে নক করল। 
'বাসা খালি। আমার কাছে ই*য়া*বা আছে চার পিস। হবে নাকি আজ রাতে?' 

ক্ষণিককাল পর দিশা নামের মেয়েটি রিপ্লাই করল। 
'কে কে?' 

'তুমি যদি চাও আবিরকে ডাকতে পারি। তুমি ইলিনাকে সাথে আনতে পারো। বা শুধুমাত্র আমরা দুজনই ইঞ্জয় করতে পারি, সারা রাত!'

দিশা নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করল একটি উইংক ইমোজির মাধ্যমে। আহনাফ হেসে ফোন রেখে দিল। সে উত্তর পেয়ে গেছে।

অমানিশার পুরো শরীর প্রচন্ড ব্যাথা করছে। সে কোনোভাবে নিজেকে সামলে একটি রিক্সা ডাক দিল। এরপর বাসার উদ্দেশে রওনা হল। আহনাফদের বাসার সাথে তাদের বাসার দূরত্ব খুব বেশি নয়। মিনিট পাঁচেকের মাঝেই সে পৌঁছে গেল। 

সদর দরজায় বেল বাজার বিচ্ছিরি ক্রিং শব্দ হল। রাহেলা আক্তার খুশিমনে দরজা খুলতে গেলেন। অবশ্যই তার মেয়ে এসেছে। এসময় স্কুল ছুটি হয়। সারাটাদিন বাসা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মেয়ে ঘরে ঢুকলেই বাড়িটা যেন প্রাণ ফিরে পায়। 
দরজার অপাশে অতিরিক্ত ক্লান্ত অবস্থায় মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কে যান রাহেলা। শঙ্কিত গলায় প্রশ্ন করেন,
কি হয়েছে তোর? 

কিছু হয়নি। সারাদিন ক্লাস করে অনেক টায়ার্ড। 

দে, স্কুল ব্যাগটা আমার কাছে দে।
অমানিশা স্কুল ব্যাগ মায়ের দিকে এগিয়ে দিল। রাহেলা এক হাতে ব্যাগ নিয়ে অন্য হাত দিয়ে মেয়ের হাত ধরলেন। কি ব্যাপার? শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি লাগছে! রাহেলার সন্দেহ সঠিক হল যখন তিনি মেয়ের কপালে হাত রাখলেন। আগুন গরম হয়ে আছে পুরো শরীর।

তোর গা তো জ্বরে পুরে যাচ্ছে রে, মা! তাড়াতাড়ি ঘরে আয়। 

রাহেলা অমানিশাকে তার ঘরে নিয়ে গেল। বিছানায় শুইয়ে দিল। বলল, 
তুই শুয়ে থাক। আমি একটু পানি গরম করে নিয়ে আসছি। গা মুছে দেই। জামা পাল্টিয়ে দেই। 

অমানিশা মায়ের এই যত্নটুকু লুফে নিতে চাইছিল। পরক্ষণেই তার মনে হল শরীরের কালসিটে দাগের কথা। সে তড়িঘড়ি করে উত্তর দিল, 
না মা। লাগবে না। আমি নিজেই জামা কাপড় পাল্টে নিচ্ছি। তুমি আমাকে একটা নাপা দাও। 

রাহেলা অস্থির হয়ে বললেন, 
না, আমি গা মুছিয়ে দিচ্ছি। শুধু ওষুধ খেলে হবে না। বেশি বুঝিস না। 

অমানিশা চিৎকার করে উঠল,
বললাম তো গা মুছিয়ে দিতে হবে না। আমাকে ওষুধ দাও তাতেই হবে। সব সময় যন্ত্রণা করো না তো, মা। ভালো লাগছে না। তুমি ঘর থেকে বের হয়ে যাও।

মেয়ের এহেন ব্যবহারে রাহেলার চোখদুটো পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। কোথায় যেন সে শুনেছিল, সন্তানের দুর্ব্যবহারে যদি মায়ের চোখে জল আসে, সেই জল বয়ে আনে অভিশাপ। রাহেলা দ্রুত চোখের পানি মুছে ফেলল। মনে মনে বলল, হে আল্লাহ! আমার সন্তানকে তুমি পৃথিবীর সমস্ত সুখ দান করো। 

অমানিশাও অশ্রুসিক্ত চোখে ঘর থেকে মায়ের প্রস্থান দেখল। সে মায়ের সঙ্গ চাইছে। মায়ের উষ্ণ বুকে একটুখানি জায়গা চাইছে। অথচ পরিস্থিতি তাকে দিন দিন মায়ের থেকে কত দূরে সরিয়ে ফেলছে! 
আগামীকাল সকালে সে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করবে। যদিও এর পরিণতি নিয়ে অমানিশা এখনো অবগত নয়। তবুও হঠাৎ করে অজানা এক ভয় তাকে ঘিরে ধরল। দম বন্ধ হয়ে আসছে অমানিশার। 
আচমকা তার মনে হল, সে বিশাল গভীর সাগরে তলিয়ে যাচ্ছে। এ গভীরতা থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। 
          প্রেগনেন্সি কীট হাতে নিয়ে ধপাস করে বাথরুমের ফ্লোরে বসে পড়ল অমানিশা। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। চারিদিকে যেন অমাবস্যার আঁধার ঘনিয়ে আসছে। স্টিকে লাল টকটকে দুটো দাগ স্পষ্ট। অমানিশার পেটে একটি নতুন জীবনের সম্ভাবনার জানান দিচ্ছে এই দাগ দুটো। 

অমানিশার বিস্ময় সীমা অতিক্রম করেছে। অথচ তার বিস্মিত হবার কথা নয়। এরকম কিছু হতে পারে তা সে পূর্বেই আঁচ করেছিলো। তাও মনের কোথাও হয়তো টিমটিমিয়ে আশার লণ্ঠন জ্বলছিল! অনেক মেয়েরই পিরিয়ড যথাযথ সময়ে হয় না। মাঝেমধ্যে দশ পনেরো দিন লেট হয়। তারও হয়েছে দু এক বার! 

বাথরুমের এক কোণায় জড়োসড়ো হয়ে ক্ষণিককাল বসে রইল অমানিশা। আতঙ্কে মুখখানি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সমাজের আগেও মা-বাবাকে নিয়ে তার চিন্তা। কিভাবে তাদের সামনে নিজের এই নিষিদ্ধ সত্য তুলে ধরবে সে?
তবে এভাবে বসে থাকাও তো সমাধান নয়! আহনাফ তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সে নিশ্চয়ই তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না। 

অমানিশা নিজের ঘরে গেলো। দরজা ভালো করে লক করে, স্কুলব্যাগে লুকিয়ে রাখা নিজের ফোনটি বের করল। ডায়াল করল আহনাফের নাম্বার। স্বভাবমত সে ফোন ধরল না। 
অমানিশা পুনরায় তাকে কল করল। রিং হচ্ছে। কিন্তু আহনাফ ফোন ধরছে না। 

অমানিশা ক্ষান্ত হল না। বিরতিহীন আহনাফের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে গেলো। এক পর্যায়ে একটি সুমধুর নারী কণ্ঠ শোনা গেল_
'আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটিতে সংযোগ প্রদাণ করা সম্ভব হচ্ছে। অনুগ্রহ করে একটু পরে আবার চেষ্টা করুন ধন্যবাদ'। 

অমানিশার চোখদুটো রক্তজবার মত লালবর্ণ ধারণ করল। 

এমন সময় ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। রাহেলার কণ্ঠস্বর শুনতে পাওয়া গেল। 
'এই অমানিশা, দরজা খোল! তোকে না কতবার বারণ করেছি দরজা লক করবি না? তোর বাবাকে বলে দরজার লক আমি ভেঙ্গে দিব এবার।'

অমানিশা দ্রুত নিজের স্কুলব্যাগে মোবাইল এবং প্রেগনেন্সি কীট লুকিয়ে ফেলল। চোখেমুখে কৃত্রিম স্বাভাবিকতার ছাপ এনে দরজা খুলল। 

রাহেলা বিরক্ত হয়ে বললেন,
কেন নিজেকে এভাবে ঘরবন্দী করে রাখিস? শরীরটাও তো ভালো না। মাঝরাতে একবার এসে দেখে গেছি। জ্বর ছিল না। এখন কি অবস্থা দেখি? থার্মোমিটার টা কই যে রাখলাম!
রাহেলা ব্যস্ত হয়ে থার্মোমিটার খুঁজতে খুঁজতে অন্য ঘরে চলে গেলেন।

অমানিশা বিছানায় গা এলিয়ে দিল। তার ঠোঁটদুটো অল্প অল্প কাঁপছে। দুশ্চিন্তায় গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। 

'চোখের সামনে জিনিস থাকে খুঁজে পাইনা। কি রোগ যে ধরল আমাকে!' - হাতে থার্মোমিটার নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে পুনরায় ঘরে ঢুকল রাহেলা। মেয়ের বগলের নিচে যত্ন সহকারে থার্মোমিটার রাখল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বলল, 
তোর শরীর তো এখনো অনেক গরম। আজ আর স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই। 

অমানিশা তার টেবিলের নষ্ট ঘড়িটার দিকে তাকাল। গত তিনদিন ধরে সাতটা পঁচিশ বেজে আছে। 
কয়টা বাজে মা? 

নয়টা। একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। 

কি দুর্ঘটনা?

পাশের বাসার রোদেলা কোন এক হিন্দু ছেলের সাথে যেন পালিয়ে গেছে! আহারে! মেয়েটার জীবন এখনো শুরুই হল না কত বড় ভুল পথে পা বাড়ালো চিন্তা কর? 

অমানিশা কোনো উত্তর দিল না। আলগোছে ঢোক গিলল। 

আমি তোর সাথে ছোটবেলার থেকেই বন্ধুসুলভ আচরণ করেছি। যাতে তুই কখনো ভুল পথে পা না বাড়াস। আমি সবাইকে গর্ব করে বলি, আমার মেয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড আমি! 

মায়ের কথা শুনে অমানিশার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে গেল। মনে মনে চিৎকার করে বলতে লাগল, এ আমি কি করে ফেললাম, মা! তোমার বিশ্বাস আমি খণ্ডবিখণ্ড করে ফেললাম। আমি নিজেকে কোনোদিনও ক্ষমা করতে পারব না। কোনোও দিনও না! 

মেয়ের বগলের নিচ থেকে থার্মোমিটার বের করল রাহেলা। জ্বর ১০১। সে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,

আমি তোর জন্য স্যুপ বানিয়ে আনছি।

অমানিশা নিচু স্বরে বলল,
আমি স্যুপ খাব না। আমার কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। 

লিকুইড কিছু তো খেতে হবেই। জ্বর হলে যত লিকুইড খাবার খাবি তত দ্রুত সুস্থ হবি। স্যুপ ওষুধ ভেবে খেয়ে ফেলবি। এখনকার জ্বর ভালো না। শরীর একদম দুর্বল করে ফেলে। তুই চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক। 

রাহেলা চলে যেতেই অমানিশা পুনরায় দরজা লাগিয়ে দিল। যেভাবেই হোক আহনাফকে প্রেগনেন্সির বিষয়টা জানাতে হবে। 

—————

এলুমিনিয়াম ফয়েলের ওপর ই*য়া*বা ট্যাবলেট রাখল আহনাফ। দিশা ফয়েলের ওপর প্রান্তে লাইটার ধরল। গোলাপি ট্যাবলেটটি গলে যাচ্ছে। সেই বাষ্প বুকভরে নাক দিয়ে গ্রহণ করছে আহনাফ। প্রতি টানে একবার করে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে আসছে 'আহ!'।

এক ফাঁকে সে দিশাকে জিজ্ঞেস করল,
তুমি নিবে না? 
না। আমার আজকের কোটা পূরণ হয়ে গেছে। 
আহনাফ হেসে পুনরায় নেশায় ব্যস্ত হয়ে গেল। 

দিশা আহনাফের বন্ধ ফোনটির দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে জিজ্ঞেস করল, 
মেয়েটা তোমায় এতবার ফোন করল আর তুমি মোবাইল অফ করে রাখলে? 

মুড নষ্ট করার ইচ্ছে নেই আমার। 

গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বললে বুঝি মুড নষ্ট হয়? 

গার্লফ্রেন্ড? - আহনাফের তাচ্ছিল্যভরা হাসি দেখে কপালে ভাঁজ পড়ল দিশার। 

তুমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে দেখেছো? - প্রশ্ন করল আহনাফ।
 
হুঁ।

আমার সাথে ওকে মানায়? 

দিশা মুচকি হাসল। কোনো উত্তর দিল না।
আহনাফ দিশার ঠোঁটের দিকে ঝুঁকে এসে বলল, আমি তো তোমার মত কাউকে গার্লফ্রেন্ড হিসেবে চেয়েছিলাম। একবার পেলে সরাসরি বিয়ের পীড়িতে। 

দিশা আহনাফের ঠোঁটের সাথে নিজের ঠোঁট ঘষে উত্তর দিল, তোমার মত নষ্ট ছেলের সাথে আমি বসব বিয়ের পীড়িতে? নো। নেভার। 

আহনাফ উদাস ভঙ্গিতে বলল,
নষ্টামি করতে আপত্তি নেই অথচ বিয়ে করতে আপত্তি আছে। চমৎকার বিচার তোমার! 

দিশা হেসে বলল, 
আমি জীবনটা ইঞ্জয় করছি। এসব প্রেম ভালোবাসায় জড়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। দাও সিগারেটের প্যাকেটটা দাও। 

আহনাফ সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিতে দিতে উত্তর দিল, আমিও ইঞ্জয় করছি। 

আমার সাথে না অমানিশার সাথে? 

আহনাফ হেসে ফেলল। 
তুমি দেখি ওর নামও জানো।

দিশা ঠোঁটে সিগারেট রেখে অস্পষ্ট স্বরে বলল, 
তোমার গার্লফ্রেন্ড গোটা শহরতলীতে ফেমাস হয়ে যায়। এভাবে মেয়েদের কাছ থেকে টাকা পয়সা নিয়ে আর কতদিন চলবে? 

আহনাফ মুচকি হেসে বলল, যতদিন যৌবন আছে।

দিশা আহনাফের চোখে চোখ রেখে অদ্ভুতভাবে সিগারেট টানতে লাগল। তার চোখেমুখে কামনা। সেই কামনার ছলনায় আরোও একবার ডুবে গেল আহনাফ। 

সকাল গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেলো। অমানিশা হাতে ফোন নিয়ে পড়ে রইল ঘরের কোণে। আহনাফের কোনো খোঁজ নেই। অবশেষে, গোধুলি লগ্নে মোবাইল ভাইব্রেট করে উঠল। 
এক মুহুর্ত সময় নষ্ট করল না অমানিশা। ফোন রিসিভ করেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল। 
সারাদিন কোথায় ছিলে তুমি? 

আহনাফ বাজখাঁই গলায় উত্তর দিল, 
তার কৈফিয়ত কি তোকে দিতে হবে খাংকি মাগি? 

অমানিশার চোখে পানি চলে এলো। সে ভাঙ্গা গলায় বলল, 
তুমি আবারো নেশা করেছো তাই না? 

হ্যাঁ করেছি। এখন কি নেশা করতেও তোর পারমিশন নিতে হবে? 

অমানিশা বলল, 
গত এক মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে আমি তোমাকে সাড়ে সাত হাজার করে টাকা দিচ্ছি আহনাফ। তুমি ডাক্তার দেখাও নি। টাকাগুলো দিয়ে তুমি নেশা করছো, তাই না? 

আহনাফ রাগান্বিত স্বরে বলল, 
মাগি, তুই এখন আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি করছিস? 

অমানিশা এবার কেঁদে ফেলল,
গালাগালি করবে না আহনাফ। আমি এখন তোমার গালি শোনার মত অবস্থায় নেই। 

আমিও তোর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত অবস্থায় নেই। একটা কথা বলছি, মন দিয়ে শোন। আমি তোকে কল না দিলে আমাকে তুই ফোন দিবি না। ক্লিয়ার? 

অমানিশা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
আমি প্রেগন্যান্ট। 

আহনাফ ক্ষণিককাল চুপ করে রইল। এরপর ফোন কেটে দিল। 

অমানিশা আহনাফকে ফোন করার সাহস পেল না।
তার সম্পর্কটা ভীষণ বিষাক্ত। দূর থেকে দেখলে মনে হয় বাকি আট দশটা সম্পর্কের মতই সাধারণ। সন্নিকটে এ সম্পর্ক শ্বাসরুদ্ধকর, অভিশপ্ত। 

হঠাৎ অমানিশার ফোনে একটি ম্যাসেজ এলো। তার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী শিরিন লিখেছে,
তুই নাকি প্রেগন্যান্ট? 

অমানিশা আশ্চর্যান্বিত হল। সে তো তার কোনো বান্ধবীকে এ বিষয়ে বলে নি! তাহলে শিরিন জানলো কিভাবে? 

অমানিশা রিপ্লাই করল, 
তোকে কে বলেছে? 

সাথে সাথে রিপ্লাই এলো, 
তোর প্রেগনেন্সির কথা পুরো স্কুল জানাজানি হয়ে গেছে। 

অমানিশার হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগল। তার মনে হল ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মুনার নাম মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। মুনা আপাদমস্তক কালো বোরখা পরে। স্কুল ইউনিফর্মে প্রেগন্যান্সি কীট কেনা দৃষ্টিকটু বলে অমানিশা তাকে অনুরোধ করে বলেছিল সে যদি কিনে দিত! বোরখার আড়ালেই থেকে যেত তার চেহারা। কিন্তু সে রাজি হয় নি। 

অমানিশা নিজের মাথা ছুঁইয়ে মুনাকে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিল, এবিষয়ে যেন কেউ কিচ্ছুটি জানতে না পারে। 
তবে কি মুনা-ই তার এতবড় সর্বনাশ করল? 
          পরের দিন অমানিশা স্কুলে গেল। গার্লস স্কুলের গেট দিয়ে ঢোকার পরক্ষণেই মনে হল প্রতিটি শিক্ষার্থী ঘৃণ্য চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিষয়টি নিশ্চিত হতে চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল সে। সত্যিই তো! সবাই তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মুচকি মুচকি হাসছে। এক বান্ধবী আরেক বান্ধবীকে ডেকে ইশারায় অমানিশাকে দেখাচ্ছে। কানাকানি করছে। 

স্কুলের এই পরিচিত শরগোলও অচেনা লাগছে। অসহায় অমানিশা এক ছুটে চলে গেল তার ক্লাসরুমে। সীমাহীন সমুদ্রে এক টুকরো দ্বীপ খুঁজে পেতেই যেন তার এই প্রচেষ্টা। এখানেও বিপত্তি তার ছায়াসঙ্গী হয়ে রইল। নিজের ক্লাসের সবাইও বিষদৃষ্টিতে দেখতে লাগল তাকে। অমানিশা ভাবল, হায় হায়! আমার প্রেগন্যান্সি নিয়েই বোধহয় পুরো গার্লস স্কুল আজ সরগরম!

ক্লাসরুমে ঢুকতেই শেষের বেঞ্চে মুনাকে দেখতে পাওয়া গেল। আরবীর সাথে বসে আছে। অমানিশাকে দেখেও সে ভ্রুক্ষেপহীন। সহজ গলায় জিজ্ঞেস করল, 
কিরে গতকাল স্কুলে আসলি না কেন? 

অমানিশা কাঁপা গলায় বলল, 
তোর সাথে আমার কথা আছে। একটু ক্লাসরুমের বাইরে চল। 

আরবীও আসুক। ও একা ক্লাসরুমে বসে থেকে কি করবে? 

অমানিশা কঠিন স্বরে বলল, 
না, তুই একা আসবি। 

আরবী মুনাকে আশ্বস্ত করে বলল, 
তুই যা। সমস্যা কি? 

স্কুলের লম্বা বারান্দার এক কোণায় এসে দাঁড়াল তারা। অমানিশা সরাসরি মুনার চোখের দিকে তাঁকিয়ে প্রশ্ন করল, 
আমার প্রেগন্যান্সির খবর গোটা স্কুল কিভাবে জানল? 

মুনা আকাশ থেকে পড়ল। 
বলিস কি? তুই প্রেগন্যান্ট এটা সবাই জানে? কিন্তু আমি তো কাউকে বলি নি! 

অমানিশার চোখেমুখে সন্দেহ। সে নিচু স্বরে বলল,
আমি প্রেগনেন্সি কীট কিনতে যাচ্ছি এটা তুই ছাড়া আর কেউ জানত না, মুনা! 

মুনা বিস্মিত স্বরে বলল,
তুই আমাকে সন্দেহ করছিস? 

অমানিশা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। বলল,
বিশ্বাসও তো করতে পারছি না। কারণ তুই ছাড়া এবিষয়ে কেউ কিছুই জানত না। 

বিশ্বাসই যখন করিস না, ফ্রেন্ডশিপ রাখার কি দরকার? - অনুযোগের সুরে কথাগুলো বলে মুনা ক্লাসে ফিরে গেলো। 

অমানিশা ভেজা চোখে বারান্দার রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মুনাকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। আবার এতদিনের বন্ধুত্বকে সাগ্রহে অবিশ্বাস করাও দুরূহ। দোটানার মাঝে আবদ্ধ হয়ে রইল সে। 

শিরিন স্কুলে আসলো ক্লাস শুরু হওয়ার ঠিক দশ মিনিট আগে। অমানিশা তখন জানালার পাশের বেঞ্চে বসে শূণ্যদৃষ্টি মেলে আকাশ দেখছিল। শিরিন তার হাত ধরে টানতে টানতে বাথরুমে নিয়ে গেল। 
ব্যস্ত শিরিনকে দেখে শঙ্কিত অমানিশা বলল,
কি হল? এভাবে ক্লাস থেকে বাথরুমে নিয়ে এলি কেনো?

শিরিন নিজের বুকের মাঝে হাত ঢুকিয়ে দিল। অন্তর্বাসের ভেতর থেকে একটি এন্ড্রয়েড ফোন বের করল। গ্যালারি তে ঢুকে একটি ছবি বের করে অমানিশাকে দেখালো। 

ছবিতে আহনাফ এবং আবির দুটো মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সোফায় বসে আছে। 
অমানিশার চোখেমুখে তখনও অবিশ্বাস। সে বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, 
এই ছবি তুই কই পেলি? 
শিরিন ফিসফিস করে বলল, 
মাহাদী গতকাল আমায় ম্যাসেঞ্জারে পাঠিয়েছে। আরোও ছবি আছে। দেখ। 

অমানিশা দেখল আরোও অনেকগুলো মেয়ের সাথে একদম গা ঘেঁষে ছবি তুলেছে আহনাফ। বেশ কিছু ছবি অন্তরঙ্গ মুহুর্তের। ঠোঁটে চুমু খাচ্ছে। গলায় চুমু খাচ্ছে বা অন্য নারীর মুখ থেকে সিগারেটের ধোঁয়া নিচ্ছে!

অমানিশা অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলল। বুকের প্রতিটি জায়গা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে তার। চোখে মুখে সেই যন্ত্রণার পূর্ণবিকাশ দৃশ্যমান। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে বারবার চোখ মুছতে লাগল সে। 

বিষাদগ্রস্ত কণ্ঠে শিরিন বলল, 
আহনাফ তোর সাথে টাইম পাস করছে দোস্ত। ও একদমই তোকে নিয়ে সিরিয়াস না। ওর কাছে তুই শুধুমাত্র একটি ভোগের বস্তু। সোনার খনি। ওই ছেলে নাকি সবসময় পয়সাওয়ালা মেয়েদের সাথে সম্পর্কে জড়ায়। তাদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে। টাকা পয়সা লুফে নেয়। এরপর নষ্ট মেয়েদের সাথে ফূর্তি করে বেড়ায়। একসাথে বসে নেশা করে।

অমানিশা ভাঙ্গা গলায় বলল, 
এসবও কি তোকে মাহাদী বলেছে? 

শিরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, 
আমি জানি দোস্ত। তোর এসব কথা বিশ্বাস হচ্ছে না। প্রথমে আমারোও হয় নি। কিন্তু এই ছবিগুলো তো মিথ্যে না! 

অমানিশা এবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। অপ্রস্তুত শিরিন বুঝল না কিভাবে তাকে সান্ত্বনা দেওয়া যায়! প্রিয় বান্ধবীর কান্না দেখে সেও ছটফট করতে লাগল। 
অস্থির হয়ে বলল, 
প্লিজ দোস্ত কান্না বন্ধ কর! এক্ষুণি ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। 
- গলায় ঝুলানো সাদা স্কার্ফ দিয়ে অমানিশার চোখের জল মুছে দিল শিরিন। 

অমানিশা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
আমি সত্যিই প্রেগন্যান্ট দোস্ত। একথা শোনার পর থেকে আহনাফ আমার ফোন ধরছে না।

শিরিন ক্ষীণস্বরে বলল, 
জানি। তোর এই বিষয়টা পুরো তল্লাটে জানাজানি হয়ে গেছে। আমাকে গতকাল মাহাদীই বলেছে তোর প্রেগনেন্সির কথা।

অমানিশা হেঁচকি তুলে বলল,
দোস্ত, আমার ভীষণ ভয় করছে। আমি এই পরিস্থিতি একা একা কিভাবে সামালাবো? বাবাকে যদি কেউ বলে দেয়? গলায় দড়ি দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় রইল না আমার! 

শঙ্কিত অমানিশাকে আলগোছে জড়িয়ে ধরল শিরিন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ধমকের সুরে বলল, 
একদম বাজে কথা বলবি না। আমি আছি তো! কখনো নিজেকে একা মনে করবি না। আহনাফের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা কর। দেখ কি বলে। আর যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে ম্যাসেজ করবি। ঠিকাছে? 

অমানিশা হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাঁকাল। 
চল, ক্লাসে যাই। দেরি হয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণে মনে হয় স্যার নাম ডাকা শুরু করে দিয়েছেন।- একথা বলে শিরিন অমানিশার হাত শক্ত করে ধরে ক্লাসের দিকে এগোতে লাগল। 

সারাদিন স্কুলে অন্যমনস্ক হয়ে বসে রইল অমানিশা। অনর্থক কথা বলা মেয়েটির স্থিরতা শিক্ষকদের দৃষ্টি এড়ালো না। ক্লাস ক্যাপ্টেনও আজ বিরক্ত। ব্ল্যাক বোর্ডে সাদ চক ঘষে এক নম্বর দিয়ে অমানিশার নামটি সে লিখতে পারেনি। ক্লাসে কথার ফুলঝুরি ছড়ানো মেয়েটি আজ শান্ত, অনুত্তেজিত। অবশ্য এর কারণ তারা ভাসা ভাসা শুনেছে। তবে, সত্য মিথ্যা যাচাই এর বাড়তি সময় তাদের কাছে নেই। 

বাসায় ফিরে অমানিশা পুনরায় আহনাফকে ফোন করল। কোনো সাড়া মিলল না। যদিও সে নিরুৎসাহিত হল না। নতুন উদ্যমে ক্রমাগত আহনাফের নাম্বারে ডায়াল করতে লাগল। এক পর্যায়ে বুঝল আহনাফ ফোন বন্ধ করে ফেলেছে। 
এভাবে আর কতদিন? কোনো একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। অন্তত আজকে আহনাফের ছবিগুলো দেখার পর তাকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। 

অমানিশা ক্লান্ত শরীরে গোসলঘরে ঢুকল। ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে ফ্লোরে বসে রইল অনেকক্ষণ। সম্পর্কের ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগল আহনাফের এমন কোনো ক্রিয়াকলাপ, যার মাধ্যমে প্রমাণ হয় সে তাকে ভালোবাসে। 
দুর্ভাগা অমানিশা, কিচ্ছুটি খুঁজে পেল না।

এই বিষাক্ত সম্পর্কটি টিকে আছে টাকার জোরে। যেদিন আহনাফের টাকার প্রয়োজন পড়েছে সেদিন সে নিজ থেকে অমানিশাকে ফোন করেছে। সারারাত কথা বলেছে।
অথচ অমানিশা ফোন করে কথা বলতে চাইলে গালাগাল ছাড়া মেয়েটির ভাগ্যে আর কিছু জুটে নি। 
আহনাফের সাথে দেখা করতে গেলে রেস্টুরেন্টের বিল অমানিশা দিত। 

মাসখানেক আগে ওয়ালটন তাদের নতুন থ্রিজি সাপোর্টেড মোবাইল লঞ্চ করেছিল। আহনাফ আবদার করেছিল, ফোনটা যেন অমানিশা তাকে কিনে দেয়। এই আবদার অমানিশা ফেলতে পারে নি। মায়ের আলমারির ড্রয়ার থেকে টাকা চুরি করে ফোনটা সত্যিই কিনে দিয়েছিল সে। 

প্রতিদানে আহনাফ তাকে কি দিয়েছে? 
'নষ্টা মাগি' অথবা 'বেশ্যা' বলে গালি! - যা অমানিশার পরিবারের কেউ কোনোদিন ভুলেও উচ্চারণ করে নি। 

অমানিশা গোসল সেড়ে বেরিয়ে এলো। বিশাল বড় একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। সিদ্ধান্তটি ঠিক নাকি বেঠিক তা সে জানে না। এখন আর জানতেও চাইছে না। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে সে শিরিনকে ম্যাসেজ করল,
_'দোস্ত, আমি এবোরশন করতে চাই।'
          জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। দাঁড়িপাল্লার একপাশে আবেক রেখে অপরপাশে বিবেক-কে স্থান করে দিতে হয়। দুটোর অবস্থান সমান হলে আমরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হই, তাকে যুক্তিসঙ্গত মীমাংসা বলে আখ্যায়িত করেন জ্ঞানী ব্যক্তিরা। 
চৌদ্দ অথবা পনেরো বছর বয়সী কোনো মেয়ের মাঝে এই ক্ষমতা নেই। তাই সৃষ্টির সেরা জীব হয়েও নিকৃষ্টতম ভুল করতে একটি মুহুর্তই যথেষ্ট! 

অমানিশার ম্যাসেজ পেয়ে শিরিন তাকে রিপ্লাই করল, 
তুই কি এখন কথা বলতে পারবি? 

অমানিশা প্রত্যুত্তরে লিখল,
পারব। 

শিরিন সাথে সাথে কল করল। অমানিশা কথা বলতে বারান্দায় চলে গেলো। 

ভাগ্যিস! এই মাত্র মা খালার বাসায় গেল, তাই সরাসরি তোকে ফোন করতে পারলাম। - স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল শিরিন। পরক্ষণেই উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করল,
তুই শিওর এবোরশন করবি? 

আর কোনো উপায় নেই, দোস্ত।

আহনাফের জন্য আরেকটু ওয়েট করলে হত না? এবোরশন তুই কেন করবি? এটা কি ওর দায়িত্ব নয়? 

দায়িত্ব? - অমানিশার তাচ্ছিল্যে ভরা হাসি হাসল। বলল, 
যে ছেলে আমার প্রেগনেন্সির কথা শুনে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে, তার কাছ থেকে এসব আশা করাও তো বোকামি! এমনিতেও, এতদিন বোকার রাজ্যেই ছিল আমার বসবাস। মিথ্যা মোহে অন্ধ হয়ে ছিলাম।

শিরিন রূঢ় ভঙ্গিতে বলল,
এত বড় অন্যায় করে ছেলেটা পার পেয়ে যাবে? 

অমানিশার গলা চেপে কান্না এলো। সে ঢোক গিলে জবাব দিল, 
বিষয়টা নিয়ে জালঘোলা করলে আমার নিজের ক্ষতি। আহনাফ হয়তো কখনো আমাকে ভালোবাসে নি। আমি এক তরফা ভালোবেসে নিজের সব হারিয়েছি। আত্মসম্মান, মর্যাদা, সম্ভ্রম। সবকিছু। 

শিরিন চুপ করে রইল। 

জানিস? সেদিন মা গর্ব করে আমায় বলছিল, আমরা নাকি বেস্টফ্রেন্ড! আমি তাকে না জানিয়ে কিছু করি না - বিষয়টি নিয়ে সে ভীষণ প্রাউড ফিল করে। আমি আমার মায়ের সামনে কিভাবে দাঁড়াব দোস্ত? - কথাগুলো বলতে বলতে অমানিশা কেঁদে ফেলল। 

শিরিন কাতরস্বরে বলল, 
তুই প্লিজ কাঁদিস না, অমা। আমি আছি তো তোর সাথে। কেউ আর কিচ্ছু জানতে পারবে না। তুই এবোরশন করে ফেল। কিন্তু কোথায় করবি? 

জানি না। এত ছোট্ট একটা মফস্বল শহর। তার ওপর বাবাকে আবার সবাই চিনে। শহর থেকে একটু দূরে কোনো ক্লিনিকে যেতে হবে। - দীর্ঘশ্বাস ফেলল অমানিশা।

শিরিন চিন্তিতস্বরে বলল,
কিন্তু শুধুমাত্র তোর আর আমার যাওয়াটা তো বেশ রিস্কি! বড় কেউ সাথে থাকলে ভালো হত। 

কাকে বলব আর? পরিবারের বাইরে এমন পরিচিত কেউ আমার নেই।

দুজনেই বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। আচমকা শিরিন উত্তেজিত হয়ে বলল, 
দোস্ত, আরবির একজন খালা আছেন ডাক্তার। শহর থেকে একটু দূরে সরকারি একটি ক্লিনিকে বসেন। উনার সাথে যোগাযোগ করলে হয় না? 

আমি তো আরবিকে এ বিষয়ে কিছুই জানাই নি। 

শিরিন বলল,
আগামীকাল স্কুলে ওর সাথে কথা বলে দেখতে পারিস। আমি যতদূর জানি ওর খালা এজাতীয় কেসগুলোই দেখে। পরিচিত কেউ থাকাটা অনেক জরুরি। তুই যদি বলিস আমিও কথা বলতে পারি ওর সাথে। 

অমানিশা বলল,
না তোর বলার দরকার নেই। আমি আগামীকাল স্কুলে ওর সাথে কথা বলব। 

তুই খাওয়া দাওয়া করিস ঠিকমতো, দোস্ত। দেখিস, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। 

এসময় অমানিশার ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। সে ফিসফিস করে বলল,
দোস্ত মা আসছে মনে হয়। আমি রাখছি। আগামীকাল স্কুলে দেখা হবে। 

অমানিশা ফোন লুকিয়ে দরজা খুলতে গেল। রাহেলা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে মেলামাইনের প্লেট। তাতে পাঁচ পিস আলুর চপ।
রাহেলা ধমকের সুরে বলল,
দরজা লাগিয়ে নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখার স্বভাব কি তোর যাবে না? তোর জন্য বেশি করে কাচামরিচ দিয়ে আলুর চপ বানিয়েছি। জ্বরের কারণে তো মুখ নষ্ট হয়ে আছে তোর। সস মাখিয়ে খা। ভালো লাগবে। 

মায়ের দিকে অসহায় অমানিশা তাকিয়ে রইল ক্ষণিককাল। এরপর শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরল। ঘটনার আকস্মিকতায় অবাক হল রাহেলা। বুকটা অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল। 
অজ্ঞাত বিপদের আশঙ্কায় গত কয়েক রাত নির্ঘুম কেটেছে রাহেলার। চোখের পাতাজোড়া এক করলেই ভয়ংকর যতসব দু:স্বপ্ন দেখছে সে। সামনে কোনো বিপত্তি তো অবশ্যই আছে, এবিষয়ে রাহেলা নিশ্চিত। কিন্তু এর পরিধি ঠাহর করা যাচ্ছে না। সারাক্ষণ আল্লাহর নাম জপছেন রাহেলা। 

কি হয়েছে মা, তোর? শরীর খারাপ লাগছে? কেন স্কুলে গেলি? শরীর তো এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয় নি!- রাহেলার শঙ্কিত গলা শুনে নিজেকে সামলে নিল অমানিশা। 
স্বাভাবিকভাবে বলল,
কিছু হয় নি মা। অনেকদিন তোমায় জড়িয়ে ধরি না। তাই আজকে ধরলাম। দাও চপ খাই। 

প্লেট থেকে একটি চপ নিয়ে খেতে লাগল অমানিশা। রাহেলা মেয়ের নিষ্পাপ মুখের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। তার মেয়েটা শ্যামলা। মাথার কোকড়া চুলগুলো পিঠ স্পর্শ করতে না করতেই কেমন যেন রুক্ষ হয়ে যায়। ঠোঁটের চারিপাশে কালো। অমানিশা তার মায়ের রূপের এক ছটাকও পায় নি! 
সে যদি কোনো হতদরিদ্র ঘরে জন্মাতো, বিয়ে দিতে বড় ভুগতে হত। 
সৌভাগ্যক্রমে, রাহেলার স্বামীর অঢেল টাকা-পয়সা! একথা ভেবে মুচকি হাসল সে। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে আলগোছে স্বস্তির শ্বাসও ফেলল। 

পরদিন স্কুল ছিল হাফ ডে। ছুটির পর অমানিশা আরবির কাছ থেকে তার ডাক্তার খালার নাম্বার নিয়ে নিল। আকুল স্বরে বলল,
দোস্ত, কেউ যেনো জানতে না পারে!

আরবি তাকে আশ্বস্ত করে বলল, 
কেউ জানতে পারবে না৷ তুই আজই গিয়ে খালামণির সাথে যোগাযোগ কর। বেশি দেরি করা উচিত হবে না। 

অমানিশা মাথা ঝাঁকিয়ে সহমত পোষণ করল। করুণভাবে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করল, আমার ভীষণ ভয় করছে আরবি। 

ভয় পাস না। খালামণি অনেক ভালো। তিনি খুব যত্ন নিয়ে কাজ করেন। তবে তুই বাসায় গিয়েই আবার খালামণিকে ফোন করিস না। আমি আগে তাকে পুরো বিষয়টা জানিয়ে নেই। 

পুরো পরিস্থিতি জানাবি বলতে?

আরবি খানিকটা ইতস্তত করে বলল,
যদি হিস্ট্রি জানতে চায় তখন কি বলব? 

বলবি যে এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে। তাই এবোরশন করছি। শেষ। 

আহনাফের কথা বলব না? 

না। দরকার নেই। আমার আর শিরিনের সাথে তুইও কি যাবি সেদিন? 

আরবি তড়িৎ গতিতে উত্তর দিল, না না! আমি এসবে জড়াতে চাই না। 

অমানিশা ফ্যাকাসে হেসে বলল,
আমি এমনেই জিজ্ঞেস করেছি। তোকে এসবের মাঝে জড়ানোর ইচ্ছা আমারো নেই রে! হেল্প যে করলি এইতো ঢের বেশি। থ্যাংক্স রে। - কথাটা বলে আরবিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে। এরপর বিদায় নিয়ে স্কুলের মেইন গেটের দিকে অগ্রসর হল অমানিশা। আরবি অনেকক্ষণ চেয়ে রইল তার প্রস্থানের পথে। অস্ফুট স্বরে মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এলো, 
আহারে! বেচারি। 

বাসায় ফিরে অমানিশা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। কখন আরবির খালামণির সাথে কথা বলতে পারবে। 
সময় যেন ফুরোতেই চাইছিল না। বিয়ের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী আহনাফকে হঠাৎ করেই প্রচন্ড ঘৃণা করতে শুরু করেছে অমানিশা। যে লোমশ বুকে লজ্জায় মুখ লুকাতো, সেই বুকের প্রতি বিতৃষ্ণা কাজ করছে আজ। 
অমানিশা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিজের গায়ের কালসিটে দাগগুলো আজ বড্ড পীড়া দিচ্ছে তাকে। শরীরের যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে আহনাফের গন্ধ লেগে আছে, সেসব জায়গা ধ্বংস হয়ে যাক - এমন প্রত্যাশার শরনাপন্ন হল অমানিশা। 
এ জীবন আজ তার অনর্থক বলে মনে হচ্ছে। অর্থহীন মনে হচ্ছে তার প্রতিটি নিশ্বাস।
          নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মত অযৌক্তিক চিন্তা ভাবনাও অমানিশাকে ঘিরে ধরছে বারবার। রণক্ষেত্র থেকে পালানোর পথ তবুও থাকে। কিন্তু জীবনই যখন রণক্ষেত্রের অনুরূপ, তখন মৃত্যু ছাড়া বাঁচার পন্থা কই? 

অমানিশা ঘড়ির দিকে তাকাল। প্রতিটি মুহুর্ত যেন বছরে পরিণত হয়েছে তার। কাটা কবুতরের মত ছটফট করতে করতে আরোও একটি রাত পারি দিল সে। 

পরের দিন দুপুরবেলা। 
পূর্ব দিকের জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বিছানায় বসে আছে অমানিশা। শরীরটা আজ বড় দুর্বল তার। খেতে পারছে না। পেটে কিছু পড়লেই বমি হচ্ছে। গায়ে পুনরায় জ্বর জ্বর ভাব। হাতের ফোনের দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সে। আহনাফকে সকাল থেকে প্রায় বিশ বারের মত ফোন করেছে। কোনো রেসপন্স নেই। 

এমন সময় অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে ফোন আসল। কপালে ভাঁজ পড়ল অমানিশার। কল রিসিভ করে চুপ করে রইল। 

অপরপাশ থেকে একজন মধ্যবয়সী মহিলার কণ্ঠ শোনা গেল।
হ্যালো? অমানিশা বলছো? 

জ্বি। আপনি কে? - কপালে ভাঁজ রেখেই উত্তর দিল সে। 

আরবির সুরভী খালা বলছিলাম, মা। ভালো আছো? 

অমানিশা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আন্তরিকতার সাথে সালাম জানাল। হাসার চেষ্টা করে বলল,
জ্বি খালামণি। আপনি ভালো আছেন?

ড. সুরভী বললেন,
আলহামদুলিল্লাহ। তোমার কথা শুনলাম আরবির কাছে। তুমি এবোরশন করতে চাইছো। তুমি বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছো তো, মা? 

জ্বি খালামণি। আসলে বয়স অল্প তো। নিজেদের অজান্তেই এরকম একটা ভুল হয়ে গেছে। তাই এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছি। - খানিকটা ইতস্ততভাবে উত্তর দিল অমানিশা। 

বুঝতে পেরেছি। 

এবোরশন করতে কেমন খরচ হতে পারে খালামণি? 

ক্ষণিককাল চুপ থেকে ড. সুরভী বললেন, 
শুনো, মা। তোমার বয়স অনেক কম। এরকম আর্লি প্রেগনেন্সিতে এবোরশন করা বেশ রিস্কি। তুমি কি বুঝতে পারছো আমার কথা?

জ্বি, খালামণি। 

আমাদের খুব সাবধানে আগাতে হবে। - উদ্বেগের সাথে বললেন ড. সুরভী। 

তাহলে এ অবস্থায় আমরা কি করতে পারি? - কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করল অমানিশা। 

ড. সুরভী হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
বাচ্চার বাবা কি বলে? সেও তোমার সিদ্ধান্তের সাথে একমত?

প্রশ্ন শুনে অমানিশার বুকের ভেতরে যেন ঝড় বয়ে গেল। দুমড়ে মুচড়ে গেল সব। সে কিভাবে ড. সুরভীকে বলবে প্রেগনেন্সির কথা শুনে আহনাফ তার সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত করছে না! সে হয়ত নেশা করে অন্য নারীর শরীরে ডুবে আছে। এ যাত্রায় তাকে মিথ্যা বলতে হবে। 
অমানিশা কান্না গিলে বলল, 
না, খালামণি। ও আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। বার বার বলছে আমি যেন বাচ্চাটা রাখি। কিন্তু আমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আমি এবোরশন করতে চাচ্ছি। 

ওহ! বুঝতে পেরেছি। এ বয়সে বাচ্চা হওয়া বা এবোরশন করা দুটোই ঝুকিপূর্ণ। বুঝেছো, মা? তুমি সাত হাজার টাকার মত হাতে রাখো। 

ঠিকাছে খালামণি। কেমন সময় লাগতে পারে? - জানতে চাইল অমানিশা। 

ড. সুরভী বললেন,
সারাদিন লাগবে। সকাল বেলা চলে এসো। একটা ইঞ্জেকশন 
দিয়ে এবোরশন প্রসেস শুরু হবে। ব্লিডিং শুরু হলে অবজারভেশনে রাখতে হবে। বিকাল পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সন্ধ্যার আগ দিয়ে তোমাকে ছেড়ে দিব। 

আচ্ছা। আমি আপনাকে জানাবো। 

বেশি দেরী করো না। যত দেরী করবে বিষয়টা তত জটিল হবে। বুঝেছো? 

জ্বি। আমি আগামীকালকের মধ্যেই আপনাকে জানাবো। 

ঠিকাছে, মা। ভালো থাকো। 

সালাম জানিয়ে ফোন রেখে দিল অমানিশা। পুনরায় জানালায় মাথা ঠেকিয়ে সুনীল আকাশের দিকে তাকাল সে। এই অলস দুপুরেও আকাশে একটি ঘুড়ি উড়তে দেখা গেলো। পাশের মেহগনি গাছটায় বসে নাম না জানা একটি পাখি বিরামহীন ডাকছে। অমানিশা আপনমনে ভাবছে, আকাশে উড়তে থাকা ঘুড়ি আর ওই মেহগনি গাছের পাখিটির মত সেও আজ একা। এই লড়াই একান্তই তার নিজের লড়াই। আর সে মোটেও হার মানবে না। 

আহনাফ টং এ বসে চা খাচ্ছে। অবশ্য সে একা নয়। আবির আছে তার সাথে। 
এই মামা, আরেকটা গোল্ডলীফ দিও তো! - টং এর মামার কাছে আগ্রহভরে সিগারেট চাইল আহনাফ। 

আবির চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, 
রাফি ফোন করেছিল সকালে। 

কি বলল?

নতুন জিনিস আনছে চিটাগাং থেকে। সেই কড়া মাল নাকি! 

পার পিস কত করে চাচ্ছে? 

৫৫০ টাকা করে। 

মামা সিগারেট লন। - টং এর মধ্যবয়স্ক লোকটি সিগারেট এগিয়ে দিল আহনাফের দিকে। আহনাফ ঠোঁটে সিগারেট রেখে লাইটার ধরল। সিগারেট জ্বালিয়ে বিশাল বড় একটি সুখটান দিয়ে বলল, 
কয় পিস নিতে চাস? 

আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
নিতে চাইলেও উপায় নেই। আমার পকেট একদম ফাঁকা। 

কেন তোর ফুলটুসি কই? তাকে একটু বল পকেটটা ভরিয়ে দিতে। 

মা বাবার সাথে সিলেট ট্যুরে গিয়েছে। তোরটাকে বললেও তো পারিস। ওইটা তো আপাদমস্তক টাকার খনি। 

আহনাফ বিরক্তি নিয়ে বলল, 
আর বলিস না বাল! অঘটন তো একটা হয়ে গেছে। 

আবির আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
কি অঘটন? 

মাগীটা প্রেগন্যান্ট হয়ে বসে আছে। 

বলিস কি? কনগ্রেচুলেশন দোস্ত। বিয়ে করে ফেল! 

আহনাফ আবিরের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। 

আরে চেতিস না দোস্ত। মজা করছিলাম। - আহনাফের পিঠ চাপড়ে স্বাভাবিকভাবে বলল আবির। জিজ্ঞেস করল,
এখন কি করবি? 

কি করব বুঝতে পারছি না। দিন নাই রাত নাই ননস্টপ ফোন দেয়। ইগ্নোর করছি। মোবাইল অফ করে রেখে দেই। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? 

তাহলে কি রাফিকে মানা করে দিব? - করুণস্বরে জিজ্ঞেস করল আবির। 

না। আগেই কিছু বলিস না। আমাকে একটু ভাবতে দে। দেখি কি করা যায়। চিটাগাং এর জিনিস তো এমনেই পাওয়া যায় না।

আবির কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
তুই যে নতুন একটা মেয়ের সাথে কথা বলছিস না?

আহনাফ গর্বিত ভঙ্গিতে বলল,
অনেকগুলোর সাথেই তো বলছি। মেয়ের অভাব আছে নাকি?

ক্লাস এইটে পড়ে একটা আছে না? 

ওহ! মাহির কথা বলছিস? 

হ্যাঁ, মাহি। মেয়েটার নাম শুধু ভুলে যাই। ওর কাছ থেকে নেওয়া সম্ভব না? 

আহনাফ বলল,
উহুঁ। মাত্র কয়েকদিন হল কথা বলছি। এখনি টাকা পয়সা চাওয়া যাবে না। 

তাহলে কিভাবে ম্যানেজ করবি? 

সিগারেটে শেষ টান দিয়ে আহনাফ বলল,
করে ফেলব কোনো ভাবে বা না কোনো ভাবে। তুই এক কাজ কর। ১০ পিস রেখে দিতে বল। আর চেষ্টা কর পার পিস ৫০০ টাকায় ফিক্সড করতে। পারবি না? 

আবির মুচকি হেসে বলল, 
আবার জিগায়। এখন তাহলে তোর বাসায় চল? আরেকটা জিনিস আছে।

কি জিনিস? 

আবির পকেট থেকে একটা পলিথিন অর্ধেক বের করে আবার ঢুকিয়ে ফেলল। 
আহনাফ ফিঁক করে হেসে উচ্চস্বরে গান ধরল, 
গাজার নৌকা পাহাড়তলী যায়, ও মীরাবাঈ...
গাজার নৌকা পাহাড়তলী যায়।

মফস্বল শহরে নতুন একটি সুপারশপ খুলেছে। রাহেলা তৈরি হয়ে নিলেন। তিনি এখন স্বামীর সাথে সুপারশপে যাবেন। বের হওয়ার আগে একবার অমানিশার ঘরে গেলেন। তার মেয়েটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সারাদিন ঠিকমতো কিছু খেতে পারে নি। তিনি মেয়ের কপাল ছুঁয়ে দেখলেন। তাপমাত্রা স্বাভাবিক আছে। রাহেলা আদুরে গলায় ঘুমন্ত অমানিশাকে ডাকলেন,
মারে, ও মা! আমি আর তোর বাবা একটু বাইরে যাচ্ছি। 
অমানিশা চোখ পিটপিট করতে লাগল। 
ঘুমজড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, 
কোথায় যাচ্ছো তোমরা? 

ওই যে নতুন সুপারশপ হল। ওখানেই যাচ্ছি। কিছু জিনিসপত্র কিনে আনি। তোর জন্য কি আনব? 

চকলেট নিয়ে এসো। 

আচ্ছা। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে এসে ঘুমা। 

চলো। 

অমানিশা দরজা লাগিয়ে দিয়ে সোজা মায়ের ঘরে চলে এলো। আলমারিতে চাবি ঝুলছিল। তার চোখদুটো চিকচিক করে উঠল। এইতো সুযোগ! টাকার ব্যবস্থা এক্ষুনি করতে হবে।
আলমারির দ্বিতীয় ড্রয়ারে পঞ্চাশ হাজার টাকার একটি বান্ডেল পাওয়া গেল। অমানিশা সেই বান্ডেল থেকে গুনে গুনে দশ হাজার টাকা নিয়ে নিল। 
নিজের জন্য কখনো সে একটা টাকাও চুরি করেনি। প্রয়োজন পড়েনি। কারণ, তার জীবনে একজন জাদুকর আছেন। অমানিশার যখন যা দরকার হয়েছে, চাওয়া মাত্রই তার সামনে তা হাজির করেছে। 
আর সেই জাদুকর হল অমানিশার বাবা, মুশফিক আহমেদ। 
          একজন মেয়ের জীবনে তার বাবার ভূমিকা জাদুর চেরাগের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। বায়না করতেই যত দেরি তবে পেয়ে যাওয়ার মাঝে সময়ের অপচয় নেই। অমানিশা সন্তপর্ণে নিজের স্কুলব্যাগের ফিজিক্স বইয়ের ভাঁজে চকচকে টাকাগুলো লুকিয়ে ফেলল। তার দীর্ঘশ্বাসগুলো বন্দি হয়ে রইল চার দেয়ালের মাঝে। কেউ দেখল না, কেউ বুঝল না। অমানিশার প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসে মিশে আছে অপরাধবোধ। 

এই অপরাধবোধ মানুষকে বেপরোয়া করে তুলে। কলুষিত হৃদয়ও টের পায় অসম্ভব যন্ত্রণা। এ যন্ত্রণা হয়ত মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়েও ঢের বেশি। তাই অমানিশা হাউমাউ করে কাঁদছে। মুখে বালিশ চেপে ধরে সে কি আর্তচিৎকার! প্রকৃতি যেন থমকে গেছে সেই চিৎকারে। বাতাসে কামিনীর সুবাস নেই।আকাশের চাঁদও অনুজ্জ্বল। শুধু গাছের পাতাগুলো বোধহয় ঝিরিঝিরি ছন্দ তুলে সহানুভূতি দেখাতে চাইছে অমানিশাকে। 

কাঁদতে কাঁদতে যখন কণ্ঠ ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম, ঠিক তখন ফোন বেজে উঠল অমানিশার। ঝাপসা চোখে দেখল স্ক্রিনে আহনাফের নাম সুস্পষ্ট। কৌতূহল সীমা অতিক্রম করল অমানিশার। কপাল কুঁচকে ফোন রিসিভ করল সে। 
হ্যালো? 

অপরপক্ষ নি:শ্চুপ। 

আরোও একবার নিচুস্বরে বলল,
হ্যালো? 

এবার কারো ফুঁপিয়ে কাঁদার ক্ষীণ আওয়াজ পাওয়া গেল। 
অমানিশার বুকটা ধক করে উঠল। তবে মুখে কিছু বলল না। 

আহনাফ কানতে কানতে বলল, 
আব্বুকে সেদিন রাতে হসপিটালে নিয়ে যেতে হয়েছে, নিশা। তাই তোমার সাথে আর যোগাযোগ করতে পারিনি। 

অমানিশাকে একরাশ চিন্তা ঘিরে ধরল। কিন্তু তার কণ্ঠে তা প্রকাশ পেল না। সে অনেকটা অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞেস করল,
কেন কি হয়েছে উনার? 

আব্বু সুইসাইড এটেম্পট করেছে। নিজেকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল সে। 

কিভাবে? 

তুমি তো জানো আব্বুকে প্রতিদিন রাতে ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে হয়। আম্মু ওষুধের বাক্সটা উনার বালিশের পাশে রেখে কোনো এক কাজে রান্নাঘরে গিয়েছিলেন। ঘরে ফিরে দেখেন দুটো ঘুমের ওষুধের পাতা একদম খালি! আব্বু নিজেকে শেষ করে ফেলতে চেয়েছিল। - আহনাফ এবার গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগল। 

অমানিশা ঢোক গিলে বলল, 
আমাকে একটা ম্যাসেজ করা যেত। যোগাযোগ কেন বন্ধ করে দিয়েছিলে? 

আহনাফ অনুযোগ মিশ্রিত গলায় বলল,
কিভাবে যোগাযোগ করব অমানিশা? সে রাতে বাবাকে নিয়ে হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে যাই। আই সি ইউ তে নিতে হয়েছিল তাকে। ওয়াশ করাতে হয়েছে। নিশ্বাস নেওয়ার সময় পাচ্ছিলাম না। মা বার বার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন। তুমি ভাবতেও পারছো না আমি কিসের মাঝে ছিলাম। 

অমানিশা চুপ করে রইল। কোনো উত্তর দিল না। 

আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না তাই না? - কৃত্রিম হাসি হেসে জিজ্ঞেস করল আহনাফ। এক কাজ করি, মায়ের সাথে তোমাকে কথা বলিয়ে দেই। তুমি বরং তাকেই জেরা করে দেখো। যদিও মা এখনো ট্রমাটাইজড। তোমার প্রশ্ন তাকে বড় পীড়া দিবে। তবুও আমি আমার ভালোবাসার জন্য যেকানো কিছু করতে রাজি আছি। অন্তত, তোমার বিশ্বাসের জায়গাটা পোক্ত হোক!

এপর্যায়ে অমানিশার মন আহনাফের মিথ্যার আঁচে মোমের মত গলতে শুরু করল। কোনো ছেলে আর যাই করুক, মিথ্যের মাঝে তার মাকে জড়াবে না। এই আশ্বাসটুকু অমানিশাকে পুনরায় বাধ্য করল আহনাফের মিথ্যাকে সত্য বলে গ্রহণ করতে। সে ব্যথিত গলায় জিজ্ঞেস করল,
এখন কেমন আছেন আংকেল? 

বেঁচে আছেন। ডাক্তার অনেকগুলো ওষুধ দিয়েছে। সেসব কিনতে গিয়ে আম্মুর হাত ফাঁকা। জানো নিশা? বাসার গ্যাসের লাইট কেটে দিয়েছে। কয়েকমাস ধরে বিল দিতে পারি না। মা এমাসে একবারে বিল দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তা সম্ভব হল না। বাবার পিছে সব টাকা খরচ হয়ে গেল। মানুষের বাসায় গিয়ে রান্না করতে হচ্ছে। - আহনাফ আবারো ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। কাঁপা কণ্ঠে আরোও যোগ করল,
মাঝে মাঝে মনে হয় আমি মরে যাই। ছেলে হয়ে মা বাবার জন্য কিচ্ছু করতে পারছি না। আমার জন্ম কেন হয়েছিল বলতে পারো? জীবনটা অভিশপ্ত বলে মনে হয়। 

অমানিশা আহনাফকে আশ্বস্ত করে বলল, 
খামোখা এসব অর্থহীন কথা বলো না। তোমাকে বহুদিন বাঁচতে হবে। আংকেল আন্টির জন্য হলেও বাঁচতে হবে। বুঝেছো? 

শুধু আম্মু আব্বুর জন্য বাঁচতে হবে? তোমার জন্য বাঁচতে হবে না? আমাদের বাবুর জন্য বাঁচতে হবে না? উত্তর দাও? - অনুনয়ের সুরে জিজ্ঞেস করল আহনাফ। 

অমানিশা কাঁপা গলায় বলল, 
তোমার সাথে অনেকগুলো মেয়ের ছবি দেখলাম। ক্লোজ অবস্থায়। মেয়েগুলো কে? 

আহনাফ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে জিজ্ঞেস করল, 
আমার ছবি? 

অমানিশা সহজ গলায় বলল,
হ্যাঁ। একসাথে বসে নেশা করছো। গলায়, ঘাড়ে, ঠোঁটে চুমু খাচ্ছো, মুখ থেকে সিগারেটের ধোঁয়া নিচ্ছো এজাতীয় ছবি। 

আহনাফ স্বাভাবিকভাবে বলল,
তোমার সাথে আমার যখন সম্পর্ক হয়, একটা কথা বলেছিলাম মনে আছে? 

কি কথা? 

আমি মানুষটা অনেক খারাপ। জঘন্য। কিন্তু তোমার জন্য আমি সব ছাড়তে চাই। কি বলেছিলাম? 

হুঁ। 

আমি প্রচুর নেশা করতাম, অমানিশা। গাঁ*জা, ই*য়া*বা, ম*দ আমার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিল। কিন্তু তুমি আমার জীবনে আসার পর আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করছি। এখন যদি আমার অতীত নিয়ে আমায় খোঁচাও, আমি কিভাবে পাল্টাবো বলো? - রূঢ় গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল আহনাফ। 

আমি তো তোমায় খোঁচা মারি নি! একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি। 

এসব ছবি তোমাকে কে দেখিয়েছে? শিরিন? 

নাম বলব না। 

শিরিন ছাড়া আর কেউ না আমি জানি। ও তো মাহাদীর সাথে প্রেম করে। মাহাদীর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো না। ওই এসব ছড়িয়ে বেড়ায়। 

অমানিশা চুপ করে রইল। আহনাফ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জিজ্ঞেস করল, 
আচ্ছা, এখন বলো আমাদের বাবু কেমন আছে? আমার বউয়ের শরীরও বা কেমন? 

আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আহনাফ।

কি সিদ্ধান্ত? 

আমি এবোরশন করব।

কি? - বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করল আহনাফ। 
অবশ্যই তুমি এবোরশন করবে না। তোমার পেটের বাচ্চা শুধু তোমার একার নয়। আমারোও বাচ্চা। তুমি একা সিদ্ধান্ত নিতে পারো না। 

অমানিশা স্বাভাবিক গলায় বলল, 
তোমার সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছিলাম। ব্যর্থ হয়েছি। তাই আমি নিজে ডাক্তারের সাথে কথা বলে এবোরশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। টাকাও ম্যানেজ করে ফেলেছি। 

ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা আহনাফের চোখদুটো চিকচিক করে উঠল। সে আগ্রহের সাথে জানতে চাইল,
কত টাকা? 

দশ হাজার। 

তুমি আগামীকালকেই ওই টাকা আমাকে দিয়ে দিবে। আমি তোমাকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করতে পারছি না। তোমার কাছে টাকা থাকলে তুমি আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলবে। 

অমানিশা ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
এসব কি বলছো তুমি? 

ঠিকই বলছি। আগামীকাল আমাকে পুরো দশ হাজার টাকাই দিয়ে দিবে। 

তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে? 

বিয়ে করার প্ল্যান ছিলো। কিন্তু বাবার এই অবস্থায় বিয়ে করা কিভাবে সম্ভব বলো? 

বিয়ে করা সম্ভব না, আবার এবোরশন করতে দিবে না! মাথা ঠিক আছে তোমার? 

আচ্ছা তোমার যদি এবোরশন করতেই হয়, আমি নিয়ে গিয়ে করাবো। তুমি একা গিয়ে করতে পারবে না। 

কিন্তু আহনাফ! - অমানিশা কিছু একটা বলতে চাইছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে আহনাফ বলল,
প্রথমবারের মত বাবা হতে যাচ্ছিলাম। পরিস্থিতির জন্য তাকে দুনিয়ার আলো দেখাতে অক্ষম আমি। অত্যন্ত তার মৃত্যুর সময়টায় আমাকে কাছে থাকতে দাও, নিশা! আমি অনুরোধ করছি। 

আহনাফের কথা শুনে নিজেকে আর শক্ত রাখতে পারল না অমানিশা। কেঁদে ফেলল। বলল, 
ঠিকাছে, তুমি যা বলবে তাই হবে। কিন্তু আমায় কথা দাও, কখনোই এভাবে যোগাযোগ ছাড়া থাকবে না আর? 

কথা দিলাম, বউ আমার! - আদুরে স্বরে বলল আহনাফ। 

তাহলে আমরা কিভাবে আগাবো এখন? - চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করল অমানিশা৷ 

আমার এক ফুপাতো বোন আছে ডাক্তার। আমি ওর সাথে কথা বলে তোমাকে জানাবো কেমন? 

ঠিকাছে। 

আই লাভ ইউ, বউ। 

আই লাভ ইউ টু। 

আমাদের বাবুটাকেও জানিয়ে দিও, পাপ্পা লাভ হিম অর হার সো মাচ। 

অমানিশা ভেজা চোখে হাসল। ফোন কেটে দিয়ে স্বস্তির শ্বাসও ফেলল। শুধু শুধু অতিরিক্ত চিন্তা করছিল সে! আর শিরিনেরও বলিহারি যাই। ছবিগুলো এভাবে দেখানোর কি আছে? মানুষের অতীত থাকতেই পারে। সেখান থেকে ফিরে আসাটাই মুখ্য। আহনাফ, তাকে ভালোবাসে। সেও আহনাফকে ভালোবাসে। এই চরম সত্যকে ঠেকাবে কার সাধ্য? 
          পরেরদিন অমানিশা আর স্কুলে গেলো না। অসুস্থতার বাহানায় বাসায় রয়ে গেলো। দুপুরে যখন রাহেলা ঘুমাচ্ছিল ঠিক সেসময় আহনাফ এলো অমানিশার সাথে দেখা করতে। 

বাসার সামনে ছোট্ট একটি গলি আছে। সেই গলি দিয়ে কিছুটা পথ হাঁটলে বামদিকে একটি পঁচা পাগাড়ের দেখা মিলে। সেখানে দাঁড়িয়েই আহনাফ অপেক্ষা করছিল। 

অলস দুপুর। খাবারের পর্ব চুকিয়ে প্রায় সবাই বিশ্রাম নিচ্ছে। কারেন্টের তারে বসে কাকগুলোও ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঝিমাচ্ছে।  
অমানিশা নিঃশব্দে বাসা থেকে নেমে আহনাফের কাছে চলে গেলো। সৌভাগ্যক্রমে, পরিচিত কারো সাথে পথে দেখা হলো না। 

পাগাড়ের পাশে বেশ কয়েকটি পরিত্যক্ত টিনের ঘর রয়েছে। বড় বড় গাছে ঘেরা এই ঘরগুলোতে বহু আগে একটি হিন্দু পরিবার থাকত। তারা চলে যাওয়ার পর এই স্থানটি অনেকটা জংলা স্থানে পরিণত হয়েছে। আশেপাশের বিল্ডিং গুলোর শুকনো ময়লাও সামনের ওই পাগাড়ে ফেলা হয়।

অমানিশা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলো আহনাফের কাছে। গাছের ফাঁকে বসে নাম না জানা কোন পাখি যেন ডাকছে! মৃদুমন্দ বাতাসে ময়লার দুর্গন্ধ। তবুও প্রেমিককে দেখার ইচ্ছার কাছে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বড় ঠুনকো। 
আহনাফ অমানিশাকে দেখে হাসল। একটু কাছে এগিয়ে যেতেই তাকে টান দিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ফেলল।   
একটি টিনের ঘরের দরজা ভাঙ্গা ছিল। সেই ঘরের ভেতর ঢুকল তারা। আহনাফ হাঁটু গেড়ে বসে অমানিশার পেটে আলগোছে চুমু খেল। অস্ফুট স্বরে বলল,
আমার বাচ্চা! 
এরপর অমানিশার ঠোঁটে গভীরভাবে চুমু খেল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অনুনয়ের স্বরে বলল,
আমি সত্যিই অনেক লজ্জিত, নিশা। যেসময় আমার তোমাকে মানসিক সাপোর্ট দেওয়া প্রয়োজন ছিল, সেসময় আমি তোমার পাশে থাকতে পারিনি। 

অমানিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
তুমি তো ইচ্ছা করে করো নি। পরিস্থিতিই তোমার বিপরীতে ছিল। এখন এসব বাদ দাও।

ঠিকাছে, বাদ দিলাম। 

আংকেল কেমন আছেন এখন? 

ওষুধ খাচ্ছেন। বাবা আসলে মেন্টালি অনেক ভেঙ্গে পড়েছেন। পরিবারের এই অবস্থা। টাকা পয়সার টানাটানি। আমার পড়াশোনাটাও তার জন্য ছাড়তে হল। তিনি এত চাপ একসাথে নিতে পারছেন না। নিজের মৃত্যু কামনা করে চলেছেন সবসময়। 

'আহারে!' অমানিশা বেদনাগ্রস্ত হয়ে বলল,
আসলে উনারও তো খারাপ লাগে তোমাদের এ অবস্থায় দেখে। তুমি চিন্তা করো না। খুব শিঘ্রই সব ঠিক হয়ে যাবে। 

আহনাফ অমানিশার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
তুমি যখন বলছো, তাহলে হয়ত সব অবশ্যই ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোমাকে অনেক বিশ্বাস করি। আমার বউ তুমি! 

অমানিশা মিষ্টি করে হাসল। পরক্ষণেই শঙ্কিত চোখে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বলল,
এতক্ষণ আমার বাইরে থাকা যাবে না। মা ঘুম থাকতে থাকতেই ফিরে যেতে হবে। 

আহনাফের চেহারায় দুঃখ প্রকাশ পেল। বলল,
আরেকটু সময় থেকে যাও প্লিজ?

অমানিশা বলল,
মা জাগনা পেয়ে আমাকে খুঁজবে। না পেলে বিশাল বড় ঝামেলায় পড়ে যাব। 

আচ্ছা, তাহলে আর তোমাকে আটকে রাখা উচিত হবে না। টাকাগুলো দাও। আমি গিয়ে এবোরশনের ব্যবস্থা করি। 

অমানিশা অন্তর্বাসের ভেতর থেকে দশ হাজার টাকা বের করে আহনাফকে দিল। চকচকে টাকাগুলো অত্যন্ত মনযোগের সহিত গুনে দেখল সে। এরপর অমানিশার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল,
চলো সামনের দোকান থেকে তোমাকে কিছু কিনে দেই। 

কি কিনে দিবে? - আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল অমানিশা।

তুমি না আচার পছন্দ করো? চলো তোমাকে অনেকগুলো আচার কিনে দেই। আর এমনিতেও এসময় তো মেয়েদের টক খেতে ইচ্ছে করে! 

অমানিশার চোখ হঠাৎ ভিজে উঠল। ব্যথিত কণ্ঠে বলল,
আর মাত্র কয়েকদিন! এরপর তো আমাদের বাবুটা আর দুনিয়াতে থাকবে না। 

আহনাফের চোখেও জল এলো। এ জলে আবেগ নেই। অনুশোচনা নেই। অনুতাপ নেই। আছে শুধু ভণিতা। কিন্তু এই ভণিতা অমানিশা বুঝতে পারল না। অমানিশার মত সহজ সরল মেয়েরা আবেগহীন মায়াকান্নাকে বিশ্বাস করেই সর্বস্ব হারায়। 

অমানিশা আহনাফের চোখ দুটো নিজের ওড়না দিয়ে মুছে দিল। 
আহনাফ বলল,
আমাদের অনেকগুলো সুন্দর সুন্দর বাবু হবে। বাবা একটু সুস্থ হলেই আমি বাসায় আমাদের বিয়ের কথা বলব। তোমার থেকে দূরে থাকতে আর ভালো লাগে না। আমার আগোছালো জীবনটা গুছিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাকে প্রয়োজন। আমাকে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে গাইড করার জন্য হলেও তোমাকে প্রয়োজন। তুমি ছাড়া আজকাল আমি আমার অস্তিত্ব খুঁজে পাই না।
এপর্যায়ে আহনাফ অমানিশার হাতজোড়া নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে বলল,
আমায় ছেড়ে কখনো যাবে না তো, অমানিশা? সবসময় আমার পাশে থাকবে তো? 

অমানিশার কোমল হৃদয় আহনাফের প্রতিটি জটিল কথার গোলকধাঁধায় আটকে গেল। অবিশ্বাস তার দুয়ারে বেশ কয়েকবার কড়া নাড়লেও আহনাফ নিখুঁত কথার জাল বিছিয়ে, দ্বিধাগ্রস্ত করে বিদায় সেই অবিশ্বাসকে বিদায় জানিয়েছে! তার এই দক্ষতার কাছে সত্যিগুলোও আজ বড় অসহায়। 
এভাবেই সমাজে ভালো মানুষের মুখোশ পরিধেয় আহনাফরা শুষে খাচ্ছে কতশত অমানিশাকে! নষ্ট করছে সম্মান, কেড়ে নিচ্ছে বেঁচে থাকার অধিকার। ধ্বংস হচ্ছে তাদের জীবন আর পরিবার।

অমানিশার চোখের জল গাল গড়িয়ে পড়ার আগেই সেই জল আলগোছে মুছে দিল আহনাফ। ভেজা গালে চুমু এঁকে পুনরায় জিজ্ঞেস করল, 
কি থাকবে না আমার পাশে? হবে না আমার জীবনের রাণী?

হব। - শক্ত করে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে জবাব দিল অমানিশা। 

তার দৃষ্টি এড়িয়ে নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলল আহনাফ। যেটুকু সন্দেহের পরগাছা অমানিশার মনে জন্মেছিল তা উপড়ে ফেলে দিতে পেরেছে সে। আহনাফ বলল,
অনেক কান্নাকাটি হয়েছে। এবার চলো তোমাকে আচার কিনে দেই। 

আমার আচার লাগবে না। 

একদম চুপ! অবশ্যই লাগবে। চলো। 

খানিকটা জোর করেই অমানিশাকে অনেকগুলো আচার কিনে দিল আহনাফ। এরপর বিদায় জানিয়ে চলে গেল।

অমানিশার মাঝে যেটুকু সন্দেহের বীজ স্থাপিত ছিল, তা একদম শিকড় ছিড়েখুঁড়ে বেরিয়ে এলো। ধোঁকাবাজ হলে আহনাফের চোখে জল কেন আসবে? এ কঠিন প্রশ্নের উত্তর অমানিশার কাছে নেই বলেই হয়তো আরোও একবার বিশ্বাস করে ফেলল আহনাফকে।

অমানিশাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে আহনাফ রিক্সায় উঠে আবিরকে ফোন করল। 
রাফির কাছে কয় পিস ই*য়া*বা আছে রে এখন? 

আবির জবাব দিল,
পঁচিশ পিসের মত এখনো আছে। 

ওকে বিশ পিস নিয়ে আমার বাসায় আসতে বল। 

আবির বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,
টাকা ম্যানেজ করা শেষ? 

আহনাফ প্রত্যুত্তরে গর্বিত ভঙ্গিতে শব্দ করে হাসল। আবির খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
তুই মামা পাকা খেলোয়াড়! কথা দিয়েই কিভাবে পটিয়ে টাকা পয়সা হাতিয়ে নিস বল তো? 

তোকে বলে লাভ নেই। তুই সবকিছু জেনেশুনেও এভাবে টাকা নিতে পারবি না। গার্লফ্রেন্ডের কাছে এক হাজার টাকা চাইতেই যে নাটক শুরু করিস! - হতাশ গলায় বলল আহনাফ। 

লজ্জা লাগে বন্ধু। - মিনমিন করে বলল আবির। 

বন্ধুর গার্লফ্রেন্ডের টাকায় নেশা করতে লজ্জা লাগে না, বা*ই*ঞ্চো*দ কোথাকার? - আহনাফের রূঢ় গলা শোনা গেল। 

আবির গলা উঁচু করে বলল,
তোকে সাপ্লাইয়ারদের ইনফরমেশন কে দেয় রে, হারামজাদা? 

একদম ধন্য করে ফেলিস আমার জীবন, শালা। তুই না খবর দিলে বোধহয় ওদের আমি খুঁজে পেতাম না? আজাইরা না বকে, রাফিকে নিয়ে বাসায় আয়। 

উল্লাসিত স্বরে আবির বলল,
সারারাত আজ পার্টি হবে বস! 

দুইজন মিলে কি আর পার্টি করব? টসটসে দুটো ফুলকলিও ম্যানেজ কর। চারজন একসাথে পার্টি করব নি। পাশের ইউনিট একদম ফাকা। রুমও আছে দুটো। কোনো সমস্যা হবে না।

আবির দুষ্টমির হাসি হাসল। বলল,
ফুলকলিদের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমি আসছি রাফিকে নিয়ে। রাখছি। 

আহনাফ ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে ফোন কেটে দিল। মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে তার বড় গর্ব হয়। সুন্দর চেহারা আর কথার জালে অল্পবয়স্ক মেয়েদের সে কয়েকবছর ধরেই আবদ্ধ করে চলেছে। বিষয়টি তার কাছে আনন্দদায়ক। অগুনিত মেয়ের সাথে তার পরিচয় হয়েছে। তবে তারা কেউই অমানিশার মত অবুঝ এবং বোকা ছিল না। 
মাঝে মাঝে অমানিশার জন্য তার সহানুভূতি কাজ করে। মনে হয়, মেয়েটাকে আর ঠকানো উচিত হবে না। কিন্তু ওকে ছেড়ে দিলে নেশার টাকাগুলো আসবে কই থেকে? আহনাফের জীবনে নেশা আর নারীর চেয়ে চরম সত্য কিছু নেই। 
          বাড়ি ফিরে অমানিশা ড. সুরভী কে ফোন করল। ড. সুরভী যেন ওর ফোনের অপেক্ষাতেই ছিল। কল রিসিভ করেই ব্যাকুল গলায় বললেন,
কি খবর তোমার মা? 

আলহামদুলিল্লাহ। ভালো, খালামণি। 

ড. সুরভী বললেন,
তোমাকে আমি আজ ফোন করতে চেয়েছিলাম। সেদিন এবোরশনের খরচ জানতে চাইলে। অথচ জিজ্ঞেস করা হয়নি, তুমি ছোট মানুষ এতগুলো টাকার ব্যবস্থা করবে কিভাবে? শোনো মা, তুমি এমনেই চলে এসো। টাকা লাগবে না। আমি চাইছি না পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাক। যত দেরি করবে, তত স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়বে।তুমি কি বুঝতে পারছো আমার কথা? 

অমানিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, 
আসলে আমার বয়ফ্রেন্ড চাইছে না আমি এবোরশন করি। যদি করতেই হয়, ওর পরিচিত ডাক্তার দিয়ে করাতে চাইছে। অন্য কারো ওপর ভরসা করতে পারছে না। 

ওহ! - ড. সুরভী হাসিমুখে বললেন, 
তাহলে তো সমস্যা মিটেই গেলো। তোমাকে নিয়ে বড় টেনশন হচ্ছিল গো, মা। বারবার ভাবছিলাম, এত ছোট মেয়ে। পরিবারের কেউ জানে না। কিভাবে এতবড় ধকল সামলাবে?

অমানিশা অনুনয় করে বলল,
খালামণি, আপনি অচেনা মানুষ হয়েও আমার জন্য এত ভেবেছেন। আমি আপনার কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব। 

ড. সুরভী হাসলেন। বললেন,
কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলো। দ্বিতীয়বার চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি যেমন আরবীর খালা, তোমারও খালা। ঠিকাছে মা, ভালো থাক তাহলে? 

আচ্ছা খালামণি। আপনিও ভালো থাকবেন।আসসালামু আলাইকুম। 

ওয়া আলাইকুমুস সালাম। 

টুট। টুট। টুট। 
লাইন বিচ্যুত হওয়ার মাঝে ভৌতিক কিছু নেই। তবুও অমানিশার মাঝে অজানা ভয় জেঁকে বসল। তার মনে হল, সে আরোও বড় বিপদের সম্মুখীন হতে চলেছে। এই বিপদ থেকে মুক্তির কোনো পথ নেই। ধু ধু মরুভূমির মতন সীমানাহীন এ বিপদ। কিছুদূর এগোলে মনে হবে এইতো নিস্তারের পথ! কিন্তু এ পথ এবং মরিচীকার মাঝে কোনো বিভেদ নেই।

সাউন্ডবক্সে ইংরেজি গান বাজছে। আহনাফ আজ বেজায় খুশি। পাঁচশ টাকা পেচিয়ে একদম চিকন পাইপ বানিয়ে ফেলেছে সে। ফয়েল পেপারের নিচে আলগোছে লাইটার ধরে সেই টাকার পাইপ দিয়ে বুক ভরে ধোঁয়া টানছে। এ যেন এক অন্য ভূবনের স্বাদ! 
আবির সিগারেটে টান দিয়ে কণ্ঠে বিরক্তি নিয়ে বলল,
সবগুলো ট্যাবলেট এক বসায় শেষ করবি নাকি? 

আহ - অস্পষ্ট স্বরে আওয়াজ বের হল আহনাফের মুখ থেকে। ভ্রু কুঁচকে বলল,
এই বা*ই*ঞ্চোদ! সমস্যা কি তোর? ফ্রি তে নেশা করাচ্ছি তাতেও তোর হয় না? অন্যের বিড়ালে মুখ দেওয়া আর যেখানে সেখানে বাম হাত ঢুকানোর স্বভাব তোর গেল না। 

আবির হেসে ফেলল। বলল,
বল, বল। যা মুখে আসে তাই বল। যে গরু দুধ দিবে, তার লাত্থি খাব না, এ আবার হয় নাকি? তবে যাই বলিস, অন্যের বিড়ালে মুখ দেওয়ার ব্যাপারটা কিন্তু অমায়িক বন্ধু। 

কিভাবে অমায়িক? একটু বিস্তারিত বল শুনি। - ধোয়া নাকে নিয়ে মাতাল হয়ে জিজ্ঞেস করল আহনাফ। 

ফুটবল ম্যাচের মত। গোলপোস্টে গোলকিপার দাঁড়িয়ে আছে হাত পা ছড়িয়ে। তাও তুই বলটাকে নিয়ে খেলতে খেলতে গোল করে দিলি। - কথাগুলো বলে আবির উচ্চস্বরে হেসে ফেলল। 

আহনাফ গম্ভীরমুখে বলল,
এবার অন্তত ভাবীদের দিকে নজর দেওয়া বাদ দে। বয়স তো কম হলো না। 

এহ! কচি মেয়ে ধরা ছেলে আমায় আবার বয়সের দোহাই দিচ্ছে। তুই নিজে কি করছিস? আস্ত পেডোফাইল একটা। 

আহনাফ তৃপ্তির হাসি হাসল। যেন আবির তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ!  

এপর্যায়ে আহনাফের মোবাইল বেজে উঠল। ফোনের দিকে তাকিয়ে সে ইশারায় আবিরকে চুপ করতে বলল। সাউন্ডবক্স অফ করে ফোন রিসিভ করল। 
রাজন ভাই! কি খবর? কোনো খোঁজ খবর নাই। 

রাজন রাগী গলায় বলল,
ঢং করিস না, আহনাফ! তোর ধান্দাবাজি আর কেউ না বুঝলেও আমি কিন্তু বুঝি। 

আপনার লগে কি আমার ধান্দাবাজির সম্পর্ক ভাই? কি কন না কন! ধুর মিয়া। - হতাশা মেশানো দীর্ঘশ্বাস ফেলল আহনাফ। 

তুই কি করছিস, না করছিস সব খবর কিন্তু আমার কানে আসে। বললাম মেয়েটারে ছেকা দিতে। আর তুই ওর সাথে প্রেমের সাগরে হাবুডুবু খাইতেছিস। সেও দেখি তোর নেশার সামগ্রী কিনে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে নিছে! ভালোই আহনাফ। মুখে ভাই ভাই বলে ভাইয়ের পেছনে বাঁশ দিতেছিস। তাও আবার আছোলা! 

আহনাফ ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,
আহা ভাই! ভুল বুঝতেছেন। আপনি যেভাবে যা বলছেন, সেভাবেই আমি এগোচ্ছি। এখন মাগনা নেশার টাকা পাইলে কি ছাড়া উচিত হবে? আপনিই বলেন?

আমি আর কি বলব? গার্লফ্রেন্ড তোমার। টাকা তোমারে দেয়। সেই টাকা নিয়া একা একা পার্টি করো। আমরা কে? নারীর নেশায় ভাই ব্রাদার্স পর হয়ে গেছে। 

আহনাফ হেসে বলল,
ভাই পার্টি এরেঞ্জ করব খুব শিঘ্রই। সেদিন আপনিও থাকবেন আমাদের সাথে কোনো সমস্যা নাই। আপনি শুধু ভুল বুইঝেন না। 

ভুল তো বুঝতে চাই না। তুই ও প্রতারণা করিস না, আহনাফ। আমি ভুল মাইনা নিতে পারি। অন্যায় মাইনা নিতে পারি। প্রতারণা মানতে পারি না। এরকম কিছু হলে টুঁটি ছিড়া ফেলব তোর। - গম্ভীর গলায় বলল রাজন। 

এমন কিছু হলে আমি মাথাটাই পাইতা দিবনি আপনার সামনে। আপনি গর্দান নিয়েন, ভাই। ঠিক আছে? 

রাজন হেসে ফেলল। বলল,
ঠিক আছে, ভালো থাক। রাখলাম। 

ফোন কাটার সাথে সাথে আহনাফ দাঁতের ফাঁকা দিয়ে গালি দিল, 'বাই*ঞ্চো*দের পয়দা'।

আবির জিজ্ঞেস করল,
রাজন কেন ফোন দিল তোকে? 

বিরক্ত হয়ে আহনাফ উত্তর দিল,
কেন আবার? গন্ধ পেয়েছে তাই! রাফি মনে হয় বলছে মাল নিছি। তাই শালায় ফোন দিছে। অমানিশার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে এমন একটা ভাব ধরে যেন আমাকে কিনে নিছে। 

ফোন ধরলি কেন তাহলে? - আবির প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল। 

ফোন না ধরলে সরাসরি বাসায় এসে হাজির হত। মা*দার*চো*দের মানসম্মান আছে নাকি? দে তো সিগারেট টা। মাথাটা ধরে গেছে একদম। 

আবির আহনাফের দিকে সিগারেট এগিয়ে দিতে দিতে হাসিমুখে বলল,
দুইজন মেয়ের ব্যবস্থা হইছে। 

আহনাফের মেজাজ মুহুর্তেই হিমালয়ের মত শীতল রূপ ধারণ করল। ফুরফুরে গলায় বলল,
কোথাকার? 

লালপাড়ায় আসছে। একদম নতুন নাকি। 

আহনাফ পুনরায় অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। বলল,
শালা, টাকা কই পাব? ওরা কি ফ্রিতে সার্ভিস দিবে? 

আবির মাথা চুলকে বলল,
এছাড়া আর উপায় নেই। 

তোর কিছুই করতে হবে না। তুই যেয়ে ওদের কাছ থেকে সার্ভিস নে। আমি আমার ব্যবস্থা করে নিচ্ছি। - আহনাফের চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ। 

কিভাবে ব্যবস্থা করবি?- আগ্রহভরে জানতে চাইল আবির।

আহনাফ এপ্রশ্নের জবাব দিল না। ফেসবুকে লগইন করে দিশার প্রোফাইলে ঢুকল। মেয়েটা দারুণ ছবি তুলে। প্রতিটি ছবিতে বুকের মাঝখানের সুগভীর খাদ স্পষ্ট। স্ক্রিনের ওপর দিয়েই সেই গভীরতা বৃদ্ধাঙ্গুলির স্পর্শে নির্নয়ের চেষ্টা করল আহনাফ। ব্যর্থতা তাকে পাগল বানিয়ে দিল। সোজা ম্যাসেঞ্জারে গিয়ে লিখল,
আজ ফ্রি আছো? বাসায় আসতে পারবে? 

—————

অমানিশা ভেবেছিল বাসায় ফিরে আহনাফ তার সাথে যোগাযোগ করবে। কিন্তু এরকম কিছুই ঘটল না। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হল। বিকাল গড়িয়ে রাত। তবুও আহনাফের নাম মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল না। বুকে একরাশ আশা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে। 

ভোরের আলো তখন সবেমাত্র ফুটেছে। পশ্চিমের জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে সরু কমলা রঙের আলোর ছটা খেলা করছে অমানিশার মুখে। রাতে ঘুমের ঘোরেই কেঁদেছে মেয়েটা। চোখের পানি শুকিয়ে শুষ্কবর্ণ ধারণ করেছে। নিষ্পাপ এই মুখটায় কত শত চিন্তার ছাপ! ভয়ের আনাগোনা। নিশ্চয়তা ফোঁস ফোঁস করে উঠছে তার শ্বাস প্রশ্বাসে। 

আড়মোড়া ভাঙ্গল অমানিশা। 
রাহেলা প্রতিদিন এসময় মেয়ের ঘরে ঢুকেন। নিঃশব্দে পুরো ঘরে পায়চারি করেন। পশ্চিমের ঝুলন্ত পর্দা দুটোকে টেনে ক্লিপ লাগিয়ে দেন। যেন মেয়ের মুখে রোদ না পড়ে!

নিয়মানুসারে, আজকেও তিনি ঘরে এসেছেন। মেয়েকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
কিরে! আজ এত দ্রুত ঘুম ভেঙ্গে গেছে? 

প্রত্যুত্তরে অমানিশা হাসল। 

রাহেলা জিজ্ঞেস করলেন,
চা খাবি? 

অমানিশা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। রাহেলা হাসিমুখে পর্দায় ক্লিপ লাগিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন চুলায় চায়ের পানি বসাতে । অমানিশা দ্রুত ব্যাগ থেকে ফোন বের করে বাথরুমে ঢুকল। আহনাফ আবার মধ্যরাতে ফোন করেছিলো কিনা দেখা প্রয়োজন। 

দুটো মিসড কল উঠে আছে দেখেই অমানিশার বুকটা ধক করে উঠল। সে সাথে সাথে কল ব্যাক করল। যদিও সে ধরেই রেখেছিল আহনাফ কল রিসিভ করবে না! 
কিন্তু অমানিশাকে মিথ্যে প্রমাণ করে আহনাফের ভরাট কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

নিশা, জান আমার। আই মিসড ইউ সো মাচ। সারারাত কোথায় ছিলে তুমি? 

অমানিশা ফিসফিস করে বলল,
ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। 

আমার কথা না ভেবেই ঘুমিয়ে গেলে? তোমার সাথে কথা হয়নি দেখে সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি। - আদুরে গলায় বলল আহনাফ।

আই এম সরি। - অপরাধী মত বলল অমানিশা। 

ফিসফিস করে কথা বলছ কেন? - বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করল আহনাফ। 

মা জাগনা। আমি বাথরুমে এসে কথা বলছি তাই। 

ওহ! তোমার সাথে আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা আছে। 

আমি তো এখন কথা বলতে পারব না, আহনাফ। - পুনরায় ফিসফিস করে বলল অমানিশা। 

তোমার কথা বলতে হবে না। তুমি শুধু শুনে যাও। কেমন? 

অমানিশা সম্মতি জানাল। 

গতকাল তোমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাসায় ফেরার পর দেখলাম মা হাউমাউ করে কাঁদছে। ফুপি নাকি মাকে ফোন দিয়ে অনেক উল্টোপাল্টা কথা বলেছে। এর ওপর বাসায় গ্যাস নেই অন্যের বাড়ি গিয়ে আর কত রান্না করবে? তুমি তো জানো, মায়ের হার্টের সমস্যা আছে। আমি বুঝতে পারছিলাম না আমার ওই মুহুর্তে ঠিক কি করা উচিত। মায়ের প্রতিটি কথা আমার বুকে তীরের মত বিঁধছিল, নিশা! উপায় খুঁজে না পেয়ে টাকাগুলো দিয়ে আমি গ্যাসের লাইন ঠিক করিয়েছি। এরপরেও দুই হাজার টাকার মত হাতে ছিল। রাতে মায়ের বুক ব্যাথা শুরু হল। বক্সে হার্টের ওষুধ খুঁজতে গিয়ে দেখি একটা ওষুধও নেই। বাকি টাকা দিয়ে হার্টের ওষুধ এনেছি। নিশা, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি জানি, টাকাগুলো তোমার অনেক প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মায়ের কান্নার কাছে এই বেকার ছেলের মনুষ্যত্ব কোথায় যেন বিলীন হয়ে গিয়েছিল। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, নিশা। যদি এবোরশন করার ক্ষেত্রে কোনো কমপ্লিকেশন থাকে, সেক্ষেত্রে আমি আর পরিবারের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করব না। সোজা তোমায় নিয়ে বিয়ের পিড়িতে বসব। তুমি কি শুনেছো আমার সব কথা? 

অমানিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছোট্ট করে উত্তর দিল, হুঁ। 

আরেকটা রিকুয়েষ্ট করব জান আমার? 

করো। 

যদি সম্ভব হয়, আরেকবার টাকা ম্যানেজ করার চেষ্টা করবে প্লিজ? 

ঠিকাছে, আমি দেখছি।

নিশা, আমাকে ভুল বোঝো নি তো? 

না। 

আমি সত্যিই নিরূপায় হয়ে কাজটা করেছি। 

আমি বুঝতে পেরেছি। - এমন সময় ঘরে রাহেলার প্রবেশের আভাস পাওয়া গেল। অমানিশা গলার স্বর আরোও নামিয়ে বলল,
ঘরে মা এসেছে। আমি রাখছি। 

আচ্ছা। 

রাহেলা মেয়েকে তাড়া দিলেন। 
তাড়াতাড়ি কর অমা! চা ঠান্ডা হয়ে যাবে। 

আর পাঁচ মিনিট, মা। 

অমানিশা বাড়িতে অন্তর্বাস পরে থাকে না। ফোনটা নিয়ে সে কিভাবে বাথরুম থেকে বের হবে এ নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেল। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল তার। পায়জামার রাবারের অংশটাতে মোবাইল মুড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো সে। 

রাহেলা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
জলদি বেসিং থেকে মুখ ধুয়ে আয়। 

বেড টি মুখ না ধুয়েও খাওয়া যায়,মা। - হাসিমুখে বলল অমানিশা। 

ইশ! কি নোংরা কথা। মুখ না ধুয়ে বলে চা খাবে! এক্ষুণি যা, মুখ ধুয়ে আয়। এতক্ষণ ভরে বাথরুমে যে কি করিস তুই! - নাক মুখ সিটকিয়ে বললেন রাহেলা। 

অমানিশা পুনরায় বাথরুমে ঢুকল। বেসিং এ মুখ ধুতে ধুতে চিন্তা করতে লাগল কিভাবে আবার এতগুলো টাকার ব্যবস্থা করা যায়। হঠাৎ তার চোখদুটো চিকচিক করে উঠল। গতবছর জন্মদিনে অমানিশার বাবা তাকে একটি ল্যাপটপ উপহার দিয়েছিল। যদি একান্তই ক্যাশের ব্যবস্থা না করা যায়, তাহলে ল্যাপটপটা বিক্রি করে দিবে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হল সে। 
          আরো বেশ কয়েকবার ধরণী তার অংশুমালীকে প্রদক্ষিণ করে ফেলল। অথচ আহনাফ তার স্বভাবমতো নিখোঁজ রইল। পাগলপ্রায় অমানিশা স্বস্তিতে নিশ্বাস ফেলার জন্য আকুপাকু করছে। তার মনে চুল পরিমাণ শান্তি নেই।
মানসিক শান্তির তৃষ্ণা মিটাতে মানুষ খুনের মত বড় অপরাধকেও তুচ্ছ করে দেখে। অমানিশার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম কিছুর দেখা মিলল না। 

তার গর্ভের সন্তান একটু একটু করে বাড়ছে। আর কদিন পরেই ছোট্ট ভ্রুণটি মানুষের আকৃতি ধারণ করতে শুরু করবে। টকটকে লাল রঙের অতি ক্ষুদ্র দুটি হাত, দুটি পা, ছোট একটি মাথা, বিন্দু বিন্দু দুটি চোখ। বড় হবে ভ্রুণটি। ছোট প্রাণটির হৃদপিণ্ডের ধক ধক শব্দ কি তখন অমানিশার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাবে? যদি সেই ধকধকানি আলগোছে কড়া নাড়ে বিবেকের দরজায়। তখনও কি ভ্রুণহত্যা নিতান্তই তুচ্ছ বলে মনে হবে অমানিশার কাছে? 

৪৫৪ কোটি বছর বয়সী পৃথিবী এর উত্তর জানে না। ৪৫৭ কোটি বছর বয়সী সূর্যও এর উত্তর জানে না। মাটিতে হেঁটে চলা, পানিতে ডুবে চলা বা বাতাসে ভেসে চলা প্রতিটি নিশ্বাসের গল্প এখানে ভিন্ন। বিবেকের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কে সত্যের পথে এগোবে আর কে বেছে নিবে মিথ্যার পথ তা শুধুমাত্র সেই জানে।

শেষবার তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যাওয়ার পরেও আহনাফের প্রতি অমানিশার বিশ্বাস ছিল অটুট। তবে, সেদিন মধ্যরাতে কি মনে করে যেন তাহাজ্জুদ আদায় করল সে! পাক পবিত্র হয়ে সিজদায় ঝুঁকে নীরবে চোখের পানি ফেলল ফজর পর্যন্ত। রাতের নিস্তব্ধতায় অনিশ্চয়তার ভয় আঁকড়ে ধরেছিল তাকে। বিরতি দিয়ে দিয়ে শরীর কেঁপে উঠেছিল তার। 

কিন্তু, এক অন্য ভোরের আলো ফুটেছিল সেদিন। পূর্ব দিকের লাল আকাশ, মৃদুমন্দ বাতাস আর সেই ছন্দে দুলে ওঠা গাছের পাতাগুলো অমানিশার বুকে যেন অবিশ্বাসের বীজ রোপণ করতে ব্যস্ত ছিল। কমলা রোদের স্নিগ্ধ আলোর ছোঁয়ায় সেই অবিশ্বাস তরতর করে বাড়তে লাগল। যৌক্তিক প্রশ্নেরা মাথায় ছোটাছুটি করতে লাগল। 
আহনাফ তাকে ভালোবাসে। তবে কেন এত অবহেলা?ভালোবাসায় তো অবহেলার কোনো স্থান নেই! 
তাদের সম্পর্কটা কি টাকা কেন্দ্রিক নয়? রেস্টুরেন্টের সামান্য কফির বিলও অমানিশাকে দিতে হয়েছে। 
এছাড়া আহনাফের যত বিলাসী আবদার, সব ছিল অমানিশার কাছে। নেশা ছাড়ানোর জন্য প্রতি সপ্তাহে সাত হাজার টাকা করে দিতেও পিছুপা হয়নি সে। বিনিময়ে কি পেয়েছে? 
কখনো বেশ্যার ট্যাগ। কখনো বা খাংকি, নটি এজাতীয় গালি। সত্য মিথ্যার লড়াই এর মাঝে অমানিশা নিজেকে আর জড়াতে চায় না। সে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চায়! 

আজ কোনো এক বিশেষ কারণে স্কুল বন্ধ। অমানিশা ল্যাপটপের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অন্য কোনোভাবে টাকার ব্যবস্থা করতে পারে নি সে। ল্যাপটপ বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। 
ল্যাপটপটা সে আহনাফের হাতে দিবে না। টাকা জোগাড় হয়েছে কিনা এবিষয়ে কোনো তথ্য তাকে জানাবে না। তবে একা কিভাবে ল্যাপটপ বিক্রি করবে সে? 
শিরিন আজ মিথ্যা বলে বাসা থেকে বের হতে পারবে না। আরবীর ক্ষেত্রেও অভিন্ন বিষয়। তার বাসাও বেশ দূরে। একমাত্র মুনার পক্ষে কিছু একটা ব্যবস্থা করা সম্ভব। কেননা তার বাসা স্কুলের সন্নিকটে। 
যদিও মুনার সাথে সম্পর্ক এখন আর আগের মত নেই। সেদিন স্কুলের ওই আলাপচারিতা মুনা বেশ ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছে। তার ভাষ্যমতে, এত বড় অপবাদ যে বন্ধু দিতে পারে, তার সাথে সম্পর্কে রাখা আর দুধ দিয়ে কেউটে পুষা একই। 

খানিকটা ইতস্তত করেও নিরূপায় অমানিশা মুনার সাহায্যের শরনাপন্ন হল। ফোন করে বলল,
দোস্ত, আমি খুব বিপদে আছি তোর সাহায্যের প্রয়োজন।

মুনা সহজ গলায় জবাব দিল,
কি সাহায্য? 

আমার দ্রুত টাকার প্রয়োজন। ল্যাপটপটা বিক্রি করতে হবে। - তড়িঘড়ি করে বলল অমানিশা। 

আমি কিভাবে ল্যাপটপ বিক্রি করতে সাহায্য করব? আমি নিজেই জানি না, কোথায় এসব বিক্রি করতে হয়। - বিরক্তির সুরে বলল মুনা। 

তোর বয়ফ্রেন্ডকে বললে সাহায্য করবে না? - আগ্রহভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল অমানিশা। 

ক্ষিপ্রগতিতে জবাব ধেয়ে আসল মুনার পক্ষ থেকে,
না। জোভান তোকে দেখতে পারে না। ও আমাকে তোর সাথে মিশতেও মানা করে দিয়েছে। তাছাড়া কি হিসেবে আমি তোকে সাহায্য করব বল? আজকে সাহায্য চাইছিস আগামীকাল আবার আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিবি। আমি এসব সহ্য করতে পারব না। তুই ফোন রাখ। 

অমানিশা কান্না চেপে অনুনয় করে বলল,
দোস্ত, আই এম সরি। আমি কি একটা মানসিক সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তোকে বলে বোঝাতে পারব না। হুট করে শুনেছিলাম প্রেগনেন্সির খবর ছড়িয়ে গেছে। তখন আমার মাথা কাজ করছিল না। কারণ তুই ছাড়া আর কেউ এই বিষয়ে কিছু জানতো না। দোস্ত, আমার দ্রুত এবোরশনের টাকা জোগাড় করতে হবে। প্লিজ আমাকে শেষবারের মত সাহায্য কর। তোর পায়ে পড়ি দোস্ত। প্লিজ? 

অমানিশার কথা শুনে বোধহয় মুনার মায়া হল। সে সাহায্য করতে রাজি হল। জিজ্ঞেস করল,
আমার কি করতে হবে বল?

তুই স্কুল টাইমে বাসা থেকে বের হতে পারবি? 

স্কুল টাইম তো অলমোস্ট হয়েই গেছে। যাইহোক, পারব। কিন্তু এরপর কি হবে?

তুই আগে বের হ। এরপর বলছি। আধা ঘন্টার মধ্যে স্কুলের পেছনে ভাঙ্গা বাড়ির ওইদিকে দাঁড়িয়ে থাকিস। কেমন? 

তুই কি স্কুল ড্রেস পরে বের হবি? 

হুঁ। এছাড়া কিছু করার নেই আমার। - দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল অমানিশা। 

আচ্ছা। 

গার্লস স্কুল আজ একদম নিশ্চুপ। কোনো হইচই নেই। হট্টগোল নেই। স্কুলের সামনের দোকানগুলোর বেচাকেনা নেই বললেই চলে। সবাই জানে, স্কুল বন্ধ। কোন এক এন-জি-ও এর ম্যানেজমেন্ট পদের পরীক্ষার সীট পড়েছে এখানে। পরীক্ষা হয়েছে আজ সকালে। 
স্কুল ড্রেস পড়া অমানিশাকে রাস্তার সবাই কৌতূহলী চোখে দেখছে। সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে ভাঙ্গা বাড়ির সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল অমানিশা। একজন পথচারী ভ্রুঁ কুঁচকে তাকে জিজ্ঞেস করল,
মামণি, দাঁড়িয়ে আছো কেন? আজকে স্কুল বন্ধ না? 

অমানিশা হেসে জবাব দিল,
জি আংকেল। আসলে আমি জানতাম না। 

ওহ! - পথচারীও মিষ্টি করে হেসে নিজের গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল। 

ক্ষণিককাল পর দেখা মিলল মুনার। আপাদমস্তক কালো বোরখায় ঢাকা। ধীরগতিতে হেঁটে সে অমানিশার কাছে এসে বলল,
এখন কি করবি? 

জোভানকে একটু ফোন দিয়ে বল ল্যাপটপটা নিয়ে যেতে। - করুন স্বরে বলল অমানিশা।

মুনা গর্বিত ভঙ্গিতে বলল, 
দেখেছিস তুই জোভানকে এক সময় পছন্দ করতি না। আজ ওই তোর কাজে আসছে। 

অমানিশা হাসার চেষ্টা করে বলল,
ওকে আমি কেন পছন্দ করতাম না সেটা তুই ভালোভাবেই জানিস। ও ই*য়া*বার ব্যবসা করে। আমি কখনোও চাইনি তুই ই*য়া*বা ব্যবসায়ী কারো সাথে প্রেম কর। 

মুনা হো হো করে হেসে ফেলল। বলল,
অথচ নিজে ই*য়া*বাখোরের সাথে প্রেম করছিস!

অমানিশা স্বাভাবিকভাবে বলল,
আহনাফের নেশা সংক্রান্ত বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না, মুনা। কিন্তু তুই প্রেম করার আগেও জোভানের ব্যাপারে সব জানতি। 

মুনা খানিকটা আক্রমণাত্মক ভাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। আচমকা অমানিশা রাস্তার পাশে হড়হড় করে বমি করতে শুরু করল। মুনা লক্ষ্য করল অমানিশার চোখের চারিপাশে কালো দাগ পড়েছে। মুখে এতটুকুন জ্যোতিও নেই। 

ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিল অমানিশা। ম্লান হেসে বলল,
সকালে কিছু খেতে পারিনি। বমি হয়েছে। এখন আবার বমি হল। 

মুনা উতলা হয়ে বলল,
তুই আগে কিছু খেয়ে নে। - এরপর চারিপাশে চোখ বুলিয়ে মুদির দোকান খুঁজতে লাগল সে। একটি ছোট দোকানের দেখাও মিলল। মুনা পুনরায় বলল,
তুই দাঁড়া। আমি সামনের দোকান থেকে কেক কিনে আনি। 

অমানিশা বলল,
কোনো প্রয়োজন নেই। 

মুনা অমানিশার কথা অগ্রাহ্য করে মুদির দোকান থেকে কেক কিনে নিয়ে এলো। বলল,
তুই এটা খেতে থাক। আমি জোভানকে ফোন করছি। 

মুনা একটু দূরে সরে গিয়ে জোভানকে ফোন করল। ঠিক এমন সময়, অমানিশার ফোনও ভাইব্রেট করে উঠল। জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে ফেলতে ফোন হাতে নিয়ে দেখল স্ক্রিনে 'আহনাফ' নামটি উঠে আছে। 
          মোবাইল স্ক্রিনে আহনাফের নাম দেখে দ্বিধাগ্রস্ত অমানিশা আরোও জোরে জোরে শ্বাস ফেলতে লাগল। সে ফোন রিসিভ করল না। মাটির দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল।
প্রথমবার রিং হতে হতে কল কেটে গেল। তবে আহনাফও যেন ক্ষান্ত হল না!
কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে পুনরায় ফোন ভাইব্রেট করে উঠল অমানিশার। 
এবার অমানিশা কাঁপা হাতে কল কেটে দিল।

মুনা জোভানের সাথে কথা শেষ করে ফিরে এল। অমানিশার হাতে খাবারগুলো আগের অবস্থাতেই রয়েছে। সে বেশ বিরক্ত হল। কঠিন গলায় বলল,
তোকে না বললাম কেকটা খেয়ে নে? 

অমানিশা শান্তভাবে বলল,
খেতে ইচ্ছে করছে না, দোস্ত। খেলেই বমি হয়ে যাবে। 

বমি হলে হবে। তুই তাও কেকটা খেয়ে পানি খাবি। এক্ষুণি খাবি।
বেশ কড়াকড়ি ভাবে আদেশ করল মুনা। 

অমানিশা মুচকি হাসল। সে হাসিতে কোনো জ্যোতি নেই। মুখমন্ডলে যেন অন্ধকারের দৌরাত্ম্য। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বান্ধবীর মন রক্ষার্থে কেক খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে।
মুনা বলল, 
জোভানকে বললান ল্যাপটপ বিক্রি করে দেওয়ার কথা। 

মুখে খাবার নিয়েই অমানিশা আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করল,
কি বলল ভাইয়া? 

কত টাকাতে বিক্রি করতে পারবে তা সঠিক বলতে পারল না। 

অমানিশা হড়বড়িয়ে বলল,
দোস্ত আমার হাজার দশেক টাকা হলেই চলবে। 

মুনা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল,
জোভান এখন কোন এক গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছে। বিকালের আগে আসতে পারবে না। 

অমানিশা মুনাকে আশ্বস্ত করে বলল,
পাঁচটার মধ্যে আসলেই চলবে। 
 
মুনা ইতস্তত করে বলল,
দোস্ত, আমার বাসায় জানে আজকে স্কুল বন্ধ। আমি এতক্ষণ বাহিরে থাকতে পারব না। 

অমানিশার কপালে পুনরায় চিন্তার রেখা স্পষ্ট হল। তাহলে এখন উপায়? বিকাল পর্যন্ত সে একা কোথায় থাকবে? মুনাকে অনুরোধ করে বলল,
জোভানকে একটু বল না দ্রুত আসতে। ল্যাপটপটা নিয়ে গেলেই হবে। 

আমি বলেছি। ওর একদমই সময় নেই। 

জোভান ভাইয়ার এমন কোনো বিশ্বস্ত কেউ নেই যার কাছে ল্যাপটপটা দিয়ে দেওয়া যাবে? - ভ্রুঁ কুচকে জিজ্ঞেস করল অমানিশা। 

দাঁড়া, শুনে দেখছি। - মুনা পুনরায় জোভানকে ফোন দিয়ে বিষয়টি নিয়ে কথা বলল। কিন্তু কোনো উপায়ের সন্ধান মিলল না। জোভানের তেমন বিশ্বস্ত কেউ নাকি নেই! 

দুঃসময়ে মানুষ ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। অমানিশার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রমী কিছু ঘটল না। 
আহনাফ আরোও একবার অমানিশাকে ফোন করতেই সে রিসিভ করল। 
আহনাফ বাজখাঁই গলায় বলল,
ফোন দিলে ফোন ধরস না কেন, মাগী? কোন ভাতারের সাথে মারাইতে গেছস? 

গলার স্বর কিছুটা শক্ত করে অমানিশা বলল,
বাজে কথা বলো না, আহনাফ। 

মাগী দেখি আমাকে চুপ করতে বলে! - আহনাফ আরোও ক্ষেপে গেল। 
তুই আজকে বাসা থেকে বের হয়েছিস কেন? আজকে তো স্কুল বন্ধ! 

অমানিশা বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
তোমাকে কে বলেছে?

সেটা তোকে কেন বলব? ওওও... বে*শ্যা*গিরি ধরা পড়ে গিয়েছে সেজন্য চিন্তা হচ্ছে? কোন বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে বের হয়েছিস? 

আহনাফের ব্যবহারে অমানিশার চোখজোড়া টলমল করতে লাগল। সে ভাঙ্গা গলায় বলল,
বিশ্বাস করো, কোনো বয়ফ্রেন্ডের সাথেই বের হই নি। আমি একটা বিশেষ কাজে বের হয়েছি। 

তোর আবার কিসের বিশেষ কাজ রে মাগী ? - আহনাফ মনে সন্দেহের বীজ নিয়ে প্রশ্ন করল।  

অমানিশা এবার নিজেকে ঠিক রাখতে পারল না। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েই চিৎকার করে বলে উঠল,
এবোরশনের টাকা জোগাড় করতে। ল্যাপটপ বিক্রি করতে। তোমার কি কোনো টেনশন আছে আমাকে নিয়ে? ফোন দিয়ে বেশিরভাগ সময় তোমাকে পাওয়া যায় না। ভুলে যদি কখনও কল রিসিভও করো, উল্টো পাল্টা কথা বলো। অযথা গালাগাল দাও। মাঝে মাঝে মনে হয় নিজেকে শেষ করে দেই। আমি কি পাপ করে ফেলেছি তোমাকে ভালোবেসে? 

মুনা পাশ থেকে অমানিশাকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। 
দোস্ত! চিৎকার করিস না। আস্তে কথা বল। রাস্তার সবাই শুনতে পাবে। 

অমানিশা শান্ত হল না। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। অবস্থা বেগতিক দেখে মুনা দ্রুত একটা রিক্সা ডাক দিল। অমানিশাকে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসল। এরপর রিক্সাচালককে বলল,
মামা, টান দেন। 

রিক্সাচালক অদ্ভুতভাবে অমানিশার দিকে একবার তাকাল। এরপর মুনাকে জিজ্ঞেস করল,
যাবেন কোথায়? 

ঘারিন্দা।  

রিক্সা চলতে শুরু করল। মুনা অমানিশার কাছ থেকে ফোন নিয়ে সুইচড অফ করে দিল। বলল,
তুই এখন আর আহনাফের সাথে কথা বলিস না। আগে ঠান্ডা হ। 

অমানিশা মুনার কাধে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকল। তার ভুলগুলো অনেকটাই উপলব্ধি করতে পেরেছে সে। কিন্তু সময় চলছে তার বিপরীতে।

ঘারিন্দা পৌঁছে ভাড়া মিটিয়ে দিল মুনা। রেল লাইনের কিনারা ঘেঁষে হাঁটতে লাগল তারা। রেললাইনের একপাশে বিশাল বড় একটি পার্ক। অপরপাশে সবুজ গাছগাছালি ঘেরা ছোট্ট একটি গ্রাম। বলা হয়, এই ছোট্ট গ্রামটির পাশেই সর্বহারা দের আতুরনিবাস। 

খানিকটা পথ পেরোতেই অমানিশা অসহায় কণ্ঠে বলল,
আমি আর হাঁটতে পারছি না রে! আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। 

মুনা বলল,
আয় আমরা রেল লাইনের ওপর বসি। তুই একটু বিশ্রাম নিয়ে নে।

সূর্যটা ঠিক মাথার ওপর। গাছের ফাঁকফোকড়ে বসে পাখিগুলো মুখ হা করে ঝিমাচ্ছে। কি কাঠফাটা রোদ! 
অমানিশা দরদর করে ঘামছে। আচমকা কোথা থেকে যেন বাচ্চা একটি ছেলে দৌঁড়ে এলো। প্লাস্টিকে মুড়িয়ে ঠান্ডা পানির বোতল বিক্রি করছে সে। অমানিশা বাচ্চা ছেলেটির কাছ থেকে এক বোতল পানি কিনে নিল। আয়েশ করে অর্ধেক বোতল পানি খেল। 

মুনা ছটফট করছে। তার বাসায় ফিরতে হবে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখল তার ফোনটাও বন্ধ হয়ে গেছে।
শীট! - দাঁতের ফাঁক আলগোছে বলে উঠল মুনা। 

কি হয়েছে? - জিজ্ঞাসু চোখে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল অমানিশা। 

মুনা বলল,
আমার ফোনে চার্জ নেই। মোবাইল বন্ধ হয়ে গেছে। আম্মু যদি আমাকে ফোন করে না পায়? 

আমার মোবাইল থেকে কল করে কথা বল। সমস্যা নেই তো! - এ কথা বলে অমানিশা মোবাইল সুইচড অন করল। 

ফোন অন করতে যা দেরি! আহনাফের কল ঢুকতে এক মুহুর্ত সময়ও লাগল না। 

মুনা বিরক্ত হয়ে বলল,
এই ছেলে কি এতক্ষণ যাবৎ তোর নাম্বারে বিরামহীন ট্রাই করে গেছে?

জানি না। একটু রিসিভ করে শুনব কি বলে? - অনুনয়ের স্বরে জিজ্ঞেস করল অমানিশা। 

মুনাও এবার রাজি হয়ে গেল।

ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে আহনাফ নরম কণ্ঠে বলল,
তুমি কোথায় আছো, জান? 

ঘারিন্দা। 

ঘারিন্দা কি করো? 

কিছুই না। 

স্কুলের সামনে চলে আসো তুমি। এ অবস্থায় এভাবে ঘোরাঘুরি করছো কেন? শরীর খারাপ করবে তো! - আহ্লাদী গলায় বলল আহনাফ। 

অমানিশা ক্ষিপ্র গতিতে উত্তর দিল,
শরীর খারাপ হলে হবে। সেটা নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা করার কোনো প্রয়োজন নেই। 

আমি কথা বাড়াবো না। শুধু এটুকু বলব, তোমার স্কুলের সামনে অপেক্ষা করছি। তোমাকে না দেখে আমি আজ বাড়ি ফিরব না। এখন কি করবে ভেবে দেখ। - আহনাফ ফোন কেটে দিল। 

অমানিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মুনা ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
কি হয়েছে? কি বলল আহনাফ? 

স্কুলের সামনে নাকি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। না দেখা করে বাড়ি ফিরবে না। - হাসার চেষ্টা করল অমানিশা।  

তুই কি করতে চাস? 

চল তাহলে স্কুলের সামনে ফিরে যাই আবার। - একথা বলতে বলতে অমানিশা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। 
তৎক্ষণাৎ এক অপ্রত্যাশিত বিপত্তি ঘটল।
পুনরায় অমানিশার ফোনটি ভাইব্রেট করে উঠল। স্ক্রিনে ভেসে থাকা নাম্বার দেখে অমানিশার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো। হাত পা জমে যায় যায় অবস্থা! শরীর কাঁপতে লাগল অনবরত। 
অমানিশার হাল দেখে মুনা বেশ ভড়কে গেল। বলল,
কি হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন? 

অমানিশা কাঁপা গলায় বলল,
আমার ফোনে মায়ের নাম্বার থেকে কল আসছে! 

কি বলছিস এসব? তোর নাম্বার কোথা থেকে পেল? 

জানি না। কিচ্ছু বুঝতে পারছি না আমি। 

আন্টি কি জেনে গেলো নাকি সব? কি করবি এখন? - ভয়ার্ত গলায় মুনা জিজ্ঞেস করল। 

আমার মাথা কাজ করছে না। চল আগে স্কুলের সামনে যাই। আহনাফের সাথে দেখা করি। রিক্সা ডাক দে। 

কল রিসিভ না করলেও অনবরত অমানিশার নাম্বারে রাহেলা ফোন করতে লাগল। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ছে তার। কাঁপা হাতে ধরে রয়েছে পুরোনো একটি প্রেগনেন্সি কীট। 
          ক্লিনিকের সাদা-নির্মম দেয়ালগুলো যেন আরও সাদা, আরও শীতল হয়ে উঠেছে অমানিশার জন্য। ফিনাইলের গন্ধও তার অসহ্য লাগছে। সে যে খাটে শুয়ে আছে তার চারপাশে সস্তা সাদা পর্দা টানানো। অমানিশার শরীর নিস্তেজ, যন্ত্রণায় জর্জরিত। এবরশনের মত ঘৃণ্য অপরাধ তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়া করিয়েছে আজ। তাই হয়ত শরীরের চেয়েও বেশি ভারী হয়ে আছে তার মন। 
ক্লিনিকের নার্সরা অমানিশার পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, মুখে এক ধরনের অবজ্ঞার ছাপ নিয়ে। তাদের চোখের একরাশ জাজমেন্টাল দৃষ্টিও বেশ পরিলক্ষিত। যেন তারা বলছে, "এই মেয়ে! তুমি ভয়ঙ্কর অপরাধ করেছো। তুমি এমন নষ্ট কাজ করেছো, যার জন্য সারাজীবন তোমার লজ্জিত হওয়া উচিত। মাথা নত করে থাকা উচিত চিরকাল। কি নোংরা মেয়েছেলে তুমি। ছিঃ! "

ডাক্তারের কণ্ঠেও ছিল সেই একই মনোভাব। রাউন্ডে যে কয়বার এসেছেন, অমানিশার দিকে এমন ঘৃণ্য দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়েছেন। যেন অমানিশার মতো মেয়েরা তার দুচোখের বিষ। ইঁচড়েপাকা মেয়েগুলোর একই গল্প, একই পরিণতি দেখতে দেখতে তারা বিরক্ত। ব্যাকস্টোরি নিয়ে তাদের তেমন কোনো উৎসাহ নেই। 

অমানিশার বুকের ভেতরে একরাশ ক্রোধ, হতাশা আর অবর্ণনীয় শূন্যতা জমাট বেঁধে আছে। 

খাটের পাশেই বসে আছে রাহেলা। তার মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এই মানুষটার ভিতরে কী ভয়ানক ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তিনি অমানিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর অঝোরে কাঁদছেন। কান্নায় ভিজে গেছে তার ওড়নার একাংশ। চোখের কোণ শুকানোর কোনো ফুরসতই যেন নেই। তার প্রতিটি ভারী নিশ্বাসে মিশে আছে অসহায়ত্ব।
মনে মনে সৃষ্টিকর্তার সাথে এক তরফা তর্কে মেতে উঠেছেন তিনি।
"কী দোষ ছিল আমার মেয়েটার? হে আল্লাহ, তুমি কেন আমার পরিবারের উপর এই বিপদ দিলে? আমার মেয়েটাকে তুমি আগের মত করে ফিরিয়ে দাও। ফিরিয়ে দাও সেই ছোট্ট অমানিশাকে।"

রাহেলার মনে ভেসে আসছে অমানিশার শৈশবের স্মৃতি স্কুলের ইউনিফর্মে পরিপাটি করে গোঁজা দুটি বিনুনি। বিনুনির নিচে আবার সাদা ফিতের ফুলের কারুকাজ। হাসিখুশি চেহারার চঞ্চল তার মেয়ে। অমানিশা! সেই মেয়েটা কীভাবে এমন এক বিপদে জড়িয়ে পড়ল? রাহেলার বুকের মাঝে বিস্ময়, শঙ্কা, ভয় আর ক্ষোভের ঢেউ আছড়ে পড়ছে বারবার।

অমানিশার চোখে তখন ভেসে আসে দিনকয়েক আগের দৃশ্য। আহনাফের মুখটা তার স্পষ্ট মনে পড়ছে। যার জন্য সে নিজের সবটুকু বিসর্জন দিল। বাড়িতে মিথ্যে বলে স্কুলের নাম করে মুনাকে সাথে নিয়ে সেদিন বেরিয়ে গিয়েছিল কেবলমাত্র তার জন্য। সেদিন ল্যাপটপটা বিক্রি হয়েছিল। তবে ল্যাপটপ বিক্রির টাকাগুলো আহনাফের হাতে তুলে দেওয়ার পর সে আর একবারও পেছন ফিরে তাকায়নি। ফোন করেনি। এমনকি একবার খোঁজও নেয়নি তার। অমানিশার বাচ্চার বাবা তো সেই ছিল! সে কিভাবে পারল অমানিশাকে, তার বাচ্চাকে, এভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিতে? আহনাফের ব্যবহার আজ অমানিশার মনের ভেতরে বিষের মতো ছড়িয়ে গেছে। নিজেকে তার তুচ্ছ মনে হচ্ছে। আহনাফের কাছে সে শুধুমাত্র একটি সেক্স টয় ছিল! যাকে যখন খুশি শরীরের ক্ষুধা মেটানোর জন্য ব্যবহার করা যায়। নেশার টাকা ফুরিয়ে গেলে এটিএম মেশিন হিসেবে ব্যবহার করা যায়। 

ক্লিনিকের সাদা দেয়ালে ঝুলতে থাকা সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অমানিশা অনুভব করল, তার ভিতরটা ফাঁকা। একেবারে শূন্য। সে জানেনা তার বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য কি? তবে অমানিশা এটা জানে তার ভুলটা কোথায় হয়েছে। আহনাফের প্রতি অন্ধ বিশ্বাসে নিজেকে সে হারিয়ে ফেলেছিল গোলকধাঁধায়। 
পুরুষ মানুষের কাছে তার প্রেমিকার দেহ হল মন্দির। সেই মন্দিরকে অপবিত্র যে করে, সে আর যাইহোক সম্মানের সহিত কখনো ভালোবাসতে পারে না! 

অমানিশা ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করল। তার মনে হলো, এই জীবনের শূন্যতার মধ্যেও এক ধরনের পুনর্জন্ম সম্ভব। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, সে আর ভাঙবে না। বরং নিজেকে আবার গড়ে তুলবে আরোও পোক্তভাবে। জীবনের কোনো ভুলের বোঝা তাকে আর দমিয়ে রাখতে পারবে না। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সে নতুন যাত্রা শুরু করবে।

পরবর্তী দিনগুলোতে অমানিশা নিজেকে গুটিয়ে নিল। পুরোনো বন্ধুদের এড়িয়ে চলতে শুরু করল। কারও সাথে আগের মতো প্রাণ খুলে কথা বলত না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে দূরে সরে গেল, নিজের ভেতরে একটি ছোট্ট জগৎ তৈরি করে নিল। সেই জগতে তার পুরনো ভুলের কোনো স্থান নেই। সেখানে জায়গা করে নিল তার নতুন জীবনের সূচনার শক্তি আর স্বপ্ন।

সময় তার নিজের গতিতে এগিয়ে যায়। অমানিশার জীবনও থেমে রইল না। 

কয়েক বছর পর।

এক শীতের সকাল। সূর্যের নরম আলো বারান্দায় ছড়িয়ে পড়েছে। অমানিশা বারান্দার এক কোণে বসে আছে, হাতে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ চা। তার পাশে বসে আছে তার স্বামী, সাদমান। সাদমান তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। অমানিশা তার স্বামীর হাসিতে খুঁজে পায় এক ধরনের স্থির শান্তি।
বারান্দা থেকে দূরের কুয়াশাঘেরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎই অমানিশার মনে পড়ে যায় সেই দিনগুলোর কথা—ক্লিনিকের সাদা দেয়াল, মায়ের কান্না, আহনাফের উদাসীন মুখ। মনে পড়তেই তার ভেতরে এক ধরনের শিউরে ওঠা অনুভূতি জাগে। 

সাদমান তার কাঁধে আলতো করে হাত রাখে। জিজ্ঞেস করে,
"তুমি এখনো তোমার অতীত ভুলতে পারো নি, তাই না?"

অমানিশা প্রত্যুত্তরে বলল, 
"অতীত ভুলবার জিনিস নয়। তবে জীবন অনেক সহজভাবে বদলে যায়। পুরোনো জিনিস ফিকে হয়ে যায়। তুমি আমার জীবনে না আসলে কখনো বুঝতামই না ভালোবাসার গভীরতা কেমন হয়।"

সাদমান উদাস কণ্ঠে বলল,
"জানো? আমার অফিসের এইচ আর এর মেয়েরও ঘটনা অনেকটা তোমার জীবনের সাথে মিলে যায়। মেয়েটা সুইসাইড করার চেষ্টাও করেছে। ভাগ্য ভালো সঠিক সময়ে দরজা ভেঙ্গে তাকে উদ্ধার করা হয়।"

অমানিশা মৃদু হাসল। বলল, "জানো? আমার এই গল্প পুরো পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার ইচ্ছা আছে। যদি আমার গল্প কোনো মেয়ের জন্য শিক্ষা হয়, তাহলে সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি আর হবে না। আমি এই পৃথিবীতে কোনো দ্বিতীয় অমানিশা চাই না।"

সাদমান শক্ত করে অমানিশাকে জড়িয়ে ধরল। অমানিশার চোখের কোণে জল জমেছে। হয়ত তার জীবনের চড়াই উতরাই এর মিশ্র অনুভূতিতেই এই অশ্রুজলের সূচনা।  
·
·
·
সমাপ্তি…………………………………………………………………

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp